বেলজিয়াম (Belgium) : ইতিহাস ও নামকরণ

কীভাবে হলো দেশের নাম (ইউরোপ)

ড. মোহাম্মদ আমীন

বেলজিয়াম (Belgium)

বেলজিয়াম উত্তর-পশ্চিম ইউরোপের একটি সাংবিধানিক রাজতন্ত্র। এখানকার ৯৭% লোক শহরে বাস করে। বেল্গায়ে বেলজিয়াদেমর আদি অধিবাসী ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৫৭ অব্দে জুলিয়াস সিজার এলাকাটি দখল করে নেন।বেলজিয়াম বর্তমানে ফ্রান্স এবং উত্তর ইউরোপের সমভূমির মধ্যস্থলে অবস্থিত। এর উত্তরে উত্তর সাগর। ইউরোপের গুরুত্বপূর্ণ ভৌগোলিক সঙ্গমস্থলে অবস্থিত হওয়ায়  দেশটি মধ্যযুগ থেকে একটি প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্র। বেলজিয়ামের ম্যাপ দেখলে মনে হবে, একজন লোক টুটি পরে প্রার্থনা করছে।

বেল্গায়ে নামের এক কেল্টীয় জাতির নাম থেকে বেলজিয়ান নামের উদ্ভব। তবে বেজিয়াম নামের উৎস সম্পর্কে একাধিক প্রবাদ প্রচলিত আছে। কথিত হয়, প্রাচীন প্রোটো সেলটিক বেল্গায়ে (Belgae) বা প্রোটো-ইন্দো-ইউরোপীয় শব্দাংশ ভেলঘা (bhelgh) থেকে বেলজিয়াম নামের উৎপত্তি। উভয় শব্দের অর্থ স্ফীত হওয়া বা প্রসারিত হওয়া বা শ্রীবৃদ্ধি ঘটা। ভূখণ্ডটির শ্রীবৃদ্ধির কারণে নাম হয় বেলজিয়াম। অন্য একটি প্রবাদ মতে, প্রটো-ইন্দো-ইউরোপীয়ান ভাষায় এর অর্থ উজ্জ্বল, দীপ্তিময়। বেলজিয়াম অর্থ  বেলগায়েদের দেশ বা Land of the Belgae। রোমান স্রামাজ্যের অধীন বিখ্যাত প্রদেশ গ্যালিয়া বেলজিকা (Gallia Belgica) নামের সঙ্গে বেলজিয়াম নামের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। শব্দটি ঐ প্রদেশের সেলটিক উপজাতিগণ ল্যাটিন হতে প্রাপ্ত হয়।

বেলজিয়ামের মোট আয়তন ৩০,৫২৮ বর্গকিলোমিটার বা ১১,৭৮৭ বর্গমাইল। তন্মধ্যে জলীয় ভাগের পরিমাণ ৬.৪%। ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের ১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত আদম শুমারি অনুযায়ী দেশটির মোট জনসংখ্যা ১,১২,৩৯,৭৫৫ এবং প্রতি বর্গকিলোমিটারে জনসংখ্যা ৩৬৩.৬ জন। আয়তন বিবেচনায় বেলজিয়াম পৃথিবীর ১৪০-তম বৃহত্তম দেশ কিন্তু মোট জনসংখ্যা বিবেচনায় এটি পৃথিবীর ৭৫-তম। অন্যদিকে জনসংখ্যার ঘনত্ব বিবেচনায় ২৩-তম জনবহুল দেশ। বেলজিয়ামের সরকারি ভাষা ডাস, ফরাসি ও জার্মান। সরকারিভাবে বেলজিয়ামের অধিবাসীদের বেলজিয়ান বলা হয়। ব্রাসেলস দেশটির রাজধানী ও বৃহত্তম শহর। ইউরোপীয় কমিশন, ন্যাটো এবং বিশ্ব শুল্ক সংস্থার সদর দপ্তর এবং ইউরোপীয় পার্লমেন্টের নতুন ভবন ব্রাসেল্স-এ অবস্থিত।১৮৩০ খ্রিষ্টাব্দে  বেলজিয়াম নেদারল্যান্ডস হতে স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং ১৮৩৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ এপ্রিল স্বাধীনতা স্বীকৃত হয়। ১৮৩১ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ জানুয়ারি বেলজিয়ামের বর্তমান পতাকা গ্রহণ করা হয়।

২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের হিসাবমতে, বেলজিয়ামের মোট জিডিপি (পিপিপি) ৪৯৪.৬২০ বিলিয়ন ইউএস ডলার এবং  সে হিসাবে মাথাপিছু আয় ৪৩,৬২৯ ইউএস ডলার। অন্যদিকে, জিডিপি (নমিনাল) ৪৫৮.৬৫১ বিলিয়ন ইউএস ডলার এবং মাথাপিছু আয় ৪০,৪৫৬ ইউএস ডলার। মাথাপিছু আয় বিবেচনায় বেলজিয়াম পৃথিবীর ১৭-তম ধনী রাষ্ট্র। মুদ্রার নাম ইউরো। ইউরো প্রবর্তনের পূর্বে বেলজিয়ামের মুদ্রার র নাম ছিল বেলজিয়াম ফ্রাঁ।

বেলজিয়াম প্রতিবছর ২ লাখ ২০ হাজার টন চকলেট উৎপাদন করে। তার মানে, প্রতি বেলজিয়ান প্রতিবছর ২২ কেজি  বা প্রতিদিন ৬১ গ্রাম চকলেট খায়। পৃথিবীর প্রধান ডায়মন্ড কেন্দ্র ও দ্বিতীয় বৃহত্তম পেট্রক্যামিকেল কেন্দ্র হচ্ছে বেলজিয়াম। পৃথিবীর ৯৯% কাঁচা হীরার সামগ্রিক ব্যবসায় সম্পাদিত হয় বেলজিয়ামে

ত্রয়োদশ শতকে ব্রালেস প্রতিষ্ঠা করা হয়। ব্রাসেলসে রয়েছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ৪০,০০০ কর্মচারী, ন্যাটের ৪০০০ কর্মচারী এবং বেলজিয়ামের ৩০০ স্থায়ী প্রতিনিধি। ইউরো নামের মুদ্রা ও ইউরো মুদ্রার চিহ্ন (€) দুটোই বেলজিয়ামের প্রস্তাবে সম্পন্ন হয়েছে। বেলজিয়ামে অবস্থিত ডারবি ((Durbuy)) পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট শহর। অধিবাসীর সংখ্যা মাত্র ৫০০। পৃথিবীর দীর্ঘতম ভবন বুরুজ দুবাই যে চারটি নির্মাণ কোম্পানি সম্পন্ন করেছেন তন্মধ্যে বেলজিয়ামের বেসিক্স (Besix) অন্যতম। বেলজিয়ামে ১৮ বছর পর্যন্ত অধ্যয়ন বাধ্যতামূলক। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে উচ্চতম বয়স। শিশু শিক্ষায় বেলজিয়াম পৃথিবীতে প্রথম। ব্রাসলসের রাজকীয় প্রসাদ লন্ডনের বাকিংহাম প্রসাদের চেয়ে ৫০% লম্বা। ফ্রেঞ্চ ফ্রাই কিন্তু ফ্রান্সে হয়নি। বেলজিয়ামে প্রথম হয়েছে। বেলজিয়ামে অবস্থানরত ফরাসিভাষী লোকজন এটি অধিক খেতেন এবং বিতরণ করতেন। তাই বেলজিয়ামে বানানো হলেও এর নাম হয় ফ্রেঞ্চ ফ্রাই।

