ড. মোহাম্মদ আমীন, বিসিএস (প্রশাসন), ১০ম ব্যাচ
অন্যান্য প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা চেয়ে বিসিএস পরীক্ষায় ভাইভা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দশ বারো মিনিটের মধ্যে ২০০ নম্বর প্রাপ্তি সহজ কথা নয়। ভাইভা পরীক্ষায় দুইশ নম্বরে দুইশ নম্বর পাওয়ার নজিরও রয়েছে প্রচুর। তাই বিসিএস পরীক্ষায় ক্যাডার পাওয়ার সম্ভাবনা বহুলাশে এক জন প্রার্থীর মৌখিক পরীক্ষার উপর নির্ভর করে। অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, আপনার বিসিএস পরীক্ষার সফলতা মৌখিক পরীক্ষায় নির্ধারণ করে দিতে পারে। মৌখিক পরীক্ষায় যিনি ভালো নাম্বার তুলতে পারেন, তিনি ভালো ক্যাডার পেয়ে যেতে পারেন। লিখিত পরীক্ষায় অনেক কম নাম্বার পাওয়া সত্ত্বেও অনেকে মৌখিক পরীক্ষায় ভালো নাম্বার পেয়ে প্রথম পছন্দের ক্যাডার পেয়ে গেছেন। তাই ভাইভাকে অতি গুরুত্বসহকারে গ্রহণ করা উচিত।
প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষায় পাস করার পর একজন প্রার্থী মৌখিক পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়ার সুযোগ পান। ওই দুটি পরীক্ষায় পাস করা মানে ইতোমধ্যে তিনি সাধারণ জ্ঞান বিষয়ে বেশ দক্ষতা অর্জন করেছেন- এটি বলা যায়। অতএব আগের পড়াগুলো ঝালাই করে নিলে এবং প্রত্যহ পত্রিকায় চোখ বুলিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো জিকেন খাতায় তুলে নিয়ে পড়তে থাকলে মৌখিক পরীক্ষার জন্য তেমন অতিরিক্ত না পড়লেও চলে।
একটু কুশলী হয়ে অধ্যয়ন করলে মৌখিক পরীক্ষায় নব্বইয়ের উপরে নাম্বার পাওয়া খুব সহজ। যে প্রার্থী মৌখিক পরীক্ষায় ভালো করে থাকেন, তিনি সহজে বোর্ডের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেন। তাই বোর্ড সে প্রার্থীকে অধিক যোগ্য বলে মনে করে অধিক নম্বর দিতে কুণ্ঠিত হয় না।
বিসিএস ভাইভা বোর্ডে সাধারণত তিনজন সদস্য থাকেন, যার মধ্যে একজন পিএসসি সদস্য আর বাকি দুজন এক্সটারনাল বা বহিঃস্থ অর্থাৎ পিএসসি কর্তৃক আমন্ত্রিত। ভাইভা গ্রহণের জন্য একাধিক বোর্ড করা হয়। পিএসসির প্রত্যেক সদস্য আলাদা আলাদা বোর্ডে থাকেন। ক্রমানুসারে বোর্ড পরীক্ষার্থীদের ভাইভার জন্য ডাকা হয়। একজন পরীক্ষার্থীকে যখন বোর্ড আহ্বান করে, তখন তার কিছু তথ্য-উপাত্ত বোর্ডের কাছে থাকে, যা প্রার্থী আবেদনের সময় জমা দিয়েছেন।
অল্প কিছু বিষয়ে সঠিকভাবে দক্ষতা অর্জন করতে পারলে আপনি ভাইভা পরীক্ষায় ভালো নম্বর নিশ্চিত করতে পারবেন। অনেকে মনে করেন, বেশিক্ষণ রাখলে তার পরীক্ষা ভালো হয় এবং এটি ভালো নাম্বার পাওয়ার লক্ষণ। বিষয়টি সর্বাংশে সত্য নয়। একটি বোর্ডকে প্রতিদিন অনেক পরীক্ষার্থীর সাক্ষাৎকার নিতে হয়। তাই প্রত্যেক পরীক্ষার্থীর সাক্ষাৎকার দীর্ঘ সময় ধরে নেওয়া বোর্ডের পক্ষে সম্ভব হয় না। যে পরীক্ষার্থীকে বোর্ড সাধারণ মানের মনে করে থাকে, সেই পরীক্ষার্থীকে সাধারণত কম সময় রাখে। তবে এটি সর্বাংশে সত্য