ব্যাকরণ নয় অকারণ

ভূমিকা-১

অধ্যাপক চিত্তরঞ্জন তালুকদার

দীর্ঘদিন ফেসবুকে শুদ্ধ বানানচর্চা(শুবাচ) দেখতে দেখতে দু’কথা লিখলাম। বানান ভুল-শুদ্ধ সেটা সময়ের মানুষের জীবনাচার তাঁর কষ্ট-সাধ্য জীবন চলা থেকে আসে।

যেমন এক অতি আদি কালে মানুষ যে তন্তু বা বস্তু বা কাপড়টি দিয়ে শরীরের ঘামটা মোচতো বা মোচন করতো সেটাকে বলতো ‘গা মোছা’ অর্থ্যাৎ”এমন বলতো এই আমার ‘গা মোছা’টা দে তো। এভাবে ‘গা মোছা’ ‘গা মোছা’ বলতে বলতে এক সময় দু’টি শব্দ

এক হয়ে গিয়ে হয়ে গেছে ‘গামোছা’> ‘গামছা’। আজ এটা একটা শব্দ নয় শুধু, অতীব ব্যবহার্য প্রত্যহিক জীবনে একটি মূল্যবান কাপড়। যদিও গ্রামীণ প্রবাদ আছে–‘অমুকও একটা মানুষ, আর ‘গামছা’ও একটা কাপড়’! তবুও অস্বীকার করার উপায় নাই যে, ‘গামছা’র আছে অনেক বড় সাংস্কৃতিক ইতিহাস,অনেক গুরুত্বপূর্ণ ‘বস্তুমূল্য’।

