ড. মোহাম্মদ আমীন
৩. ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান : ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২০শে আগস্ট
মতিউর রহমান ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ অক্টোবর পুরান ঢাকার ১০৯, আগা সাদেক রোডের “মোবারক লজ”-এ জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২০শে আগস্ট শাহাদাত বরণ করেন। তার পৈতৃক নিবাস নরসিংদী জেলার রায়পুরা থানার রামনগর গ্রামে। যা এখন মতিনগর নামে পরিচিত। তাঁর বাবা মৌলভী আবদুস সামাদ, মা সৈয়দা মোবারকুন্নেসা খাতুন। মতিউর রহমান ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে যোগ দেন। তিনি সাত বীরশ্রেষ্ঠদের মধ্যে তৃতীয় শাহাদাত বরণকারী।
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে মতিউর রহমান সপরিবারে দুই মাসের ছুটিতে ঢাকা আসেন। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ শে এপ্রিল ঢাকা আসেন এবং ৯ই মে সপরিবারে করাচি ফিরে যান। কর্মস্থলে ফিরে গিয়ে জঙ্গি বিমান দখল করে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২০ শে অগাস্ট তিনি বিমান দখলের জন্য ২১ বছর বয়সী রাশেদ মিনহাজ নামের এক শিক্ষানবীশ পাইলটের উড্ডয়নের দিনকে স্থির করেন। কন্ট্রোল টাওয়ার ক্লিয়ারেন্সের পর মিনহাজ বিমান নিয়ে রানওয়েতে উড্ডয়নের প্রস্তুতি নিলে মতিউর রহমান সেফটি অফিসারের ক্ষমতাবলে বিমানটি থামাতে বলেন। মিনহাজ বিমানটি থামিয়ে ক্যানোপি (জঙ্গি বিমানের বৈমানিকদের বসার স্থানের উপরের স্বচ্ছ আবরন) খুলে বিমান থামানোর কারণ জানতে চান। এসময় মতিউর রহমান বিমানের ককপিটে চড়ে বসেন এবং রাশেদ মিনহাজকে ক্লোরোফর্ম দিয়ে অচেতন করে ফেলেন। জ্ঞান হারানোর আগেই রাশেদ মিনহাজ কন্ট্রোল রুমে জানাতে সক্ষম হন যে, তিনি বিমানটি-সহ হাইজ্যাক হয়েছে। চারটি জঙ্গি বিমান মতিউরের বিমানকে ধাওয়া করে। মৃত্যু আসন্ন জেনেও মতিউর রহমান বিমানটি নির্ধারিত সীমার নিচে চালিয়ে রাডারকে ফাঁকি দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে আসার চেষ্টা করেন।
প্রায় ভারতের সীমান্তে পৌঁছে যাওয়া অবস্থায় রাশেদ মিনহাজ জ্ঞান ফিরে পান এবং বিমানটির নিয়ন্ত্রণের জন্য মতিউরের সঙ্গে ধ্বস্তাধস্তি শুরু করেন। এক পর্যায়ে রাশেদ ইজেক্ট সুইচ চাপলে মতিউর বিমান থেকে ছিটকে পড়ে যান। বিমানটি কম উচ্চতায় উড্ডয়নের ফলে রাশেদ-সহ বিমানটি ভারতীয় সীমান্ত থেকে মাত্র ৩৫ মাইল দূরে থাট্টা এলাকায় বিধ্বস্ত হয়। তাঁর মৃতদেহ ঘটনাস্থল হতে প্রায় আধ মাইল দূরে পাওয়া যায়। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২০শে আগস্ট মতিউর রহমান এবং রাশেদ মিনহাজ নিজ নিজ দেশের জন্য শহিদ হন। বাংলাদেশ সরকার মতিউর রহমানকে তাঁর সাহসী ভূমিকার জন্য বীরশ্রেষ্ঠ উপাধিতে এবং পাকিস্তান সরকার রাশেদ মিনহাজকে সম্মানসূচক খেতাবে ভূষিত করে। প্রসঙ্গত একই ঘটনায় দুই বিপরীত ভূমিকার জন্য দুইজনকে তাদের দেশের সর্বোচ্চ সম্মানসূচক খেতাব প্রদানের এমন ঘটনা বিরল।
২০০৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৪শে জুন মতিউরের দেহাবশেষ পাকিস্তন থেকে দেশে এনে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় মিরপুর শহিদ বুদ্ধজীবী কবর স্থানে পুনঃসমাহিত করা হয়। পাকিস্তান সরকার মতিউর রহমানের মৃতদেহ করাচির মাসরুর বেসের চতুর্থ শ্রেণির কবরস্থানে সমাহিত করেছিল। মতিউর রহমানকে নিয়ে অগ্নিবলাকা নামের একটি ডকুড্রামা নির্মাণ করা হয় ২০০২ খ্রিষ্টাব্দে যেখানে রিয়াজ মতিউর রহমানের চরিত্রে এবং তারিন ওনার স্ত্রী মিলির চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। এছাড় তাঁর জীবনী নিয়ে ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দে অস্তিত্বে আমার দেশ চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়। বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর যশোর বিমান ঘাটি তাঁর নামে রাখা হয়। বিমান বাহিনী তাঁর নামে একটি ট্রফি চালু করেছে। বিমান প্রশিক্ষণে সেরা কৃতিত্ব প্রদর্শনকারীকে এটি প্রদান করা হয়।
১. বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্স নায়েক মুন্সি আব্দুর রউফ : প্রথম শহিদ বীরশ্রেষ্ঠ
২. বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল : দ্বিতীয় শহিদ বীরশ্রেষ্ঠ
স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ সমগ্র : লিংক
স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ : মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর ও সেক্টর কমান্ডার
স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ : অপারেশন জ্যাকপট
স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ : মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহিদ প্রথম প্রতিরোধকারী