ড. মোহাম্মদ আমীন, বিসিএস (প্রশাসন), ১০ম ব্যাচ
প্রথিমে বলে রাখি অতি মেধাবীরা, সহজ কথায় প্রাতিষ্ঠানিক পরীক্ষায় ভালো সনদের অধিকারীরা বিসিএস পরীক্ষায় কম টেকে। এটি আমার ত্রিশ বছরের অভিজ্ঞতার একটি নির্যাস। সাধারণত মধ্যমানের মেধাবীরাই বিসিএস পরীক্ষায় বেশি টেকে। কারণ, তাদের মেধার আশি ভাগ থাকে পাঠ্য বইয়ে সীমাবদ্ধ, বাকি বিশ ভাগ থাকে বাইরে। অতএব, আপনি অতি মেধাবী না হলেও হতাশার কিছু নেই। বরং আপনি যে অতি মেধাবী নন, এটাই বিসিএস পরীক্ষায় টেকার অনুকূলে আপনার প্রথম সুবিধা হয়ে উঠতে পারে। আমার দীর্ঘ চাকুরি জীবনের এবং চাকুরিপূর্ব ছাত্রজীবনের অভিজ্ঞতা থেকে এমন ধারণাই বদ্ধমূল হয়েছে। বিকল্প থাকলেও তা উদাহরণযোগ্য নয়।(একনজরে বঙ্গবন্ধু বইটির প্রকাশক আগামী প্রকাশনী।)
আমি তখন চকরিয়ার উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট। কক্সবাজার জেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি)-এর অফিসসমূহের শূন্যপদে কয়েকজন তহশিলদার নিয়োগের দরখাস্ত আহ্বান করা হয়েছে। আমি নির্বাচন কমিটির একজন সদস্য, আমাকেও উত্তরপত্র যাচাই করতে হবে। হয়তো ভাইভা বোর্ডেও বসতে হবে।
আমার এক পেশকারের নাম ছিল জাবেদ। তার ছেলে খালেদ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থশাস্ত্রে অনার্স ও মাস্টার্স পাস করেছে। একদিন খালেদকে নিয়ে জাবেদ সাহেব আমার বাসায় এলেন এলেন। আসার পেছনে অন্যতম উদ্দেশ্য- খালেদের চাকুরি নিয়ে আলাপ এবং তহশিলদার পদে নিয়োগের অনুকূলে আমার সহায়তা কামনা।
পেশকারকে বললাম, ভালোভাবে পরীক্ষা দিলে অবশ্যই চাকুরি হয়ে যাবে।
আপনি যদি একটু ডিসি স্যারকে বলেন, পেশকার সাহেব প্রার্থনার ভঙ্গিতে অনুরোধ করলেন।
এখানে কোনো অনিয়ম হবে না। আশা করি আপনার ছেলের চাকুরি হয়ে যাবে। তবে আমি চাই না, আপনার ছেলে এই পদে চাকুরি করুক।
কেন স্যার?
সে অর্থনীতির ছাত্র। ভালো ফল; নিশ্চয় বিসিএস কিংবা অন্যকোনো ভালো চাকুরি পেয়ে যাবে। তাছাড়া আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোতেও প্রচুর চাহিদা অর্থশাস্ত্রের ছাত্রদের। বিশ্বব্যাংক, এডিবি এমনকি জাতিসংঘেও এদের প্রচুর চাহিদা।
খালেদ বলল, আংকেল, আমি কিছুদিন আগে দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা নিয়োগের পরীক্ষা দিয়ে পাস করতে পারিনি, বিসিএস কীভাবে পাস করব? আমার তো ভয় হয়, বিসিএস আমি পাস করতে পারব না।
তার প্রশ্ন আমাকে অতীতে নিয়ে গেল।
আমার জীবনেও এমন ঘটনা ঘটেছে একাধিক বার। আমি কিন্তু, খালেদের মতো এমন কখনও ভাবিনি। কেউ অপেক্ষাকৃত ছোটো পদের নিয়োগ পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়নি বলে বড়ো পরীক্ষায় কৃতকার্য হবে না, এমন ভাবা ঠিক নয়। পাইলট বিমান চালতে পারেন, রিকশা চালানোর কৌশল তার না-ও জানা থাকতে পারে। এজন্য পাইলটকে অদক্ষ ভাবা বোকামি।
আমি খালেদকে বললাম, বিসিএস পাস করতে পারবে না- এ ধারণাটা তোমার আত্মবিশ্বাসকে শেষ করে দিয়েছে। তোমার ভাবনা ঠিক নয়। বিসিএস পাস করার জন্য শুধু জানা যথেষ্ট নয়, তার চেয়ে বেশি প্রয়োজন আত্মবিশ্বাস; এবং কোনো অবস্থাতে ভেঙে না-পড়া।
খালেদ আমতা আমতা করে বলল, যদি পাস না করতে পারি?