ইলেকট্রনিক পাসপোর্ট, ইলেক্ট্রনিক আইডি কার্ড প্রভৃতি প্রথম বেলজিয়াম প্রচলন করে। দরিদ্রদের সাহায্যের জন্য সরকারিভাবে প্রথম লটারি ব্যবস্থা প্রচলন করে বেলজিয়াম। বেলজিয়ামকে রেস্টুরেন্টের শহর বলা যায়। এখানে এক বর্গকিলোমিটারের একটি স্থানে ১৩৮টি রেস্টুরেন্ট রয়েছে। ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দে  পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, পৃথিবীর ২৭টি বৃহৎ আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের মধ্যে সময়নিপুনতায় বেলজিয়াম প্রথম।

বেলজিয়ামের লোকেরাই সবচেয়ে উঁচু হারে কর প্রদান করে। যা মোট আয়ের ৪০%। বেলজিয়ামের জাতীয় আয়ের ৪৫.৬% আসে কর হতে। বেলজিয়ামের প্রত্যেক ভোটারকে বাধ্যতামূলকভাবে ভোট দিতে হয়। সড়ক ও রেলপথের ঘনত্ব বিবেচনায় বেলজিয়াম পৃথিবীতে প্রথম স্থানের অধিকারী। নেদারল্যান্ডস ও জাপানের পর প্রতি বর্গকিলোমিটারে গাড়ির সংখ্যা বিবেচনায় এটি পৃথিবীর তৃতীয় গাড়িবহুল দেশ। বিপুল আলোয় বেলজিয়াম এতই আলোকিত থাকে যে, এটাই পৃথিবীর একমাত্র মনুষ্যনির্মিত মহাসড়ক স্থাপনা, যা রাতের বেলা চাঁদ হতে দেখা যায়। বেলজিয়ামে অভিবাসীর সংখ্যা মোট জনগণের ১৫%। বেলজিয়ামে প্রায় ৮০০ প্রকার বিয়ার উৎপাদিত হয়। প্রতি বেলজিয়ান বছরে গড়ে ১৫০ লিটার বিয়ার পান করে। ৬৮ কিলোমিটার দীর্ঘ বেলজিয়ান কস্ট ট্রাম পৃথিবীর দীর্ঘতম ট্রামওয়ে। সম্রাট নেপোলিয়ন ওয়াটার লু-এর যুদ্ধ পরাস্ত হয়েছিল। এ ওয়াটুর লু ব্রাসেলসের দক্ষিণে অবস্থিত। ২৬,০০০ বর্গমিটার আয়তনের  ব্রাসেলসের ল কোর্ট (The Law Courts of Brussels) পৃথিবীর বৃহত্তম কোর্ট। এটি রোমের সেন্ট পিটার্স বাসিলিকার চেয়ে বড়। নেমো ৩৩ নামে একটি সুইমিং পুল রয়েছে ব্রাসলসে। এটি ৩৫ মিটার গভীর এবং স্কুবা ডুবুরিরা প্রশিক্ষণের জন্য এটি ব্যবহার করে। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে গভীর সুইমিং পুল। পৃথিবীর ৮০% বিলিয়ার্ড খেলোয়াড় বেলজিয়ামের তৈরি বল ব্যবহার করে।

বিখ্যাত ব্যক্তিদের নির্বাসন স্থান হিসাবেও ব্রাসেলস বিখ্যাত।  কার্লমাক্স ও ফ্রেডরিক এঙ্গেলস ১৮৪৫-১৮৪৮ খ্রিষ্টাব্দে  এখানে থেকে কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো রচনা করেন। নির্বাসিত ভিক্টর হুগোও এখানে নির্বাসিত ছিলেন। তিনি বিখ্যাত গ্রন্থ লা মিজারেবলস (Les Miserables ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দে ওয়াটার লু পরিদর্শনকালে সমাপ্ত করেন।

অস্ট্রিয়া (Austria) : ইতিহাস ও নামকরণ

আযারবাইজান (Azerbaijan) : ইতিহাস ও নামকরণ

বেলারুশ (Belarush) : ইতিহাস ও নামকরণ

সূত্র:  কীভাবে হলো দেশের নাম, ড. মোহাম্মদ আমীন, পুথিনিলয়, বাংলাবাজার, ঢাকা।

Language
error: Content is protected !!