না-ও হতে পারে। বোর্ড যদি কাউকে উপযুক্ত মনে করে, তবে তাকে ২৫-৩০ মিনিটও রেখে দেয়। ব্যতিক্রান্ত ক্ষেত্র ছাড়া এমন এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে। তবে, বোর্ডে ২৫-৩০ মিনিট রাখার পরও ভাইভা হয়নি এমন অনেক প্রমাণ আছে। আবার ৫-৭ মিনিটের ভাইভা দিয়েও ক্যাডার পাওয়ার নজির আছে। অতএব, কতক্ষণ রাখল সে চিন্তা না-করে কীভাবে উত্তর দিয়েছেন, তা ভাবুন এবং ভালোভাবে প্রস্তুতি নি।
অনেকে মনে করেন, মৌখিক পরীক্ষায় অনিয়ম হয়। অনিয়ম হোক বা না- হোক, আপনার কাজ তা দেখা নয়। আপনার কাজ হচ্ছে, ভালোভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ। কানকথায় বিশ্বাস করবেন না, তাহলে আপনার আত্মবিশ্বাস অন্যদিকে ধাবিত হবে। আপনিও অনিয়মের পথ খুঁজতে শুরু করবেন, তখন আপনার আম আর ছালা দুটোই চলে যাবে। এ বিষয়ে আমার জীবনের প্রথম ইন্টারভিউর এক অভিজ্ঞতার কথা শুনুন।
১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দের কথা, তখন আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সবেমাত্র অনার্স রেজাল্ট দিয়েছে। একদিন ইত্তেফাক পত্রিকায় একটা ‘নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি’ দেখলাম। বিজ্ঞপ্তিতে পুলিশের উপ-পরিদর্শক পদে নিয়োগ পেতে আগ্রহীদের কাছ থেকে দরখাস্ত আহ্বান করা হয়েছে। চাকুরি নিয়ে মাথাব্যথা নেই। তিনটা টিউশনি করে সাত হাজার টাকা পাই। তখন ওই পরিমাণ টাকা ক্যাডার অফিসারের বেতনের দ্বিগুণ। খাওয়া-দাওয়া হয় লজিং বাড়িতে। অতএব, চাকুরি দিয়ে আমি কী করব?
তবু কী মনে করে ওই দিনের পত্রিকাটা কিনে নিলাম। দুই কপি ছবি, সনদের ফোটো কপি, চারিত্রিক সনদপত্র প্রভৃতি দিয়ে আবেদন করতে হবে। ছবি দিতে হবে, কিন্তু তুলতে হবে না। বেশ কয়েকটা ছবি আছে। বিজ্ঞপ্তির নির্দেশনা অনুযায়ী একটা সাদা কাগজে দরখাস্ত লিখে ফেললাম। পরদিন দেড় টাকা দিয়ে একটি ভালো খাম কিনে দরখাস্তটা ভরলাম।
ওই দিন ছিল শুক্রবার।
তিন দিন পর চট্টগ্রাম শহরের নাসিরবাদ এলাকায় অবস্থিত ডিআইজি অফিসে গিয়ে আবেদনটা দিয়ে এলাম। কয়েক দিন পর চট্টগ্রাম পুলিশ লাইনসে দৈহিক পরীক্ষার তারিখ ধার্য হলো। পরীক্ষা দিতে গেলাম, দিলাম এবং উত্তীর্ণ হলাম।
ওই দিনই জানিয়ে দেওয়া হলো লিখিত পরীক্ষার তারিখ। পুলিশ লাইনস হাই স্কুলে আমার সিট পড়ল।
পরীক্ষা দিলাম। কয়েকদিন পর ফল প্রকাশিত হলো। আমি চট্টগ্রাম বিভাগে সম্মিলিত মেধা তালিকায় প্রথম হয়ে পাস করেছি। ভাইভা হলো। লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় আমি প্রথম হই। পুলিশের উনানব্বই ব্যাচে যারা ক্যাডেট সাব-ইন্সপেক্টর হয়েছেন, তারা সবাই আমাকে অভিনন্দন জানাল।
খুশি মনে বাসে উঠলাম। নাসিরাবাদ থেকে অক্সিজেন যাব। ওখানে এক মহান ব্যক্তির বাড়িতে আমি লজিং থাকি। বাসে সিট ছিল না, দাঁড়িয়ে আছি। আমার সামনে এক বয়স্ক লোকের পাশে আমার সমবয়সী এক যুবক কথা বলছেন। হতে পারে পিতা-পুত্র।
বয়স্ক লোক বললেন, তুমি টিকলে না কেন?
