বাংলা গদ্যের আদি নিদর্শন
১৫৫৫ খ্রিষ্টাব্দে কুচবিহার-রাজ নরনারায়ণ অহোমরাজ চুকোম্ফা স্বর্গদেবকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। এ চিঠিটি বাংলা গদ্য সাহিত্যের আদি নিদর্শন। চিঠিখানার অংশবিশেষ হলো-“ লেখনং কার্যঞ্চ। এথা আমার কুশল। তোমার কুশল নিরন্তর বাঞ্ছা করি। তখন তোমার আমার সন্তোষ সম্পাদক পত্রাপত্রি গতায়াত হইলে উভয়ানুকুল প্রীতির বীজ অঙ্কুরিত হইতে রহে…।”
ষোড়শ শতকে সম্রাট আকবরের শাসনামলে ভগ্ন সংস্কৃত ভাষায় রচিত ‘সেক সুভোদয়া’ গ্রন্থের অন্তরালে বাংলা গদ্যের আভাষ ছিল বলে অনেকে মনে করে থাকেন। সপ্তদশ শতকের প্রথমভাগে কৃষ্ণদাস কবিরাজ রচিত “চৈতন্য-চরিতামৃত” গ্রন্থে গদ্যায়ত পদ্যের উৎকৃষ্ট সাহিত্য নিদর্শন পরিলক্ষিত। চণ্ডীদাস গদ্যপদ্যময় গীত রচনা করেছিলেন মর্মে প্রাচীন পুথি ‘পদকল্পতরু’তে বর্ণিত আছে। সপ্তদশ দশকের প্রথমার্ধে জনৈক সহজিয়া রচিত ‘চৈত্যপ্রাপ্তি’ নামক সাধনাতত্ত্ব গ্রন্থটিও গদ্যে লেখা হয়েছিল। একই সময়ে নেপালে রচিত ‘গোপীচাঁদের সন্ন্যাস’ নাটকের ভাষা সাধু বাংলা গদ্যের অনুসারী ছিল।
১৬৯৬ খ্রিষ্টাব্দে লিখিত একটি চুক্তিপত্রে ঢাকা অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষার বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। সপ্তদশ শতকের মধ্যভাগ হতে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত বৈষ্ণব সাধকদের দ্বারা গদ্যে-পদ্যে ‘কড়চা’ জাতীয় কিছু পুস্তিকা রচিত হয়েছিল। ১৭৪৯ খ্রিষ্টাব্দে মহারাজ নন্দকুমারের স্বাক্ষরযুক্ত চিঠিখানা সাধু ভাষায় লিখিত হয়েছিল। ১৭২৭ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা গদ্যে রচিত ‘মহারাজ বিক্রমাদিত্য চরিত্র’ নামক একটি গ্রন্থ ড. সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় ব্রিটিশ মিউজিয়াম হতে আবিষ্কার করেনে। এটি একটি গল্পগ্রন্থ, ভাষা বাংলা এবং গদ্যরূপে লিখিত। গ্রন্থটির গদ্য নমুনা উনিশ শতকের লেখক মৃতুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের গদ্যের ন্যায় ছিল।
সার্বিক বিবেচনায় ‘মহারাজ বিক্রমাদিত্য চরিত্র’ বাংলা সাহিত্যের গদ্যের আদি নিদর্শন বলে চিহ্নিত। অনেক গবেষক অষ্টাদশ শতকের শেষভাগে রচিত ‘শূণ্যপুরাণ’কে বাংলা গদ্যের আদিতম নির্দশন বলে দাবি করে থাকেন। ড. সুকুমার সেনের মতে, “এ সকল পুথি ও গদ্যপদ-বাচ্যের সন্ধান না করে গবেষকেরা শ্রীরামপুর মিশনের পাদ্রি এবং ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের শিক্ষকদের বাংলা সাহিত্যের গদ্যের প্রবর্তনকারী বলে আখ্যায়িত করে থাকেন।”
ড. মোহাম্মদ আমীন, বিসিএস (প্রশাসন), দশম ব্যাচ।