এভাবে অর্থবোধক বর্ণসমষ্টিকেই আমরা ‘শব্দ’ নাম দিয়েছি। এখন ‘বানান’ বলতে যে ঝামেলার সৃষ্টি হয়েছে এখানে অনেকগুলি বিষয় যুক্ত।
‘শ’ ‘ষ’ ‘ণ’ আমাদের বর্ণ নয়, যথাক্রমে ইংরেজি, সংস্কৃত ভাষার বর্ণ। বলতে পারেন আমরা ব্যবহার করি কেন ? আমাদের ভাষায় অনেক ভাষার শব্দ আছে। তদ্রুপ সংস্কৃত-ইংরেজি শব্দও ‘বাংলা’য় প্রায় ত্রিশ ভাগ ঠাঁই দখল করে আছে তাই এ বিভ্রাটের সৃষ্টি হয়। এখন আপনার কী করতে হবে ? বিভিন্ন ভাষার শব্দকে চিনতে হবে। অর্ধ-শিক্ষিতরা কী করবে ? সে যেকোন বর্ণদিয়ে যেকোন বানানে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে। কেকনা, “মনের ভাব ব্যক্ত করার নামই ভাষা”। অধ্যাপক যতীন সরকার বলেন–“মানুষ যা মগজে চিন্তা করে তা-মুখে প্রকাশ করে তা-ই তার ভাষা” অর্থ্যাৎ ‘চিন্তার বহিঃপ্রকাশই ভাষা’। তাহলে আপনার উচিৎ সঠিক বানান বুঝে সঠিক অর্থটা বুঝে নেয়া। কেননা দায়টা আপনার, ভাষাটা আপনি শিক্ষিত হিসেবে আপনার দিক বিবেচনা করেই সৃষ্টি বা নিয়ম-কানুন তথা ব্যাকরণ তৈরি করেছেন। তাঁর আদিম অকৃত্রিম উচ্চারণ যন্ত্রগুলিকে বিবেচনায় রাখেন নাই। আজ অবশ্য আপনিও নানা কারণে নানা ভাবে বিপাকে।
শিক্ষার মৌলিক কিছু ত্রুটি’র কথা বলি—- যেমন শব্দ দু’ প্রকার= মৌলিক শব্দ আর সাধিত বা গঠনকরা শব্দ। যেমন এক ধরনের শব্দ আদি থেকে তৈরি হয়েই আছে এগুলিকে ভাঙ্গা যায় না, ভাঙ্গলে শব্দ থাকে না বর্ণ হয়ে যায়। যথা= ‘জল’, শব্দটিকে ভাঙ্গার ফলে ‘জ’ ‘ল’ দু’টি বর্ণ হয়ে অর্থ হারিয়ে ফেললো। তাই প্রথম কাজ হলো শিক্ষার্থীদেরকে এই মৌলিক শব্দগুলি শেখানো। এই মৌলিক শব্দের আগে-পরে অর্থহীন বর্ণ বা বর্ণসমষ্টি যা আগে যুক্ত হলে উপসর্গ, পরে যুক্ত হলে অনুসর্গ বলে। এগুলি স্বতন্ত্রভাবে অর্থহীন কিন্তু মৌলিক শব্দের সাথে যুক্ত হয়ে নতুন অর্থযুক্ত চমৎকার শব্দ গঠন করে। যেমন ‘উপ’ একটি উপসর্গ, ‘হার’ একটি শব্দমূলের সাথে যুক্ত হয়ে অসাধারণ অর্থবোধক,’উপহার’ একটি নতুন শব্দ গঠন করলো। তাই শিক্ষার্থীদের জল, পানি, অলস, কমল, সোনা, রূপা ইত্যাদি মৌলিক শব্দ শেখালেই শব্দ-গঠন প্রক্রিয়াটা শিখতে অনেক এগিয়ে যাবে। প্রক্রিয়াটা হবে এমন– + মৌলিক শব্দ + = নতুন শব্দ।
এ সহজ মৌলিক দিকটায় গুরুত্ব না দিয়েই শব্দ দুই প্রকার, পাঁচ প্রকার, তিন প্রকার ইত্যাদি নানা বিষয় একসাথে এনে সমস্ত কিছুকেএকসাথে গুলিয়ে ‘ব্যাকরণের নিয়মকে এমন অকারণে’র করে তোলা হয়েছে শিক্ষার্থীর তো মাথাই নষ্ট। এর ফল হয়েছে ‘বাংলা কঠিন ভাষা। ইংরেজি সহজ ভাষা কেননা এটা যে “বাবা” র ভাষা।
কিন্তু কোথায় কী বলবো, কাকে কী বলবো! জানেন ? যত বাঙলা ব্যাকরণ দেখছেন একটাও বাঙলা নয়, অন্য ব্যাকরণের আদলে লিখা কিছু নিয়ম মাত্র। আজও বাঙলা ব্যাকরণ লিখাই হয় নাই।
সংবিধানে যে ‘বাংলাদেশ’ বানানটা লিখা এটাও ভুল। তবে এই অর্থে শুদ্ধ যে, যেহেতু বানানটি রাষ্ট্রীয় রেজিস্ট্রেশন করা সুতরাং শুদ্ধ। তাহলে এটাও তো গোজামিল। শুদ্ধটা হওয়া উচিৎ ছিলো ‘বাঙলাদেশ’। যাক ভাই বয়সও শেষ বেশি পণ্ডিতি দেখিয়ে লাভ নেই, বুড়ো বয়সে অপমানিত হতে হবে, আঘাত আসবে। আরও যদি বলি–অর্থের কোনো অভিধান যে নেই এটা কিন্তু আপনি মানতে নারাজ ! বলবেন তাহলে যা আছে এগুলি ? এগুলিতে সব প্রতিশব্দ লিখা, অর্থ নয়। ‘
আরশি’অর্থ জানেন না,ডিকশোনারিতে দেখলেন’আয়না’। আয়না কি আরশি’র অর্থ ? না, তার আর একটি নাম। এই আয়না নয় শুধু বাংলার অনেক শব্দের অনেক প্রতিশব্দ আছে। আর এখানেই ‘বাংলা ভাষার মূল মাহাত্ম্য। যেটা অন্য ভাষার নেই। ইংরেজিতে‘চন্দ্র-সূর্যে’র একটি মাত্র নাম ‘Moon’ ‘Sun’ বাংলায় প্রত্যেকটির প্রায় অর্ধশত প্রতিশব্দ আছে। আপনারও অনেক নাম আছে, যেমন আপনি রাস্তায় হাটলে ‘পথিক,’ দোকানে গেলে ক্রেতা, শিক্ষায়তনে গেলে শিক্ষক বা শিক্ষার্থী, আত্মীয় বাড়িতে মেহমান, কোর্টে গেলে মোয়াক্কেল ইত্যাদি।
বাংলা বানানে সবচেয়ে অসুবিধা সৃষ্টকারি হলো ‘কার’ গুলি। হ্রস্ব’ই’ কার দীর্ঘ ‘ঈ’ কার এবং হ্রস্ব ‘উ’ কার, দীর্ঘ ‘ঊ’ কার বানানব্যাধ ঘটায়। অবশ্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে অর্থব্যাধও যে ঘটায় না তা বলা যাবে না। যেমন সূতা না সুতা শুদ্ধ ? শব্দটা এসেছে ‘সূত্র’ থেকে তাহলে মনে হবে ‘সূতা’ই ঠিক। না, ‘সূত্র’ তৎসম বা সংস্কৃত শব্দ ‘সূতা’ আর সূতা নয় তদ্ভব অর্থ্যাৎ বাংলা হয়ে শব্দটি হয়ে গেছে ‘সুতো’।
