বাল আবাল ধোন ও সোনাখাড়া মাগি

ড. মোহাম্মদ আমীন
বাল: তৎসম ‘বাল (√বল+অ)’ অর্থ বালক, শিশু, কিশোর। শব্দটির স্ত্রীলিঙ্গ— বালা ও বালি। ‘বাল’ নিয়ে গঠিত শব্দাবলির কয়েকটি— বালচর্চা (শিশুপালন), বালবাচ্চা (ছোটো ছেলেমেয়ে), বালবিধবা (যে কন্যা বালিকা অবস্থায় বিধবা হয়েছে), বালবৈধব্য (বালিকা অবস্থায় বৈধব্যদশা), বালভোগ (বালক কৃষ্ণকে প্রদত্ত প্রাতঃকালীন ভোগ, বালভোগ্য (শিশুদের উপভোগের যোগ্য), বালসুলভ (বালকোচিত), বালসূর্য (নবোদিত সূর্য), বালশশী (শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়ার চাঁদ) প্রভৃতি।অনেকে মনে করেন, বাংলায় ‘বাল’ অর্থ গোপনাঙ্গের কেশ? আমার প্রশ্ন- এটি তারা কোন সূত্র থেকে পেয়েছেন? প্রমিত বাংলায়, এমন অর্থের কোনো শব্দ নেই, এমনকি আঞ্চলিক ভাষার অভিধানেও। যারা ‘বাল’ শব্দকে গোপনাঙ্গের কেশ গণ্য করে মাতৃভাষা নিয়ে তামাশা করেন, তাদের মাতৃভাষা জ্ঞান ও আত্মমর্যাদাবোধে  প্রচণ্ড দীনতা রয়েছে।   বাংলা একাডেমি ব্যবহারিক বাংলা অভিধানের  ৮৬১ পৃষ্ঠায় ‘বাল’ ভুক্তির শেষ প্রান্তে বলা হয়েছে: “বাল অর্থ বিশেষ্যে পুরুষাঙ্গ বা স্ত্রীযোনির নিকটবর্তী চুল, তুচ্ছতা নির্দেশক গালিবিশেষ” একটি হিন্দি শব্দ। এজন্য পৃথক কোনো ভুক্তি নেই। এই হিন্দি শব্দটাকে কোনো অভিধানে বাংলা শব্দ হিসেবে দেখানো হয়নি। যেমনটি বাংলায় আগত সব বিদেশি শব্দের বেলায় পৃথকভুক্তি হিসেবে দেখানো হয়। সুতরাং গোপনাঙ্গের কেশ অর্থে প্রচলিত শব্দটি বাংলা নয়, হিন্দি।
আবাল: আ+বাল= আবাল। ‘বাল’ শব্দের ‘আ’ উপসর্গ যুক্ত হয়ে ‘আবাল’ শব্দ গঠিত হয়েছে। বিস্তৃতি, পর্যন্ত, ব্যাপকতা প্রভৃতি প্রকাশে ‘আ’ উপসর্গটি ব্যবহৃত হয়। যেমন: আ+মৃত্যু= মৃত্যু পর্যন্ত। ‘আবাল’ শব্দের গঠনের সঙ্গে আকণ্ঠ, আপাদমস্তক, আমরণ, আসমুদ্রহিমাচল, আজীবন, আজন্ম প্রভৃতি শব্দের গঠনের মিল রয়েছে। আবাল শব্দের আভিধানিক অর্থ— বাল্যাবধি, বাল্যকাল থেকে, অল্পবয়স থেকে, শিশুকাল থেকে প্রভৃতি। অনেকে শব্দটিকে গালি হিসেবে ব্যবহার করেন।  আসলেই কি তারা শব্দটির অর্থ জানেন? কখনও খুঁজে দেখেছেন? নাকি হুজুগে বাঙালি শুধু হুজুগে অর্থ নিয়ে মাতৃভাষার  একটি শালীন শব্দকে এমন অশালীনভাবে ব্যবহার করে যাচ্ছে! যেসব শিক্ষিত এমন শোভন একটা শব্দকে উপহাস ও গালি হিসেবে ব্যবহার করে তৃপ্তি বোধ করেন, তাদের চিন্তা পঙ্গু, চেতনা মুমূর্ষু।
 
