ড. মোহাম্মদ আমীন, বিসিএস(প্রশাসন), ১০ম ব্যাচ
গাছবাড়ীয়া সরকারি কলেজ থেকে এসএসসি পাস করার পর উচ্চাশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেল। ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছা আমার মোটেও ছিল না। শুনেছি, ডাক্তারি পড়তে হলে মগজের বিশ্লেষণ ক্ষমতা লাগে না, ধারণ ক্ষমতা থাকলেই হয়। মুখস্থটাই ডাক্তারি বিদ্যা অধ্যয়নের আসল জিনিস। আমাদের হরি ডাক্তার বলতেন, কোন রোগের কোন ওষুধ- এটি মুখস্থ রাখাই ডাক্তারি। আমি আবার মুখস্থ বিদ্যাটা পছন্দ করি না।
আমি ইঞ্জিনিয়ার হব, ছোটোবেলা থেকে সখ। ইঞ্জিনিয়ার হতে হলে মগজের ধারণ ক্ষমতা এবং বিশ্লেষণ প্রজ্ঞা দুটোই লাগে। ‘জীবনের লক্ষ্য’ রচনাতেও লিখেছি- আমি ইঞ্জিনিয়ার হতে চাই, শিক্ষক নয়। এইচএসসি পরীক্ষার ফল বের হবার কয়েকদিনের মধ্যে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তির বিজ্ঞপ্তি দিল। ভর্তির ফরম কিনলাম চট্টগ্রাম ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে। এটি এখন চট্টগ্রাম ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি, সংক্ষেপে চুয়েট।
অসিত স্যার ছিলেন গাছবাড়ীয়া সরকারি কলেজের ফিজিক্সের শিক্ষক। তবে প্রাইভেটে গণিত এবং রসায়নও পড়াতেন। বিজ্ঞান বিভাগের অনেকে তাঁর কাছে পড়তাম। তিনি ব্যাচ করে পড়াতেন, যেন আর একটা ছোটোখাটো কলেজ। বেশ ভালো বুঝাতে পারতেন। আমার কলজে জীবনের একমাত্র প্রিয় শিক্ষক তিনি। সনদ, মার্কশিট, ফটো, প্রশংসাপত্র ইত্যাদি সত্যায়িত করার জন্য অসিত স্যারের কাছে গেলাম। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের আবেদনের সঙ্গে এগুলো দিতে হয়। তিনি আমার সনদ আর মার্কশিট হাতে নিয়ে বললেন, কোথায় কোথায় আবেদন করছ?
চট্টগ্রাম ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে।
আর কোথাও করোনি?
না।
ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হওয়া সহজ কথা নয়, তোমার চেয়ে হাজারগুণ ভালো ছাত্রও টেকে না, নেবে একশ বিশ জন, পরীক্ষা দেবে দশ হাজার, যদি না টেকো?
আমি তো না-টেকার জন্য দিচ্ছি না, টেকার জন্য দিচ্ছি। টিকব না কেন, স্যার?
যদি না টেকো?
