ড. মোহাম্মদ আমীন, বিসিএস (প্রশাসন), ১০ম ব্যাচ
লিখিত পরীক্ষায় আপনি কত পেয়েছেন সেটা কোনো বিষয় নয়। অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, ভাইভাতে তুলনামূলকভাবে কম নম্বর পেয়েছে এমন অনেকে প্রতিযোগীও ভাইভার দুশ নম্বরে অধিক নম্বর প্রাপ্তির মাধ্যেম লিখিত পরীক্ষার কমতি পুষিয়ে নিয়ে বিসিএস ক্যাডার হয়েছেন।
আমজাদ হোসেন নামের এক প্রার্থী লিখিত পরীক্ষায় ছিলেন ক্রমের একদম শেষের একজন। কিন্তু ভাইভাতে তিনি এতই ভালো করেছেন যে, বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারে ১৭-তম হয়ে বিসিএস পাস করেছেন। তিনি বলেছেন, শেষের দিকে আমার অবস্থানই আমাকে প্রাণিত করে। এই প্রেরণা আমাকে আত্মবিশ্বাসী করে তোলে এবং এই আত্মবিশ্বাসই আমার সফলতার কারণ। শুরু করলাম, অধ্যয়ন।
কী অধ্যয়ন করেছেন?
নতুন কিছু নয়, প্রিলিমিনারি এবং লিখিত পরীক্ষায় যা পড়েছি কেবল সেগুলো এবং অতিরিক্ত হিসেবে সাম্প্রতিক বিষয় সম্পর্কে ধারণা পাওয়ার জন্য প্রতিদিন কয়েকটা পত্রিকা পাঠ করেছি, গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নোট করেছি। আর তেমন কিছু নয়। লিখিত পরীক্ষায় আমি লাস্ট হয়ছি, না- টেকার আশঙ্কাই ছিল বেশি, কিন্তু আমি ভেবেছি, আমি না টিকলে লাস্ট করা হয়েছে কেন? লাখ থেকে যখন হাজারে আসতে পেরেছি, তো হাজার থেকে শয়ে যেতে পারব না কেন? আমার সীমাবদ্ধতার শঙ্কাই, ভাইভাতে আমাকে ভালো করার উদ্দীপক হয়ে দাঁড়ায়।
কীভাবে?
আমি টিকব না ভেবে ভাইভাতে উপস্থিত হই, এবং কোনো দ্বিধা ছাড়া সর্বোচ্চ বিনয় রেখে প্রত্যেকটা প্রশ্নের উত্তর সাবলীলভাবে দিতে চেষ্টা করি। যে প্রশ্নের উত্তর আমি জানতাম না, সে প্রশ্নের না-উত্তরটাও সাবলীলভাবে দিয়েছি। এক পর্যায়ে ভাইভা বোর্ড আমার বন্ধু হয়ে গেল। মনে হচ্ছিল, আমি ভাইভা দিতে নয়, শ্রদ্ধাভাজন কয়েকজন লোকের সঙ্গে গল্প করতে এসেছি।
আপনাকে কী জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল?
যে প্রশ্নগুলো জিজ্ঞাসা করেছে, তা ওই পর্যায়ের সবাই পারবেন। এগুলোতে তেমন কারো সমস্যা হয় না, সমস্যা হয় ব্যক্তিগত আচরণ জানতে চেয়ে করা প্রশ্নে। বোর্ডের চেয়ারম্যান মহোদয় আমার কাজে জানতে চেয়েছিলেন, আমার ব্যক্তিগত দুর্বলতা কী?
এমন প্রশ্ন আমি আশা করিনি, কিন্তু আত্মবিশ্বাস আমাকে এতই আস্থাশীল করে তুলেছিল যে, আমি আমার দুর্বলতাগুলো বুঝতে পারতাম। আমি বলেছিলাম, আমার প্রথম দুর্বলতা অস্বাভাবিক চঞ্চলতা, কোনো কাজ শুরু করলে শেষ না-করা পর্যন্ত স্থির থাকতে পারি না। ফল ভুল হয়ে যায় অনেক, বিশেষ করে ভাইভা বোর্ডের মতো গুরত্বপূর্ণ সময়ে। কোথাও ধীর হয়ে বেশিক্ষণ বসাও আমার পক্ষে সম্ভব হয় না। তারপর জানতে চেয়েছিলেন, দ্বিতীয় দুর্বলতা কী? আমি বলেছি- অন্যকে সহজে এবং খুব সহজে বিশ্বাস করা। যার ফলে আমাকে বহুবার ঠকতে হয়েছে।
বোর্ড আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার সবল দিক কোনটি?
