ব্যাঘ্র শব্দের অর্থ এবং পাণিনির মৃত্যু নিয়ে একটি রটনা
Subhasis Chirakalyan Patra
পাণিনির মৃত্য়ু সম্পর্কে একটি কাহিনী চালু আছে, যা আমি মোটেই মেনে নিতে পারিনি। বলা হয় যে, পাণিনি নাকি ব্যাঘ্র শব্দের মধ্যে ঘ্রাণশক্তির ব্যাপার থাকলেও মানুষকে খাওয়ার কথা নাই বলে ‘বাঘ মানুষকে খেতে পারে না’ ভেবে জঙ্গলে গিয়ে বাঘের হাতে বেঘোরে প্রাণ দিয়েছিলেন। এটি একটি প্রচলিত গল্পমাত্র। ভাষাবিদ দেবপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ে মহাশয়ের কাছে আমি এই গল্পটি শুনেছি। শ্রীবন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনা থেকে এই বিষয়ে কিছুটা উদ্ধৃতি দিচ্ছি :

”শুধুমাত্তর √ঘ্রা-এর উপর নির্ভর করিয়া তিনি ভাবিলেন যে ঘ্রাত হয় (to scent/smell out) বা বিশেষভাবে আঘ্রাত হয় সে কি অন্যকে খাদ্য হিসাবে বিবেচনা করিবে? সেকি অন্য কিছু করিতে পারে? এমত চিন্তা করিয়া পাণিনি, অন্যের বারণ সত্ত্বেও, নাকি শ্বাপদসংকুল অরণ্যে নির্ভয়ে প্রবেশ করিয়াছিলেন এবং ব্যাঘ্র দ্বারা হত হইয়াছিলেন। আমরা তাঁহার আত্মার চিরশান্তি কামনা করি।”
উপরি-উক্ত গল্পটি একেবারেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। আদৌ কোনো ব্যাকরণবিদ এইসব গালগল্পে বিশ্বাস করেন, না নাম ও নামীর সম্পর্কের বিরুদ্ধে প্রচার চালানোর উদ্দেশ্যে এই ধরণের গল্পের সৃষ্টি, সেটা ভাববার কথা। পাণিনি একজন ঐতিহাসিক ব্যক্তিবিশেষ কিনা, তা নিয়েই সন্দেহ আছে। হতে পারে পাণিনি একটি গোষ্ঠী, যারা ‘অষ্ট্যাধ্য়ায়ী’ গ্রন্থটি লিখেছিলেন। এই গ্রন্থটি মানবমনীষার বিস্ময়। এহেন পণ্ডিত (যদি তিনি ব্যক্তিবিশেষ হন) ব্যাঘ্র শব্দের মানে না বুঝে বেঘোরে বাঘের হাতে প্রাণ দিবেন তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। যারা শব্দের ভিতরে তার অর্থ আছে বলে বিশ্বাস করেন না, এই গল্পটি আমাদের ব্যাকরণ ও নিরুক্তের বিরুদ্ধে তাদের অপপ্রচারের কৌশল কিনা তা ভাববারও অবকাশ আছে। এই গল্পটি তুলে ধরে দেবপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো সম্মাননীয় ব্যক্তি যে ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থবিধিকে আক্রমণ করেছেন, তা আমার কাছে একটু বিস্ময়কর লাগে। অবাক লাগে যখন তিনি বলেন যে, শব্দের উৎপত্তিগত ও বুৎপত্তিগত অর্থ নির্ণয়ের চেষ্টা করাটা একটা বালখিল্য কাজ।