যুবক : যারা টিকেছে, সবাই তিন লাখ টাকা করে ঘুস দিয়েছে। টাকা দিতে পারলে আমিও টিকতাম। তুমি তো টাকা দাওনি, টিকব কীভাবে?
বয়স্ক লোক : অত টাকা কোথায় পেতাম।
যুবকের কথা শুনে আমি বিস্মিত হলাম। হিসাব করলাম, আমার কত টাকা খরচ হয়েছে, কাগজ, খাম, ছবি, সনদের ফটোকপি আর অক্সিজেন থেকে নাসিরাবাদ পর্যন্ত বাসে করে আসা-যাওয়া– সব মিলে মোট ত্রিশ টাকার বেশি হবে না। আমার ত্রিশ টাকায় যদি চাকুরি হয়ে যায়, তো যুবকের তিন লাখ টাকা লাগবে কেন? বুঝলাম, যুবকটি নিজের অযোগ্যতা ঢাকার জন্য বয়স্ক লোকটিকে মিথ্যা বলেছেন।
আমরা পরীক্ষা দিয়েছিলাম প্রায় পাঁচ হাজার, শেষ পর্যন্ত সম্ভবত একশ বিশ জনের চাকুরি হয়েছে। ওই একশ বিশ জন ছাড়া বাকি চার হাজার আটশ আশি জনই হয়তো এমন মিথ্যা বলছে। ফলে সুন্দর একটা নিয়োগও কলংকিত হয়ে যাচ্ছে। এতগুলো লোক যখন একটি মিথ্যা ছড়ায় তখন, সত্যটা চাপা পড়ে যায় মিথ্যায়।
অনেকে বলেন, ঘুস ছাড়া চাকুরি হয় না। কথাটি সর্বাংশে সত্য নয়। আমি গ্রাম থেকে উঠে এসেছি, শিক্ষক পিতার বড়ো ছেলে ছিলাম, ঘুস দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না। চারটি ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম। তিনটায় টিকেছি। আমি নিজেও অনেকগুলো প্রথম শ্রেনির পদে নিয়োগের ভাইভা নিয়েছি, বলব না, শতভাগ সততার সঙ্গে কাজ করতে পেরেছি; উনিশ-বিশ নানা কারণে করতে হয়; হয়ে যায়। পৃথিবীতে শতভাগ বিশুদ্ধ কিছু করা সম্ভব নয়, কখনও নয়। ছোটো চাকুরিগুলোয় তদ্বির বেশি চলে। প্রতিভা থাকলে কেউ তাকে থামিয়ে রাখতে পারে না। বোর্ডে যারা বসেন, তারা অমানুষ নন- প্রতিভা সবাইকে মোহিত করে। আর একটা কথা মনে রাখতে হবে, একটি পদের বিপরীতে হাজার হাজার প্রার্থী পরীক্ষা দিতে আসে। একজনই টিকে, বাকিরা নিজেদের অভিজ্ঞতা ঢাকতে বলে বেড়ায়- অবৈধ পন্থায় নিয়োগ হয়েছে। তবে, অবৈধ পন্থায় যে, নিয়োগ হয় না, তা বলছি না, কিন্তু তার হার এত কম যে, যা একজন মেধাবী প্রার্থীর কাছে সমুদ্রের খড়কুটোর মতো নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে বাধ্য। বিস্তারিত: বিসিএস প্রিলিমিনারি থেকে ভাইভা কৃতকার্য কৌশল