এখানে আর একটু আলোচনাও থেকে যায় এই ‘সূত্র’ কোন্ ‘সূত্র’ চিঠি’র স্মারক-সূত্র নাকি ‘তন্তু’ বলে যা বুঝায় সেটা ? আসলে দু’টো একই জিনিস। সুতো ধরে টানলে যেমন গোড়ায় পৌঁছা যায় কোনো ‘সূত্র’ ধরেই কোনোকিছু লিখা হয় বা উত্তর পাঠানো হয়। সুতরাং বস্তু একই দু’টি দুই কাজে ব্যবহার হয়েই দু’পথ, দু’অর্থ বুঝাচ্ছে। এখন ‘ই’ ‘ঈ’ কার নিয়ে একটু লিখছি, দু’টি উদারহণ দিই। প্রশ্ন হলো- বাড়ি, গাড়ি, শাড়ি, পাখি শব্দগুলিতে ‘ী’ কেন নয় ? এই জন্য নয় যে এগুলি স্ত্রীলিঙ্গ-বাচক শব্দ নয় । সুতরাং দীর্ঘ ‘ঈ’ কার হবে না, ‘ই’ কার হবে। এখন আপনি শিক্ষিত লোকও যদি না দেখেন বা অনুসরণ না করেন কী করার আছে বলুন ? ১৯৩৬ সনে উভয় বাংলায় ‘বাংলা একাডেমি’ নিয়ম করেছে কোন বিদেশি শব্দে ‘ঈ’ কার হবে না। আপনি বলছেন আগে যে লিখতো ? লিখতো না জেনে। আর শেষ ‘বর্ণ’টার শেষে কলম না তুলেই সহজে ‘কার’টা দেওয়া যায় তাই হাতের টানে লিখলে এটাই শুদ্ধ হয়ে যায় না।
অন্য একটি বিষয়ও পরিষ্কার হতে হবে, এখন আর বাজারে যেয়ে ‘মৎস্য’ কিনতে হয় না। মাছ কিনলেই গিন্নি খুশি, এজন্যই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন–এখন বাজারে যেয়ে ‘সহস্র’ টাকার নোট ভাঙ্গাতে যত কঠিন, হাজার টাকার নোট ভাঙ্গানো তত কষ্টকর নয়। এখানে মূল বিষয়টা হলো তৎসম আর তদ্ভব শব্দ চিহ্নিত করতে পারা। এই সূত্র, সহস্র, মৎস্য, গৃহিনী, মস্তক, হস্ত, পদ, স্কন্ধ, চন্দ্র, সূর্য এগুলি তৎসম অর্থ্যাৎ ‘তার সম’ মানে সংস্কৃত শব্দ এখন এগুলি তদ্ভব বা বাংলা হয়ে সুতা, হাজার, মাছ, গিন্নি, মাথা, হাত, পা, কাঁধ, চাঁদ, সুরুজ ব্যবহার হয়। সুতরাং তৎসম তদ্ভবের বেড়াজাল থেকে শিক্ষর্থীকে যত তাড়াতাড়ি মুক্তি দেওয়া যাবে, বাংলা আর কঠিন ভাষা থাকবে না।
একটি না জানা কথা অবশ্যই মেনে নিতে হবে শব্দ যেমন বাক্যে ব্যবহার হয় না, তেমনই শব্দের কোন নিজস্ব অর্থও নেই, ভাবপ্রকাশক যে অর্থে বাক্যে ব্যবহার করেন, শব্দ সে অর্থই ধারণ করে। ধরা যাক্ ‘বল’ একটি বানান দিয়ে শব্দ গঠন করা গেলো। এখন এটার অর্থ কী ? শরীরের বল না খেলার বল নাকি কথা বলা’র কথা বলা হয়েছে ? এখন এর কী সমাধান হতে পারে বলুন। তিনটিই এক শব্দ বা এক বানান হলেও ভিন্ন তিনটি অর্থ কিন্তু বুঝতে বা মানতে কষ্ট হয়। তিনটি বিষয়ই কেউ তার ভাব বুঝাতে এক সঙ্গেই ব্যক্ত করতে পারেন। যদি বাক্যটা লিখা হয়–‘বল, বল খেলতে বল লাগে’। তাহলে তো একই বানানে তিনটি বিষয় বা বস্তু বা তিনটি স্বতন্ত্র অর্থবোধক’শব্দ’ গঠন হয় অথচ বানান একই।
ফেসবুকে যাঁরা লিখেন সবাই শিক্ষিত এতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রশ্ন দেখে মনে হয় ব্যঙ্গ করছেন। উত্তর লিখে নিজেকে বোকা ঠাহরাতে ইচ্ছে করে না।
একজন লিখেছেন ‘আশা আর প্রত্যাশা’র মধ্যে পার্থক্য কী ? দু’টিই একার্থক শব্দ। আশাও যা প্রত্যাশাও তা-ই। আর বিশেষ বিশ্লেষণ করলে ‘আশা’ থেকেই প্রত্যাশার জন্ম। আশা মৌলিক শব্দ আর ‘প্রত্যাশা’ উপসর্গজাত শব্দ। কীভাবে ? আশা’র আগে ‘প্রতি’ একটি উপসর্গযুক্ত হয়ে শব্দটি হয়েছে ‘প্রত্যাশা’। যেমন= প্রতি+আশা=প্রত্যাশা। বলতে পারেন ‘আশা’ করে যা দিয়েছেন তার একটা প্রতিআশা করতেই পারেন এটাই ‘প্রত্যাশা’। এখন একজন এমএ পাশ লোক, হতে পারেন ‘বাঙলা’ পড়েন নাই, কিন্তু বাংলায় তো পড়েছেন অথচ এটা জানেন না বুঝতে হবে! নাকি উদরাম করছেন বুঝা উচিৎ।
একজন দর্শনের স্যার জিজ্ঞস করছেন–শব্দটি যদি ‘সহ্য’ই হবে বানানটা ‘হ’ দিয়ে কেন ? এখন বলুন এতটুকু বাংলা না পড়েই ‘দর্শন’র মত জীবনের সূত্র প্রদর্শক একটি সাবজেক্ট তিনি পড়েছেন বলতে হবে! যখন জানলেন শব্দটি ‘সহন’ থেকে প্রত্যয়ান্ত হয়ে এসেছে, চমকে গিয়ে বললেন কীভাবে ? সহন+’্য’= সহ্য। মনে হলো এটা যেন তিনি জীবনের প্রথম শুনলেন।
একজন আর জনকে জবাবে লিখছেন শব্দটা ‘শিখা’ হবে না, শুদ্ধ শব্দ শেখা। বলুন এ তর্কের শেষ কোথায় ! শিখা, শেখা একই শব্দ লিখা, লেখা একই শব্দ। ভাষার স্টাইলের ব্যতিক্রম মাত্র। যেমন ভাষায় প্রমথী, রাবীন্দ্রিক, বঙ্কিমী স্টাইল। অহেতুক তর্ক করার মানে বা শেষ পরিণতি এই যে, ‘বাংলা’ কঠিন ভাষা। শুরু যখন করেছি সময়ান্তরে আরও লিখবো আশা করছি।
ধন্যবাদ।
————————————————————————————————————————————

