ড. মোহাম্মদ আমীন
অনেকে বলেন, বিশ্বে মুসলিমের সংখ্যা বাড়ছে; গণনাও তা বলে। কিন্তু আমি দেখি- বিশ্বে মুসলিমের সংখ্যা কমছে এবং খুব দ্রুত কমছে। রাষ্ট্র, রাষ্ট্রীয় প্রভাব, সরকার, রাজনীতি, ভৌগোলিক-সীমানা, ধর্ম, সম্প্রদায়, উপ-সম্প্রদায়, মাযহাব, লা-মাযহাব, আধুনিকতা, অনুসারী, আঞ্চলিকতা, মনোভাব, নেতৃত্বলাভ, পশ্চাৎপদতা, ওহাবি, সালাফি, সুন্নি, পরিবার, দৈনন্দিন জীবন প্রভৃতি বিষয়ে বিশ্বের মুসলিম সম্প্রদায় ১৩৩৫টি ভিন্ন বিভাজনিক মতবাদ, মতভেদ ও রাজনীতিক চেতনায় বিভক্ত। একই ধর্মাবলম্বী হলেও একটি মতবাদ আর একটি মতবাদকে, একটি রাজনীতিক শক্তি আর একটি রাজনীতিক শক্তিকে সহ্য করতে পারে না, যেমন : শিয়া-সুন্নি, ওহাবি-সালাফি; মাজাহাব-লামাজাহাব— সৌদি আরবের কাছে ইসরাইল ছাড়া মধ্যপ্রাচের সবকটি রাষ্ট্র চোখের বালি, সবাই অনৈসলামিক।
পৃথিবীতে এক মাত্র ধর্ম ইসলাম, যার অনুসারীগণ ধর্মীয় প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে একটি অভিন্ন সম্প্রদায় গঠন করতে ব্যর্থ হয়েছে।এমন অনৈক্য ও শত্রুতামূলক হিংস্র বিভাজন পৃথিবীর আর কোনো ধর্মানুসারীতে নেই। ইউরোপ- আমেরিকায় গেলে মুসলিমদের বিভাজনটা আরও পরিষ্কার হয়। ওখানে হিন্দু বলতে কেবলই হিন্দু- পৃথিবীর যেখান থেকে আসুক না কেন; ইহুদি বলতে কেবলই ইহুদি, তা সে যে বর্ণেরই হোক না কেন; কিন্তু মুসলিম বলতে- আফ্রিকান মুসলিম, এশীয় মুসলিম, শ্বেত মুসলিম, কালো মুসলিম, ওহাবি মুসলিম, সুন্নি মুসলিম, ভারতীয় মুসলিম, শিয়া মুসলিম, আমেরিকান মুসলিম, অভিবাসী মুসলিম- – -।
প্রত্যেক ধর্মে ভিন্ন মতবাদ ও ভিন্ন মতভেদ আছে, মতবেদ বৈচিত্র্য আর জ্ঞানের শ্রীবৃদ্ধিস্বরূপ। ভিন্ন মত নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা – পর্যলোচনা জ্ঞানের ধারাকে বিকশিত ও পরিস্ফুট করে। কিন্তু ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্মে এক মতবাদ অন্য মতবাদকে ভুয়া বলে বাতিল করে দেয় না। ইসলামে এক মতবাদ আরেক মতবাদকে বাতিল করে দেয়- শুধু নিজের মতবাদকে সত্য মনে করে। তাদের মতবাদের উৎস, কারণ এবং প্রতিক্রিয়া এত সাধারণ এবং কার্যরণগতভাবে এত অহেতুক যে, তা গুণে শেষ করা যায় না, গবেষণা করেও বের করা কষ্টকর। মুসলিমদের কেউ দেশ নিয়ে, কেউ রাজনীতি নিয়ে, কেউ বিশ্বাস নিয়ে, কেউ মাজহাব নিয়ে, কেউ আবার লামাজাহাব নিয়ে, কেউ কোরআন নিয়ে, কেউ হাদিস নিয়ে, কেউ ভিন্ন মতাবলম্বীদের প্রতি আচরণ নিয়ে, কেউ ইতিহাস নিয়ে, কেউ নবি নিয়ে, কেউ আবার খাদ্য নিয়ে মতভেদ সৃষ্টি করে পরস্পরের প্রতি যুদ্ধংদেহী ঘৃণায় পরস্পরকে ধ্বংস করে দেওয়ার নৃশংস খেলায় মত্ত। শুধু তাই নয়, খেলার মতো সাধারণ বিষয়ে নিয়েও মতভেদ আছে। প্রত্যেক মতবাদের অনুসারীগণ নিজ নিজ মতবাদকেই কেবল সত্য ও সহি পন্থা হিসেবে গণ্য করে অন্য সব মতবাদ বাতিল করে দেওয়ার জেদে অনড় থাকে; একই ধর্মাবলম্বী হয়েও পরস্পরের সঙ্গে যুদ্ধ করে, রক্তপাত করে। বাংলাদেশে কয়টা ইসলামি দল দেখুন, এ থেকে বিবেচনা করুন কী হয়; গাজীপুরের ইজতেমার মাঠের চিত্রটি কল্পনা করুন।
সারা বিশ্ব বর্তমানে মুসলিমের গাণনিক সংখ্যা ১৬০ কোটি। একশ ষাট কোটি মুসলিম এক হাজার তিনশ পঁয়ত্রিশ ভাগে বিভক্ত। এ বিভাজন ভিন্ন ধর্মাবলম্বীর চেয়েও শক্তিশালী, অনেক ক্ষেত্রে প্রচণ্ড হানাহানির উদ্ভব ঘটায়, অবিশ্বাস তো আছেই।১৬০ কোটিকে ১৩৩৫ দিয়ে ভাগ করলে হয় ১১ লাখ ৯৮হাজার পাঁচশ এক। মানে বারো লাখেরও কম।এটি তাত্ত্বিক মস্তক সংখ্যা মাত্র।প্রাথমিকভাবে মনে হবে বিশ্বে মুসলিমের শক্তিগত সংখ্যা ১২ লাখ, তা কিন্তু সঠিক নয়, এটি আরো কম; দেখুন কীভাবে?