একশ বিশ জন নেবে। দশ জন নিলেও টিকে যাব, পাঁচ জন নিলেও।
অসিত স্যার আমার কথা শুনে বললেন, পাগলামির একটা সীমা আছে। হাতি ঘোড়া গেল তল, ছাগল বলে কত জল? এটি তোমার জন্য আত্মহত্যার সামিল হবে। অযথা একটা বছর নষ্ট করো না।
আমি অসিত স্যারকে আর কিছু না-বলে বের হয়ে এলাম।
কথাটি বলার কারণ আমার বাহাদুরির প্রকাশ নয়। নিম্ন দ্বিতীয় বিভাগে পাস করার ছেলে, কী বাহাদুরি দেখাবে? তখন আমি কত নির্বোধ ছিলাম তা জানানোর জন্যই কথাটি বলা। প্রত্যন্ত গ্রামেই কেটেছে এইচএসসি পর্যন্ত। গ্রামের খুদে গ-িতে থাকার কারণে মনটাও খুদে হয়ে গিয়েছিল। মনে হতো, আমার কলেজটাই একমাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বাইরের জগৎ সম্পর্কে ধারণা তেমন একটা নেওয়ার সুযোগ আমার হয়নি। বিশাল জগতের সীমাহীন প্রতিযোগিতামূলক জীবনের সঙ্গে কোনো পরিচয়ই আমার ছিল না। মনে এমন ধারণা বদ্ধমূল হয়ে বসেছিল, যেখানে পরীক্ষা দেব, সেখানেই পাশ করব। অথচ ছাত্র হিসেবে আমার ফল ছিল মধ্যমানের। আমি কখনও সানদিক ছাত্র ছিলাম না। প্রতিটি বিষয়ের পাঠ্যবই আগাগোড়া দাড়িকমা-সহ মনযোগ দিয়ে পড়তাম। কিন্তু পরীক্ষায় তেমন ভালো রেজাল্ট কখনো করতে পারিনি।
বন্ধুরা বলত, আগাগোঁড়া এমন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়লে ভালো জ্ঞান হয়, কিন্তু ভালো রেজাল্ট হয় না।
তারা বিভিন্ন বছরের প্রশ্নপত্র দেখে কয়েকটা প্রশ্ন ভালো করে পড়ে নিত। আমি তাদের কা- দেখে হাসতাম, কিন্তু পরীক্ষায় আমার রেজাল্ট দেখে তারা হাসত। তখনই বুঝেছি, লেখাপড়ার উদ্দেশ্য জ্ঞানার্জন নয়, সনদ অর্জন এবং সনদ অর্জনের উদ্দেশ্য হচ্ছে ভালো চাকুরি অর্জন। ভালো সনদ ভালো চাকুরির নিশ্চয়তা এবং ভালো চাকুরি ভালো অর্থ মানে ভালো ঘুসের নিশ্চয়তা।
তাদের কথা শুনেও আমি নিজেকে পাল্টাতে ব্যর্থ হই। বরং, মধ্যমানের ফল দিয়ে উচ্চমানের ফলিদের কুপোকাত করার পাগুলে বাসনায় মেতে উঠি। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে স্ট্যান্ড করা ছেলেদেরও ভর্তি হতে কষ্ট হয়, আমি তো মাত্র দ্বিতীয় বিভাগ।
সবাই বলল- আমার টেকার কোনো সম্ভাবনা ক্ষীণ।
তারপরও আমি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তির প্রস্তুতি শুরু করি। আর কোথাও আবেদন পর্যন্ত করিনি। তখন বর্তমান কালের মতো এত ভর্তি সহায়িকা ছিল না। চট্টগ্রাম ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি সহায়িকা নাম দিয়ে শিবির, চট্টগ্রাম ইঞ্জিনিয়ারি কলেজ শাখা একটা ছোটো বই বের করেছিল। সেটি কিনে নিয়ে পড়তে শুরু করি।
একদিন পথে অসিত স্যারের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। হাতে ছোটো বইটি। তিনি অনেক উপদেশ দিয়ে বললেন, কী পড়ছ?