খুব সাবলীল গলায় বলেছিলাম, আত্মবিশ্বাস এবং আত্মবিশ্বাস কার্যকর করার জন্য অধ্যবসায়কে শ্রম আর একাগ্রতায় সমন্বিত করার অদম্য স্পৃহা।
চঞ্চল মন নিয়ে এমন স্থৈর্য ধরে রাখা কীভাবে সম্ভব?
সাংঘর্ষিকতার মাঝে টিকে থাকার মন্ত্রই আমার অধ্যবসায়, আমি বলেছিলাম।
আপনিও তো না-ও টিকতে পারেন?
জ্বি, শুধু আমি কেন স্যার, একশ জনের মধ্যে পঁচানব্বই জন টিকবে না।
এরপর জিজ্ঞাসা করলেন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্মগত পদবি কী?
আমি বলেছিলাম, বন্দোপাধ্যায়, তবে তিনি লিখতেন শর্ম্মা।
এরপর প্রশ্ন করেছিলেন, ধর্ম কী?
আমি বলেছিলা, পরিবার থেকে পাওয়া আচরণিক রীতি এবং ওই সূত্র থেকে পাওয়া আত্মগত বিশ্বাস। যা যে-কোনো কারণে পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে।
আপনার বস যদি, আপনাকে ঘুস খেতে বলে, দুনীতিবাজ হতে বলে তো আপনি কী করবেন?
জানি না, স্যার।
কেন?
এখন আমার যে মানসিকতা, তাকে সামনে রেখে বলতে পারি, আমি বসের আদেশ প্রত্যাখ্যান করব। তবে আগত সময়ে আমি কী করব, তা এখন বলতে পারব না। শিশু বেড়ে উঠে পরিবারের ঐতিহ্য নিয়ে, আমি বেড়ে উঠব আমার সিনিয়রদের আচরণের মধ্য দিয়ে। তারা যে পরিবেশ দেবে, সেই পরিবেশই আমাকে গড়ে তুলবে।
এরপর আর প্রশ্ন করা হয়নি। ভাইভাতে আত্মবিশ^াস তো লাগবেই, তার সঙ্গে প্রয়োজন স্বচ্ছতা, ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি এবং সুস্পষ্ট বক্তব্য। শুধু বিসিএস পরীক্ষার ভাইভার জন্য নয়, যে- কোনো পরীক্ষার ক্ষেত্রে এগুলো অনিবার্য।
ভাইভা পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের জন্য আপনার কোনো উপদেশ আছে?
জ্বি, স্যার। ভাইভা বোর্ডে ঢোকার পর হতে তাকে ভাইভা গ্রহণকারীগণের অনুগত একজন হিসেব নিজেকে উপস্থাপন করতে হবে। এই উপস্থাপনায় অহেতুক তোষামোদ যেমন থাকবে না, তেমনি থাকবে না নিজেকে অতিরিক্ত বড়ো করে তেলার বা সর্বজান্তার আচরণ। প্রার্থী যা তাই এবং ঠিক সেভাবে উপস্থাপিত হওয়া উচিত। এজন্য প্রয়োজন উদার দৃষ্টিভঙ্গি আর বুদ্ধিভিত্তিক প্রাণবন্ততা। তবে, প্রাণবন্ত রূপ যেন সঙের মতো হয়ে না যায় সে বিষয়টি সতর্কতার সঙ্গে খেয়াল রাখতে হবে। প্রার্থী যে ধর্মের অনুসারী হোন না কেন, দেখাতে হবে তিনি উদার। অনেকে বলেন, ভাইভা বোর্ডে হাসিমুখে থাকা উচিত, তবে আমি মনে করি, এই হাসি যেন কৃত্রিম হয়ে না যায়। এমন হলে পাস হওয়ার সম্ভাবনা সমূলে শেষ হয়ে যাবে।
আর কোনো উপদেশ?
