ড. মোহাম্মদ আমীন
বিংশ শতকের অন্যতম শক্তিশালী কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৯শে মে মোতাবেক ১৩১৫ বঙ্গাব্দের ৬ই জ্যৈষ্ঠ বিহারের সাওতাল পরগনা,বর্তমান ঝাড়খণ্ড রাজ্যের দুমকা শহরে জন্ম গ্রহণ করেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের আসল নাম প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। পিতার দেওয়া ডাক নাম ছিল মানিক। ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে সুরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের মেয়ে কমলা দেবীর সঙ্গে তার বিয়ে হয়। তাঁর পিতা হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায় ও মাতা নীরদাসুন্দরী দেবী। পিতামাতার চৌদ্দ সন্তানের মধ্যে মানিক ছিলেন অষ্টম। পিতা হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন ঢাকা জেলার সেটেলমেন্ট বিভাগের সাব-রেজিস্টার। পিতার বদলির কারণে বাংলা-বিহার-ওড়িষার দুমকা, আরা, সাসারাম, কলকাতা, বারাসাত, বাঁকুড়া, তমলুক, কাঁথি, মহিষাদল, গুইগাদা, শালবনি, নন্দীগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, টাঙ্গাইল প্রভৃতি এলাকায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের শৈশব-কৈশোর ও ছাত্রজীবন অতিবাহিত হয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বব্যাপী মানুষের ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক মূল্যবোধের চরম সংকটময় মুহূর্তে বাংলা কথাসহিত্যে যে কয়জন লেখক বাংলা সাহিত্যজগতে নতুন এক বৈপ্লবিক ধারার সূচনা ঘটিয়েছিলেন তন্মধ্যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় অন্যতম। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্যে বস্তুবাদের প্রভাব লক্ষণীয়। মানুষ, মানুষের মূল্যবোধ এবং মানবতাবাদের জয়গান প্রভৃতি ছিল তাঁর সাহিত্যের মুল উপজীব্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের সার্বিক প্রভাবকে তিনি তাঁর সাহিত্যে ধারণ করেছেন। অধিকন্তু, তিনি ফ্রয়েডীয় মনঃসমীক্ষণ ও মার্কসীয় শ্রেণীসংগ্রাম তত্ত্ব দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। ১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। এ সময় থেকে তার লেখায় কম্যুনিজমের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। ১৯৪৬ সালে প্রগতি লেখক সংঘের যুগ্ম-সম্পাদক নির্বাচিত হন।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম গল্পগুচ্ছ অতসী মামী এবং প্রথম উপন্যাস দিবারাত্তির কাব্য ।জননী, দিবারাত্রির কাব্য, পদ্মানদীর মাঝি, পতুুলনাচের ইতিকথা, অহিংসা, চতুষ্কোণ, দর্পণ, চিন্তামনি, সোনার চেয়ে দামী, ইতিকথার পরের কথা, নাগপাশ, ফেরিওয়ালা, আরোগ্য, চালচলন, তেইশ বছর আগে পরে, হলুদ নদী সবুজ বন প্রভৃতি তাঁর কয়েকটি বিখ্যাত উপন্যাস। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সর্বমোট ৪০ টি উপন্যাস এবং ৩০০ টি ছোট গল্প রচনা করেছেন। তার লেখা অন্যতম ছোটগল্প হলো মাসি -পিসি।যেটি সর্বপ্রথম ‘পূর্বাশা’ পত্রিকায় ১৩৫২ বঙ্গাব্দের চৈত্র সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গন্থ: উপন্যাস জননী (১৯৩৫), দিবারাত্রির কাব্য (১৯৩৫), পদ্মানদীর মাঝি (১৯৩৬), পুতুলনাচের ইতিকথা (১৯৩৬), শহরতলী (১৯৪০-৪১), চিহ্ন (১৯৪৭), চতুষ্কোণ (১৯৪৮), সার্বজনীন (১৯৫২), আরোগ্য (১৯৫৩) প্রভৃতি তার কয়েকটি তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি উপন্যাস। ছোটগল্পের মধ্যে অতসী মামী ও অন্যান্য গল্প (১৯৩৫), প্রাগৈতিহাসিক (১৯৩৭), সরীসৃপ (১৯৩৯), সমুদ্রের স্বাদ (১৯৪৩), হলুদ পোড়া (১৯৪৫), আজ কাল পরশুর গল্প (১৯৪৬), মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ গল্প (১৯৫০), ফেরিওয়ালা (১৯৫৩) প্রভৃতি অন্যতম। পদ্মানদীর মাঝি ও পুতুলনাচের ইতিকথা উপন্যাস দুটি তাঁর বিখ্যাত রচনা। এ দুটির মাধ্যমেই তিনি সর্বাধিক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। পদ্মানদীর মাঝি চলচ্চিত্রায়ণ হয়েছে। তাঁর উপন্যাস ও গল্পসমূহকে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ বলে বিবেচিত হয়। ইংরেজি ছাড়াও তার রচনাসমূহ বহু বিদেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
তার মা নীরদাসুন্দরীর আদিনিবাস ছিল বর্তমান বাংলাদেশের গাউদিয়া গ্রামে। এই গ্রামটির পটভূমি নিয়ে তিনি রচনা করেন প্রসিদ্ধ উপন্যাস পুতুলনাচের ইতিকথা। পদ্মার তীরবর্তী জেলেপাড়ার পটভূমিতে রচনা করেন পদ্মানদীর মাঝি উপন্যাসটি। জীবনের প্রথমভাগে তিনি ফ্রয়েডীয় মতবাদ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। এছাড়া মার্কসবাদও তাকে যথেষ্ট প্রভাবিত করেছিল। তার অধিকাংশ রচনাতেই এই দুই মতবাদের নিবিড় প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। ব্যক্তিগত ভাবে মানিক ছিলেন মধ্যবিত্ত মানসিকতার উত্তারাধিকারী।
১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় মেদিনীপুর জেলা স্কুল থেকে প্রবেশিকা এবং ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দে বাঁকুড়া ওয়েসলীয় মিশন কলেজ থেকে আই.এস.সি. পাশ করেন। এরপর কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে গণিত বিষয়ে অনার্সে ভর্তি হন। একদিন কলেজ ক্যান্টিনে আড্ডাকালে এক বন্ধুর সঙ্গে মানিক বাজী ধরেন যে, তাঁর লেখা গল্প বিচিত্রায় ছাপাবেন। সে সময় কলকাতায় বিচিত্রা পত্রিকায় কেবল নামকরা লেখকের লেখাই ছাপা হতো। বন্ধুর সঙ্গে বাজি ধরে মানিক লিখে ফেললেন তার প্রথম গল্প “অতসী মামী”। লেখার পড় বিচিত্রার সম্পাদক বরাবর পাঠিয়ে দেন। গল্পের শেষে নাম সাক্ষর করেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় হিসাবে। সম্পাদক উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় লেখাটি পাঠানোর চার মাস পর বিচিত্রায় ছাপেন। গল্পটি ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় নামটি পরিচিত হয়ে ওঠে বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে। এরপর থেকে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখা পাঠাতে থাকেন মানিক। সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশের ফলে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার ব্যাপক ক্ষতি হয়। শেষ পর্যন্ত শিক্ষাজীবনের ইতি ঘটিয়ে সাহিত্যচর্চায় মন দেন এবং তাকে মূল পেশা হিসেবে বেছে নেন।
১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় মৃগ রোগে ভুগছিলেন। কিন্তু অর্থাভাবে উপযুক্ত চিকিৎসা করাতে পারেননি। সহায়সম্বল যা ছিল তা চিকিৎসাতে শেষ হয়ে যায়। ফলে সহজারোগ্য রোগটি কয়েক বছরের মধ্যে জটিল অবস্থা ধারণ করে। জীবনের শেষদিকে অর্থকষ্ট আরো মারাত্মক আকার ধারণ করে। দুবেলা খাওয়ার জোটাতেও কষ্ট হতো। চিকিৎসা তো আছেই। চিকিৎসার অর্থের জন্য অনেকের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। কেউ সাহায্য করেনি। দীর্ঘ ২২ বছর রোগে ভোগার পর চরম দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত হয়ে বিনা চিকিৎসায় ধুকেধুকে ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ৩রা ডিসেম্বর ৪৮ বছর বয়সে মারা যান।