ধোন: বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানে ধোন বানানের কোনো শব্দ নেই। ধোন শব্দটি প্রমিত বাংলায় ধোয়া বা ধৌত ক্রিয়ার সম্ভ্রমপ্রকাশক অনুজ্ঞা হিসেবে ব্যবহৃত হয় (হাতমুখ ধোন)। ‘বাংলা একাডেমি বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান’ [(অখণ্ড), প্রধান সম্পাদক ডক্টর মুহম্মদ শহীদু্ল্লাহ, পৃষ্ঠা ৫৭০, প্রথম প্রকাশ ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দ] গ্রন্থে ধোন্ শব্দের কয়েকটি অর্থ পাওয়া যায়:
(১)  সামান্য নরম [যশোর অঞ্চল]। ( বউ, মাছভাজাটা ধোন্ থাকে যেন।)
(২) ধোয়ার অনুরোধমূলক আজ্ঞা [একাধিক অঞ্চল] (তুলাগুলি ধোন্ না যে? * ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্ )
(৩) পুরুষাঙ্গ [বাকেরগঞ্জ]।
(৪) গর্ত [রংপুর]।
এমন অনেক শব্দ আছে যা  একাধিক অর্থ প্রকাশ করে। যেমন: “বল সোনা বল, শুধু বল দিয়ে কী বল খেলা যায়?” এখানে ‘বল’ একাধিক অর্থ দ্যোতিত করছে। সোনা- আদরের কেউ। “লক্ষ না করলে লক্ষ টাকা খরচ করেও লক্ষ্য অর্জন করা যাবে না।” এ বাক্যে ‘লক্ষ’ একাধিক অর্থ বহন করছে। বাক্যের সজ্জা, কথোপকথন, পরিবেশ, ভঙ্গি প্রভৃতির উপর সমার্থক শব্দের অর্থ নির্ধারিত হয়।
“হাত ধোন” কথা শুনলে একজন ভদ্রলোক বুঝবেন— তাকে হাত ধৌত করার অনুরোধ করা হচ্ছে। কারণ যে-কোনো বিবেচনায় এটিই এর একমাত্র প্রাসঙ্গিক অর্থ। অধিকন্তু, যে-কোনো কথায় একজন ভদ্রলোকের সাধারণত মঞ্জু অর্থটাই প্রথমে মনে আসে।“হাত ধোন” বলতে যারা “পুরুষাঙ্গকে হাত” বলা হচ্ছে মনে করেন—  তাদের শুধু বাংলা জ্ঞান নয়, শালীনতা ও পারিবারিক শিক্ষবোধেও সমস্যা আছে। ধোন্ অর্থ শিশ্ন মনে করে কেউ যদি বলেন, “হাত ধোন, হাত ধোন শুনতে শুনতে হাতটাই ধোন হয়ে গেছে,” তাহলে বুঝতে হবে ওই  লোকের শুধু হাত নয়, পুরো শরীরটাই শিশ্ন হয়ে গেছে।
সোনা: সংস্কৃত ‘স্বর্ণ’ থেকে ‘সোনা’ শব্দের উদ্ভব। বিশেষ্যে সোনা অর্থ— স্বর্ণ, আদরের ধন, স্বর্গের ধন, প্রিয় সম্ভাষণ; বিশেষণে সোনালি রঙের। প্রিয়জনদের বিশেষ করে শিশুদের আদর করে ‘সোনা’ ডাকা হয়। বিভিন্ন অঞ্চলে শিশুদের পুরুষাঙ্গকেও সোনা বলা হয়। সোনা শব্দের আর একটি অর্থ সমৃদ্ধি, ধনদৌলত, ধনের উৎস প্রভৃতি। যেমন: সোনার বাংলা, সোনার ময়না। এ অবস্থায়, “আমার সোনা আয়” বলতে কেউ যদি “আমার পুরুষাঙ্গ আয়” বুঝে তাহলে সে “হাত ধোন” অর্থ “হাত পুরুষাঙ্গ” মনে না-করে আর কি করবে? তারা কী ‘সোনার বাংলা’ বলতেও অনুরূপ শিশ্ন টেনে আনে?
সোনাখাড়া: সংস্কৃত ‘অখণ্ড’ থেকে উদ্ভূত এবং বাক্যে বিশেষ্য রূপে ব্যবহৃত ‘খাঁড়া’ শব্দের অর্থ অসি, খড়্‌গ, তরবারি, তরোয়াল।  সংস্কৃত ‘স্থির’ থেকে উদ্ভূত ‘খাড়া’ অর্থ বিশেষণে দণ্ডায়মান, পুরোপুরি বা একটানা, লম্বভাবে অবস্থিত (খাড়া পাহাড়), অবশ্য প্রতিপাল্য (খাড়া হুকুম) এবং সর্বদা প্রস্তুত (সদা প্রস্তুত) প্রভৃতি।  সোনাখাড়া একটি উন্নত মানের প্রাচীন ধান্যবিশেষ।  ধানের এ জাতটি ঝড়বৃষ্টিতেও মাথায় সোনা রঙের ধান নিয়ে দণ্ডায়মান থাকত। অতএব, সোনাখাড়া শব্দের অর্থ সোনার অসি, সোনার তরোয়াল, সোনা রঙের ধান, সমৃদ্ধ এলাকা, স্থিতিশীল সমৃদ্ধ জনপদ প্রভৃতি। তাই সোনাখাড়া অর্থ যারা ‘দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষাঙ্গ’  মনে করে, তাহলে তাদের চিন্তা পর্নে ভরে গেছে বলতে হয়। যারা ‘সোনা দাঁড়া’ অর্থ ‘শিশ্ন দাঁড়া’  বুঝে তাদের মনোবৃত্তি শিশ্নাহত বললে অত্যুক্তি হয় না। প্রসঙ্গত, রাজশাহী বিভাগের সিরাজগঞ্জ জেলার রায়গঞ্জ উপজেলায় সোনাখাড়া নামের একটি ইউনিয়ন (২নম্বর ইউনিয়ন) আছে।
মাগি: বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানমতে বাক্যে বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত বাংলা ‘মাগি’ শব্দের অর্থ— অশিষ্টার্থে প্রাপ্তবয়স্ক স্ত্রীলোক ও যৌনকর্মী।
—————————————