ভাইভা বোর্ডে নার্ভাস হওয়া যাবে না। আপনি একটি প্রশ্নের উত্তর না-ও পারতে পারেন। এটা দোষের কিছু নয়। আপনার সবই পারতে হবে-এমন কোনো কথা নেই। পারলে ভালো। না পারলে মুখে হাসি রেখেই বলবেন, দুঃখিত, আমি এখন মনে করতে পারছি না বা আমার এখন মনে আসছে না।
অনেক পড়াশোনা এবং অনেক কিছু জানা থাকা সত্ত্বেও অনেক প্রার্থী অত্মবিশ্বাসের অভাবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাদ পড়ে যান। বিষয়টি দুর্ভাগ্যজনক হলেও এটিই হওয়া উচিত। যারা আত্মবিশ্বাস নেই, তিনি পরবর্তীকালেও আত্মবিশ্বাসহীনতায় ভুগতে পারেন। আবার অনেকে আত্মবিশ্বাস, জ্ঞান ও জানাশোনা নিয়েও অল্পতে ভয়াতুর হয়ে যাবার কারণে ভালো করতে পারেন না। এক্ষেত্রে আমাদের হোসেনের মতো স্থৈর্যের অধিকারী হতে হবে।
জ্ঞান দিয়ে সবকিছু হয়, কিন্তু শুধু জ্ঞান দিয়ে কিছুই হয় না; আপনার জ্ঞান যদি আপনার হস্তপদকে পরিচালিত না করে, হাতকে তাড়িত না-করে, চোখকে উন্মীলিত করার শক্তি না দেয় চলার-বলার, তাহলে ওই জ্ঞান গ্রন্থগত বিদ্যার মতো নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকবে। এজন্য অনেক কিছু জানা থাকা সত্ত্বেও কেবল আত্মবিশ্বাসের অভাবে অনেকে বাদ পড়ে যান। মৌখিক পরীক্ষার মতো বিশাল বাধাটা জয় করতে হলে আপনাকে হতে হবে সাহসী, ধীরস্থীর এবং আত্মবিশ্বাসী। ভাইভার জন্য আগে থেকে প্রস্তুতি নিতে থাকুন, তবে নতুন করে পড়ার প্রয়োজন নেই। আপনি জানেন বলেই এতদূর এসেছেন, যা জেনে এতদূর এসেছেন সেগুলোকে ঝালিয়ে নিন। প্রতিদিন দেশ-বিদেশে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো জেনে রাখুন। দেখবেন, ভাইভার চেয়ে সহজ আর কিছু নেই।
মাসুদ এখন বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারে সদস্য। আমার অধীনেও চাকুরি করেছেন কিছুদিন। তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, আমাজান কী?
মাসুদ বলেছিল, স্যার, এক আমাজান পৃথিবীর বৃহত্তম বন। আর এক আমাজান পৃথিবীর বৃহত্তম অনলাইন শপিং।
আপনি আমাজান বন সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছু বলুন।
প্রার্থী বলেছিল, আমাজান জঙ্গল দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন নদী বিধৌত অঞ্চলে অবস্থিত। ৭০ লাখ বর্গকিলোমিটার অববাহিকা পরিবেষ্টিত এই অরন্যের প্রায় ৫৫ লাখ বর্গ কিলোমিটার এলাকাটি মূলত আর্দ্র জলবায়ু দ্বারা প্রভাবিত। ৯ টি দেশ জুড়ে এই অরণ্য বিস্তৃ। আমাজন অরণ্য ৬০% রয়েছে ব্রাজিলে, ১৩% রয়েছে পেরুতে এবং বাকি অংশ রয়েছে কলম্বিয়া, ভেনেজুয়েলা, ইকুয়েডর, বলিভিয়া, গায়ানা, সুরিনাম এবং ফরাসি গায়ানা। পৃথিবী জুগে যে রেইনফরেস্ট তার অর্ধেক আমাজান। এই বনে প্রায় ৩৯০ বিলিয়ন বৃক্ষ রযেছে যেগুলো প্রায় ১৬০০০ প্রজাতিতে বিভক্ত।
তাকে আর কোনো প্রশ্ন করা হয়নি। বহিঃস্থ পরীক্ষক প্রশ্ন করতে চেয়েছিলেন। চেয়ারম্যান বলেছিলেন, লেট হিম গো।বিস্তারিত :বিসিএস প্রিলিমিনারি থেকে ভাইভা কৃতকার্য কৌশল