আমি বললাম, শোনো, বিসিএস পরীক্ষা দেওয়ার আগের কথা। পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হলো- উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা নিয়োগের। এটি দ্বিতীয় শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তা মর্যাদার পদ, পিএসসির মাধ্যমে নিয়োগ করা হয়। দরখাস্ত দিলাম। লিখিত পরীক্ষায় পাস করলাম। ভাইভা হলো চট্টগ্রামের নাসিরাবাদ এলাকায় অবস্থিত পিএসসির আঞ্চলিক অফিসে। ভাইভা দেওয়ার কিছুদিন পর রেজাল্ট দিল। আমি পাস করিনি। আমার সহপাঠি জসীম টিকে গেল। সে জয়েন করল। আমার খুব কষ্ট হলো, কিন্তু আমি হতাশ হইনি।
জাবেদ সাহেব বললেন, তিনি এখন আমাদের উপজেলার পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা। খুব ভালো মানুষ।
এর কিছুদিন পর বিসিএস পরীক্ষার রেজাল্ট দিল। আমি আমার প্রথম পছন্দের ক্যাডার পেয়ে যাই। এটি ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দের কথা। আমার বন্ধু জসীম উদ্দিন এখনও পরিবার পরিকল্পনা অফিসার। আমার পঁচিশ ব্যাচ জুনিয়র অফিসারকেও তার স্যার ডাকতে হয়। দেখো জাবেদ, ছোটো ভাইভাতে অকৃতকার্য বড়ো ভাইভার কৃতকার্যে কোনো বাধা নয়, বরং ভালোভাবে নিতে পারলে ওই পরাজয়ই হয়ে উঠতে পারে তোমার বড়ো কিছু জয়ের হাতিয়ার। ছোটো ভাইভা বড়ো ভাইভা বলে কিছু নেই। আমি যদি ওইদিন পরিবারর পরিকল্পনা অফিসার পদের পরীক্ষায় পাস করতাম, তাহলে আজ ম্যাজিস্ট্রেট হতে পারতাম না। আমি কিন্ত মেধাবী নই। তোমার বাবার কাছে শুনেছি, তুমি এসএসসি এবং এইচএসসিতে জিপিএ ফাইভ পেয়েছ, আমাদের সময় এটাকে বলা হতো স্ট্যান্ড।
জি, আংকেল।
আমি জীবনে কখনও প্রথম বিভাগও পায়নি।
কিন্তু বিসিএস পরীক্ষায় অনেক মেধাবী অংশগ্রহণ করে, গোল্ডেন এ প্লাস। তাদের সঙ্গে পারব কীভাবে?