এই ভর্তি সহায়িকাটা পড়ছি। চল্লিশ টাকা দিয়ে কিনেছি।
অসিত স্যার শ্লেষ ঢেলে বললেন, চল্লিশ টাকা দামের ভর্তি সহায়িকা পড়ে যদি ইঞ্জনিয়ার হওয়া যেত, তাহলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণও ইঞ্জিনিয়ার থাকত।
আমি কিছু বললাম না। যথাসময়ে পরীক্ষা দিলাম। ভর্তি পরীক্ষায় সম্মিলিতি মেধা তালিকায় আমি তৃতীয় হয়ে গেলাম। আমার তৃতীয় হওয়ার পেছনে সহায়ক পুস্তিকাটির অবদান ছিল না- এটি আমি বলব না। তবে শুধু ওই বইটি নয়, একই সঙ্গে এইচএসসি পর্যায়ের রসায়ন, গণিত এবং পদার্থ বিদ্যার বইগুলোও ভালোভাবে পড়েছি। অধিকন্তু, পূর্ব হতে বইগুলো আমার আগাগোড়া ভালোভাবে পড়া ছিল। ফলে, ভালো রেজাল্ট না-থাকা সত্ত্বেও আমি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ভর্তি পরীক্ষায় তৃতীয় স্থান অধিকার করি।
আমাদের কলেজ থেকে পনের জনের মতো প্রথম বিভাগে পাস করেছিল, তন্মধ্যে কেবল রফিক ও সামাদ ছাড়া আর কেউ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে টেকেনি। ভর্তি পরীক্ষায় রফিক ও সামাদের স্থান ছিল আমার অনেক নিচে। মধ্যমানের ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে সম্মিলিত মেধা তালিকায় তৃতীয় হয়ে পাস করার কারণ কী?
আত্মবিশ্বাস।
লক্ষ্যস্থলে পৌঁছতে হলে আত্মবিশ্বাসের বিকল্প নেই। আত্মবিশ্বাস প্রবল হলে সীমাবদ্ধতা চুরমার হয়ে যায়। শুধু আত্মবিশ্বাস থাকলে হবে না, থাকতে হবে অধ্যবসায় এবং শ্রমবিভূষিত নিষ্ঠা। আত্মবিশ্বাস নিয়ে যদি আমি বসে থাকতাম এবং প্রয়োজনীয় বিষয় অধ্যয়ন না-করতাম তাহলে আমার পক্ষে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ভর্তি পরীক্ষার মেধা তালিকায় তৃতীয় হওয়া দূরে থাক, অনেক স্ট্যান্ড করার ছাত্রের ন্যায় পাস করাও সম্ভব হতো না।
এবার দেখা যাক, আত্মবিশ্বাস কী?
আত্মবিশ্বাসের বৌদ্ধিক সংজ্ঞার্থ কী আমি জানি না, জানলেও সেদিকে আমি যাব না। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে বলছি- আত্মবিশ্বাস এমন একটি প্রত্যয়, যা মানুষের মনে এরূপ উদ্দীপনা সৃষ্টি করে যা তাকে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য আবশ্যক সকল উপায়, উপাদান আর সরঞ্জামে ভূষিত করে অদ্বিতীয় করে তুলে। ফলে ওই ব্যক্তি তার কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য এমনভাবে উদ্দীপ্ত হন, যাতে তিনি নিজেকে উৎসর্গিত করতেও কুণ্ঠিত হন না।
আমিও তা করেছিলাম। এইচএসসি পরীক্ষার দেওয়ার পর পরই অধ্যয়ন শুরু করি এবং কয়েক মাসের মধ্যে পদার্থ, রসায়ন আর গণিত বিষয়ে উচ্চমাধ্যমিক স্তরের জ্ঞান এমন পর্যায়ে গিয়েছিল যে, আমার টেকার নিশ্চয়তা আমার কাছেই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল। আসলে এটাই আত্মবিশ্বাস।
অতএব, প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় টেকার প্রধান হাতিয়ার হলো আত্মবিশ্বাস। প্রতিযোগিতায় টেকার প্রেরণা অর্জনের জন্য উপরে প্রদত্ত আত্মবিশ্বাসের সংজ্ঞার্থটি আবার দেখে নিন।
একটি দেহ যেমন বহুবিধ উপাদানে রচিত, তেমনি আত্মবিশ্বাসও অনেক বিষয় দিয়ে সজ্জিত। আত্মবিশ্বাসের সবচেয়ে সক্রিয় উপাদান হচ্ছে অধ্যবসায়। উভয়ের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। অধ্যবসায়হীন আত্মবিশ্বাস পা-বিহীন দৌড়বিদের মতো অর্থহীন। আত্মবিশ্বাস ততক্ষণ কার্যকর হয় না, যতক্ষণ শ্রম ও নিষ্ঠাপ্রসূত অধ্যবসায় সক্রিয় হয়। তাহলে, অধ্যবসায়ের কাজ কী?