বাস্তবে নামের সঙ্গে নামীর সম্পর্ক আছে। সংস্কৃত ও বাংলা অভিধানগুলি শব্দের বুৎপত্তিগত ইতিহাস আজও ধরে রেখেছে। তার মানে এটা নয় যে ‘বাঘ’ শব্দটি উচ্চারণ করলে একটি জ্যান্ত বাঘ সশীরের হাজির হবে। সেটা এলে তাতে বক্তার বা শ্রোতার খুব একটা সুবিধা হত না, সে কথাটা বলে গেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (কারণটা সবাই বুঝবেন)। ব্যাঘ্র মানে ‘যা ব্যাপকরূপে আঘ্রাত হয়’। বাঘের গায়ে বোঁটকা গন্ধ থাকে, ওই গন্ধ শুনে কোথাও বাঘ এলে অন্য পশুরা ভয়ে পালায়। এই জন্যেই ব্যাঘ্রকে ব্যাঘ্র বলে। এখানে ব্যাঘ্র বলতে শুধু tiger-কে না বুঝে অনুরূপ গুণসম্পন্ন মানুষকেও বুঝতে পারেন, যারা এলে সবাই ভয়ে সচেতন হয়ে যায়। আর একটা উদাহরণ দিই। বাসমতি চাল মানে যে চাল সুবাসিত। এখানেও নামের মধ্যেই নামীর গন্ধ পাবেন। তবে ‘বাসমতি’ শব্দটি উচ্চারণ করলেই তার ভাত এসে আপনার পেট ভরিয়ে দেবে, এমন কথা ব্যাকরণ কখনও বলে না। গুড় বললেই মুখ মিষ্টি হয়ে যাবে বা হরি বললেই শঙ্খচক্রগদাপদ্মধারী নারায়ণ চলে আসবেন, এমন দাবী কেউ করে না। এই কথা মনে রেখে নাম ও নামীর সম্পর্ককে ব্যঙ্গ না করে বিষয়টা বুঝার এবং সেখান থেকে রস ও রসদ নিষ্কাশন করার চেষ্টা করাই উচিত।
এখন আর একটা বাংলা শব্দের মানে বলি। সেটা হল নামগন্ধ। নাম থেকেই নামীর গন্ধ পাওয়া যায়, সেটাই নামগন্ধ। এখানে গন্ধ বলতে আবার বাহ্য গন্ধ বলে ধরলে হবে না, বরং সম্পর্ক বুঝলে সুবিধা হবে। শব্দে-শব্দে, বর্ণে-বর্ণে গভীর গন্ধ (সম্পর্ক) আছে। নাম শব্দটি আসে ‘ম্না’ ধাতু থেকে। নামের মধ্যে নামীর একটি মিত রূপ থাকে। তাই নাম থেকে নামীর সম্বন্ধে কিছু তথ্য পাওয়া যেতে পারে। বস্তুর যাদৃচ্ছিক নামকরণ আজকের রীতি হয়েছে। প্রাচীন কালে এমন ছিল না। আগেকার দিনে একটা পাহাড় বা নদীর নামকরণের সময়েও মানুষ সেটা তার স্বভাব ও ক্রিয়ার কথা ভেবেচিন্তেই দিত। ব্যঙ্গাত্মক ও নেতিবাচক মনোভাব ছেড়ে একটু ইতিবাচক হয়ে নাম থেকে নামীর মিত রূপকে (নামগন্ধকে) বুঝতে হয়। যাদের সেই মানসিকতা ও শ্রদ্ধা নাই তাদের ব্যাকরণ বা নিরুক্ত বুঝানো দুরূহ কাজ। যাস্ক বলেন অমন লোককে বাদ দিয়েই চলতে হবে। শব্দার্থ যাদৃচ্ছিক বললে তা খুবই নেতিবাচক হয়। শব্দকে ভেঙে তার ভিতরের অর্থ এবং শব্দে-শব্দে সম্পর্ক বহুদূর বুঝা যায়, অন্তত যতটা যায় ততটাই লাভ। দুঃখের বিষয় আজকের বাঙালী অ্যাকাডেমিশিয়ানরা এসব ভুলে যাচ্ছেন। যারা নিজের গোঁ ধরে পড়ে থাকে তাদের কিছু বুঝানো প্রায় অসম্ভব হয়। ইদানীং অনেকে এমন হয়ে গেছেন। তাদের আরোগ্যের পথ আমি জানি না।
সূত্র: Subhasis Chirakalyan Patra, শুদ্ধ বানান চর্চা (শুবাচ)।
বাংলা বানান কোথায় কী লিখবেন এবং কেন লিখবেন/১
কি না বনাম কিনা এবং না কি বনাম নাকি
মত বনাম মতো : কোথায় কোনটি এবং কেন লিখবেন
ভূ ভূমি ভূগোল ভূতল ভূলোক কিন্তু ত্রিভুবন : ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