আমি বললাম, ভাইভাতে অতি মেধাবীর টিকে না অতএব, তুমি অতি মেধাবী নও বলে ভেঙে পড়াটাই হচ্ছে অকৃতকার্যের প্রধান কারণ। বিষয়টি পরিষ্কার করছি। আমাদের দেশে বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা সাধারণত অ্যাকাডেমিক স্বীকৃতি বিবেচনায় মেধাবী হয়। এইচএসসি পাস করার পর তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো বিষয় হিসেবে কথিত বিভাগে ভর্তি হয়ে যায়। এসব কথিত ভালো বিভাগের মধ্যে পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন, মাইক্রোবায়োলজি, বায়োলজি, পরিসংখ্যান, গণিত, ফলিত গণিত, ইংরেজি, আইন, কম্পিউটার বিজ্ঞান, ফার্মাসি, ট্রিপল ই প্রভৃতি অন্যতম। এসব বিষয়ে পড়লে অ্যাকাডেমিক অধ্যয়নে এত বেশি সময় ও শ্রম দিতে হয় যে, পাঠ্য বইয়ের বাইরে তাকানোর সুযোগ পর্যন্ত থাকে না। অথচ, বিসিএস পুরোটাই বলা যায় সাধারণ জ্ঞান নির্ভর। এজন্য তারা সাধারণত বিসিএস পরীক্ষায় টিকে না। আমাদের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮-তম ব্যাচে সায়েন্স ফ্যাকাল্টি থেকে বিসিএস পরীক্ষায় টিকেছে মাত্র ছয় জন, আর্টস ফ্যাকাল্টি থেকে টিকেছে ৩৯ জন। (বাংলা ভাষার মজা বইটির প্রকাশক পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.।)
আর একটি বিষয়, যারা খুব ভালো অ্যাকাডেমিক ফলের জন্য পড়েন, তারা পাঠ্য বই অধ্যয়নে এত বেশি সময় ও শ্রম দিয়ে থাকেন যে, সাধারণ জ্ঞানের দিকে চোখ দিতে পারেন না। ফলে তাদেরও বিসিএস পাস করা হয়ে উঠে না। কিন্তু সাধারণ ও মধ্যমানের ছাত্ররা কোনো একটা বিষয়ে ভর্তি হয়ে যায়। যাদের উদ্দেশ্য থাকে বিসিএস পাস, তারা অ্যাকাডেমিক অধ্যয়নে বেশি সময় দেয় না। বরং সাধারণ জ্ঞান অর্জনে অ্যাকাডেমিক অধ্যয়নের মতোই গুরুত্ব দিয়ে থাকে। ফলে তারা সহজে বিসিএস পাস করে যায়।
আমার জীবনের আর একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি।
সাত বছর আগের কথা।
আমার ঘনিষ্ট আত্মীয় অথৈ বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী ছিল। লেখাপড়ায় মধ্যম মনের, আমার চেয়ে একটু উপরে। এসএসসি পরীক্ষার পর আমি মানবিক বিভাগে ভর্তি হতে বললাম। তাই করল সে।এসএসসি এবং এইচএসসি কোনোটাতে এ প্লাস নেই। তার উদ্দেশ্য বিসিএস দিয়ে এএসপি হওয়া। ভারতীয় টেলিভিশনে এসিপির জৌলুস দেখে তার এ সিদ্ধান্ত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভালো বিভাগ বলে কথিত বিভাগে ভর্তির যোগ্য হয়ে গেল।
সে ভর্তি হতে চাইল ইংরেজি বিভাগে।
আমি বললাম, তুমি ইংরেজি পড়লে ভালো ফলের জন্য প্রতিদিন গড়ে কতক্ষণ সময় দিতে হবে?
পাঁচ ঘণ্টা, কারণ ইংরেজি আমার মাতৃভাষা নয়। অধিকন্তু, পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন বিষয় হচ্ছে সাহিত্য, তা ইংরেজি হোক বা বাংলা হোক।
আমি বললাম, তুমি যদি সাইকোলজি পড়ো কতক্ষণ সময় দিতে হবে?
দুই ঘণ্টা।
বাকি তিন ঘণ্টার দুই ঘণ্টা আমাকে দিতে পারবে?
কেন?
ওই দুই ঘণ্টা তুমি সাধারণ জ্ঞান পড়বে প্রতিদিন। তোমার মাস্টার্স পাস করতে কমপক্ষে পাঁচ বছর সময় লাগবে। তাহলে তুমি সাধারণ জ্ঞান অধ্যয়ন হবে তোমার ৩৬৫০ ঘণ্টা, প্রায় ১৫২ দিন। তাহলে পাঁচ বছর পর অনুষ্ঠেয় বিসিএস পরীক্ষার পুলিশ ক্যাডারে যদি একজনও টেকে তা হবে তুমি।
তাই করল অথৈ।
সে এখন পুলিশের এএসপি। তারা বন্ধুদের অনেকে এখনও বেকার, কেউ কেউ শিশু বিদ্যালয়ে খুব নি¤œ বেতনে চাকুরি করেন। সে অনার্স দিয়ে পুলিশের এএসপি হয়ে গেছে।
এক বছর পর শুনি, খালেদ বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারে টিকে যায়।
বিস্তারিত :বিসিএস প্রিলিমিনারি থেকে ভাইভা কৃতকার্য কৌশল