বিসিএস প্রিলি থেকে ভাইভা কৃতকার্য কৌশল

ড. মোহাম্মদ আমীনের লেখা বইয়ের তালিকা

All Link

বাংলা সাহিত্যবিষয়ক লিংক

বাংলাদেশ ও বাংলাদেশবিষয়ক সকল গুরুত্বপূর্ণ সাধারণজ্ঞান লিংক

বাংলা বানান কোথায় কী লিখবেন এবং কেন লিখবেন/১

বাংলা বানান কোথায় কী লিখবেন এবং কেন লিখবেন/২

বাংলা বানান কোথায় কী লিখবেন এবং কেন লিখবেন /৩

কীভাবে হলো দেশের নাম

শুদ্ধ বানান চর্চা লিংক/১

দৈনন্দিন বিজ্ঞান লিংক

শুদ্ধ বানান চর্চা লিংক/২

শুদ্ধ বানান চর্চা লিংক/৩

শুদ্ধ বানান চর্চা লিংক/৪

কীভাবে হলো দেশের নাম

সাধারণ জ্ঞান সমগ্র

সাধারণ জ্ঞান সমগ্র/১

সাধারণ জ্ঞান সমগ্র/২

বাংলাদেশের তারিখ

শুদ্ধ বানান চর্চা প্রমিত বাংলা বানান বিধি : বানান শেখার বই

Language
error: Content is protected !!