All Link

বিসিএস প্রিলি থেকে ভাইভা কৃতকার্য কৌশল

ড. মোহাম্মদ আমীনের লেখা বইয়ের তালিকা

বাংলা সাহিত্যবিষয়ক লিংক

বাংলাদেশ ও বাংলাদেশবিষয়ক সকল গুরুত্বপূর্ণ সাধারণজ্ঞান লিংক

বাংলা বানান কোথায় কী লিখবেন এবং কেন লিখবেন/১

বাংলা বানান কোথায় কী লিখবেন এবং কেন লিখবেন/২

বাংলা বানান কোথায় কী লিখবেন এবং কেন লিখবেন /৩

কীভাবে হলো দেশের নাম

ইউরোপ মহাদেশ : ইতিহাস ও নামকরণ লিংক

শুদ্ধ বানান চর্চা লিংক/১

দৈনন্দিন বিজ্ঞান লিংক

শুদ্ধ বানান চর্চা লিংক/২

শুদ্ধ বানান চর্চা লিংক/৩

শুদ্ধ বানান চর্চা লিংক/৪

কীভাবে হলো দেশের নাম

সাধারণ জ্ঞান সমগ্র

সাধারণ জ্ঞান সমগ্র/১

সাধারণ জ্ঞান সমগ্র/২

বাংলাদেশের তারিখ

ব্যাবহারিক বাংলা বানান সমগ্র : পাঞ্জেরী পবিলেকশন্স লি.

শুদ্ধ বানান চর্চা প্রমিত বাংলা বানান বিধি : বানান শেখার বই

কি না  বনাম কিনা এবং না কি বনাম নাকি

মত বনাম মতো : কোথায় কোনটি এবং কেন লিখবেন

ভূ ভূমি ভূগোল ভূতল ভূলোক কিন্তু ত্রিভুবন : ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ

মত বনাম মতো : কোথায় কোনটি এবং কেন লিখবেন

প্রশাসনিক প্রাশাসনিক  ও সমসাময়িক ও সামসময়িক

বিবিধ এবং হযবরল : জ্ঞান কোষ

সেবা কিন্তু পরিষেবা কেন

ভাষা নদীর মতো নয় প্রকৃতির মতো

এককথায় প্রকাশ

শব্দের বানানে অভিধানের ভূমিকা

আফসোস নিয়ে আফসোস

লক্ষ বনাম লক্ষ্য : বাংলা বানান কোথায় কী লিখবেন

ব্যাঘ্র শব্দের অর্থ এবং পাণিনির মৃত্যু

যুক্তবর্ণ সরলীকরণ আন্দোলন : হাস্যকর অবতারণা

প্রায়শ ভুল হয় এমন কিছু শব্দের বানান/২

গীতাঞ্জলি

রবীন্দ্রনাথের ডাকঘর

রবীন্দ্রনাথের রাজা

রবীন্দ্রনাথের চতুরঙ্গ

রবীন্দ্রনাথের মুক্তধারা

বাংলা বানান, ভাষা ও শব্দচয়ন কৌশল শেখার কয়েকটি বই।

অমর একুশে গ্রন্থমেলা/২০২০-এ প্রকাশিত বই

পুথিনিলয় প্রকাশিত বই

শুবাচ একশ লিংক: বাংলা ভাষা বাংলা বানান ও বাংলা ব্যাকরণ

পাড় ও পার এবং সুন্দর হাতের লেখা

ইংরেজি বর্ণের প্রতিবর্ণীকরণে দন্ত্য-স এবং তালব্য-স এর ব্যবহার

এক মিনিটের পাঠশালা (১-৫)

এক মিনিটের পাঠশালা (১-১১) : বিসিএস বাংলা

এক মিনিটের পাঠশালা (১০-১৫)

এক মিনিটের পাঠশাল (১৬-২০)

এক মিনিটের পাঠশালা/২৪

দণ্ড দণ্ডায়মান ও দন্ড: প্রয়োজনানুসারে ইত্যাকার

স্যমন্তক: জটিল জটাজালের এক মানবিক উপাখ্যান

বহুল প্রচলিত কিছু অসংলগ্ন সমাস

ব্যাকরণবিধি ছাড়া প্রমিত বানান মনে রাখার কৌশল : নিমোনিক

কোয়ারেন্টিন আইসোলেশন: অর্থ ব্যুৎপত্তি ও ইতিহাস

জন্য বনাম জন্যে

করোনাভাইরাস: সৃষ্টির সেরা আশীর্বাদ

লকডাউন লকআউট ধর্মঘট কারফিউ এবং ১৪৪ ধারা

বিসিএস করোনা: করেনাভাইরাস

বাক্‌ বাগ ও বাগ্‌

অ্যালফাবেটের গল্প

স্ত্রী স্ত্রৈণ এবং স্থল স্থান

ব্যাকরণ মুখস্থ না করেই প্রমিত বানান আত্মস্থ করার কৌশল

ব্যাকরণ মুখস্থ না করেই প্রমিত বানান আত্মস্থ করার কৌশল/২

গোরু: মনুষ্য সভ্যতার প্রথম প্রধানশিক্ষক

মড়ক মারি মহামারি ও বিশ্বমারি

শুবাচ থেকে শুবাচির প্রশ্ন অবিকল

স্পরাডিক এনডেমিক এপিডেমিক ও প্যানডেমিক

ইতালি: মহামারি (Epidemic) ও সর্বমারি(Pandemic)-এর লালনাগার

দর্শক ধর্ষক দর্শন ধর্ষণ দর্শিত ধর্ষিত

উপহাস বনাম পরিহাস

ঈর্ষা বনাম হিংসা

দ্বেষ বনাম বিদ্বেষ

দায়িত্ব বনাম কর্তব্য

বাঙালি কতটুকু বাংলা জানে/১

হায় হায় কেউ পাস করতে পারবে না আর

ফলশ্রুতি: ফলে বা পরিণাম অর্থে ফলশ্রুতি শুদ্ধ কি না

শব্দের জাতপ্রথা

মূল মূল্য এবং ঊ-কার সূত্র

অধঃ অধঃস্থ অধস্তন অধঃস্তন

গুরুত্বপূর্ণ শব্দের গুরুত্বপূর্ণ অর্থ

অপরূপ অর্থ অপয়া কদাকার

মহাপ্রাণ ন্, ম্, র্ আর ল্: উচ্চারণ

সূক্ষ্ম পার্থক্য: উদ্ধৃতিচিহ্নের প্রয়োগ

এক: কখন বসে সেঁটে কখন রাখে ফাঁক

Language
error: Content is protected !!