পৃথিবীতে একই মতবাদের ১২ লাখ মুসলিম কি কখনো একসঙ্গে ঐক্যবদ্ধ অভিন্ন দাবিতে একত্রিত হয়ে গর্জে উঠতে পেরেছে? এমন ইতিহাস নেই। শিয়াদের তো সৌদিরা মুসলিমই মনে করে না। আমরা সামান্য কারণে ভিন্ন মতবাদের মুসলিমদের কাফের ঘোষণার দাবিতে উচ্চকিত হই। গ্রহণ মানসিকতা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। যদি এই ১২ লাখকে নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছার চেষ্টা করা হয়, কোনো নেতৃত্ব স্থাপনের প্রয়াস নেওয়া হয় তাহলে মুসলিমরা নেতৃত্ব লাভের জন্য কমপক্ষে আরো দশ ভাগে ভাগ হয়ে পড়বে। শুরু হয়ে যাবে পরস্পর হানাহানি; বাংলাদেশে দেখুন- পাকিস্তানিরা কী করেছে; কী করেছে স্বাধীনতার পর?
জাতির জনককে পর্যন্ত রেহাই দেয়নি। এই লোভ তাদের ঐক্যকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে, দিচ্ছে এবং দেবে-যদি ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে না পারে।
১১,৯৮,৫০১(এগারো লাখ আটানব্বই হাজার পাঁচশ এক) সংখ্যাকে ১০ দিয়ে ভাগ করা হলে পাচ্ছি মাত্র ১,১৯,৮৫০। তার মানে পৃথিবীতে মুসলিমের কার্যকর শক্তির সর্বোচ্চ সাংখ্যিকমাত্রা মাত্র এক লাখ ঊনিশ হাজার আটশ পঞ্চাশ। এটি করাও কিন্তু সহজসাধ্য হবে না; তখন শুরু হবে আবার গোত্র ও পারিবারিক বিভাজন। এভাবে বিভাজিত হতে হতে প্রত্যেক মুসলিম একা হয়ে যাচ্ছে- শুধু ঐক্যের অভাবে, স্বার্থে জন্য- না বুঝে, বিবেচনাহীন কর্মের জন্য। হয়তো এভাবে একশ ষাট কোটি মুসলিম একশ ষাট কোটি মতভেদে বিভক্ত হয়ে যাবে।
পাঞ্জাব, সিন্ধ, খাইবার পাখতুনখোয়া, বালুচিস্তান, ফেডারেল শাসিত উপজাতীয় এলাকা, পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীর, গিলগিত-বালতিস্তান এবং ইসলামাবাদ রাজধানী অঞ্চল নিয়ে পাকিস্তান গঠিত।প্রতিটি অঞ্চলের সঙ্গে পাকিস্তান প্রশাসনের রয়েছে আর্থ-রাজনীতিক ও ধর্মীয় বিরোধ। ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দের আদমশুমারীর তথ্য অনুসারে, বর্তমানে পাকিস্তানের জনসংখ্যা প্রায় ২১ কোটি। বিভিন্ন প্রদেশে আর্থ-সামাজিক ও রাজনীতিক কারণে বিভাজন রয়েছে ২৩টি, পুরো পাকিস্তানে ধর্মীয় ও সম্প্রদায়গত বিভিাজন রয়েছে প্রায় ৬০০। সে হিসেবে পাকিস্তানের কার্যকর জনসাংখ্যিক শক্তি ৩,৩৭,০৭৮।
ভারত বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বাধিক জনবহুল রাষ্ট্র। ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের হিসাব অনুযায়ী ভারতের জনসংখ্যা প্রায় ১৩৫ কোটি।তন্মধ্যে মুসলিম প্রায় ১৯ কোটি এবং হিন্দু প্রায় ৮০ কোটি। ভারতেও বিশ্বের অন্যান্য স্থানের ন্যায় মুসলিমদের মধ্যে ধর্মীয় ও সম্প্রদায়গত ঐক্যের চেয়ে অনৈক্য অধিক পরিলক্ষিত। এক হিসেবে দেখা যায়, ভারতে মুসলিমদের আন্তঃসাম্প্রদায়িক বিভাজন কমপক্ষে ৫১৭। স্থানিক বিভাজন ধরলে এর পরিমাণ হয় ৯২১। অর্থাৎ ১৯ কোটি মুসলিমের পারিসংখ্যানিক ঐক্য মাত্র ২ লাখ ছয় হাজার ২৯৭।
আমরা এমন একটা ধর্মীয় সম্প্রদায়, যারা নিজেদের নবি মুহাম্মদ (দ.)-এর চার প্রিয় সাহাবির তিন জনকে খুন করে ফেলেছি- কেবল পার্থিব স্বার্থের লোভে। ব্যক্তিকে সমষ্টির উপর প্রাধান্য দিকে কোনো সম্প্রদায় টিকে থাকতে পারে না।
Total Page Visits: 620 - Today Page Visits: 3