অধ্যবসায়ের কাজ হচ্ছে, শ্রম ও নিষ্ঠাকে শাণিত করে ব্যক্তিকে লক্ষ্যস্থলে যাবার উপাদানে ভুষিত করার বিষয়ে সার্বিক সহায়তা বা প্রণোদনা প্রদান।
আপনার অ্যাকাডেমিক ফল যাই হোক না, কোথাও আবেদন করার নি¤œতম যোগ্যতা থাকলেও আপনি সবাইকে ডিঙিয়ে লক্ষ্যস্থলে পৌঁছতে পারবেন, যেমন আমি পৌঁছতে পেরেছিলাম; যদি আপনার আত্মবিশ্বাস আপনাকে লক্ষ্যস্থলে পৌঁছার জন্য প্রয়োজনীয় রসদ সংগ্রহে প্রাণিত করতে সক্ষম হয়।
এটি সক্রিয় হলে কোনো শক্তিই আপনাকে থামিয়ে রাখতে পারবে না, আপাতদৃষ্টিতে আপনি নিজেকে যতই পিছিয়ে আছেন বলে মনে করুন না কেন, আপনার রসদ আপনাকে সবার আগে নিয়ে যাবে। একাডেমিক ফল, চূড়ান্ত কোনো বিষয় নয়, যদি আপনার আত্মবিশ্বাস আপনাকে সক্রিয় করতে পারে। নইলে আমার মতো দ্বিতীয় শ্রেণি পাওয়া একজন ছাত্র কীভাবে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ভর্তি পরীক্ষায় তৃতীয় হই?
প্রসঙ্গত, ওই পরীক্ষায় শতাধিক প্রতিযোগী ছিল, যারা স্ট্যান্ড করেছে। যার আশি বা তার উপরে নম্বর পেত তাদের স্ট্যন্ড করেছে বলা হতো। এখনকার মতো তখন প্রতিবিষয়ে গড়ে আশি নাম্বার পাওয়া এত সহজ ছিল না। অবজেক্টিভ ছিল না, পুরো একশ নম্বরের পরীক্ষাই ছিল বর্ণনামূলক।
বিসিএস বা যে-কোনো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাই হোক না কেন, কৃতকার্য হতে হলে আপনাকে আত্মবিশ্বাসী হতে হবে। কোনোভাবেই নার্ভাস বা ভয়াতুর হওয়া যাবে না। এটাই হচ্ছে বিসিএস পরীক্ষা পাসের মূলমন্ত্র। বিস্তারিত : বিসিএস প্রিলিমিনারি থেকে ভাইভা কৃতকার্য কৌশল
———————–
এখানে বিসিএস পাসের জন্য সহায়ক কয়েকটি বইয়ের নাম দেওয়া হলো। বইগুলো সংগ্রহ করতে পারেন।
আলমগীর ০১৯১৫১-৬৫৩৩৩ (পুথিনিলয়)।
মাসুদুল হক : ০১৮১৭০৯১৩৮৬ (উত্তরণ)।
ওসমান গনি : ০১৮১৯-২১৯০২৪ (আগামী প্রকাশনী)।
তুষার প্রসূন : ০১৯৮০-১০৫৫৭৭ (অনুভব প্রকাশনী)।
মাকসুদ : ০১৭২৬-৯৫৬১০৪ (হাওলাদার প্রকাশনী)।
অথবা রকমারি ডট কম বা অন্যান্য অনলাইন গ্রুপ কিংবা নিকটস্থ লাইব্রেরিতে বলতে পারেন।