ড. মোহাম্মদ আমীন, বিসিএস (প্রশাসন), ১০ম ব্যাচ
বিসিএস-সহ যে-কোনো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার ভাইভাতে কী প্রশ্ন করা হবে, তা কেউ বলতে পারেন না। আকাশে যত রঙ, ভাইভার তত ঢঙ। মহাশূন্যের নক্ষত্র আপনি গুণে হয়তো শেষ করে সংখ্যা বলতে পারবেন, কিন্তু ভাইভা বোর্ডে কত রকম প্রশ্ন হবে তা কখনও গুণে শেষ করা যাবে না। তারপরও প্রার্থীরা পাস করেন, প্রশ্ন পারেন এবং অনেক সময় কমন এসে যায়, কিন্তু কীভাবে?
কিছু কৌশল অবলম্বন করলে, আপনার ক্ষেত্রেও তেমন ঘটবে। অনেক প্রশ্ন কমন পড়ে যাবে এবং আপনি হাসিখুশি মন নিয়ে ভাইভা বোর্ড থেকে বের হয়ে আসতে পারবেন।
বিসিএস ভাইভা বোর্ডে প্রশ্নের ক্ষেত্রে সাধারণত প্রথম পছন্দটাকে ঘিরে আবর্তিত হয়। আপনার প্রথম পছন্দ কোনটি এবং কেন, তা ভালোভাবে অধ্যয়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে, যারা খুবই বিজ্ঞ এবং বহুমাত্রিক জ্ঞানের অধিকারী সেসব সদস্য কোত্থেকে প্রশ্ন করবেন, তা বলতে পারবেন না। অনেকে, প্রথম দিকের পছন্দের ধারেকাছেও যান না। অভিজ্ঞতায় দেখেছি, অনেকে, প্রশ্ন করে বসেন, এটি আপনার শেষ পছন্দ কেন? আপনি শিক্ষকতায় কেন গেলেন না? ইত্যাদি।
আশার কথা, আমাদের বিসিএস ভাইভা বোর্ডে বিশেষ করে, সাধারণ পদগুলোতে যেসব সদস্য প্রশ্ন করার জন্য আসেন এবং বসেন তাঁদের অধিকাংশের প্রজ্ঞা মধ্যমানের চেয়ে নি¤েœর। প্রশ্ন করার জন্য তারা নিজেরাও রাত জেগে প্রশ্নের উত্তর শিখেন, বা সন্তানদের কাছ থেকে জেনে নিয়ে আসেন। লিখে নিয়ে আসেন অনেকে। অনেকে আবার এমন প্রশ্ন করে বসেন, যা নিতান্তই হাস্যকর। একদিন আমার এক সহকর্মী বললেন, আমি যাচ্ছি ভাইভা নিতে। কয়েকটা প্রশ্ন বলো তো?
রবীন্দ্রনাথের প্রথম উপন্যাস কোনটি?
এ তো আমি জানি না।
১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের পর পূর্ব-বাংলার পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর কে ছিলেন?
চৌধুরী কামরুজ্জামান।
ঠিক হলো না।
আচ্ছা, পূর্ব-পাকিস্তান কখন জন্মগ্রহণ করে।
১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে।
না, ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে জন্ম নিয়েছিল পাকিস্তান, তখন আমাদের বাংলাদেশের নাম ছিল পূর্ব বাংলা। পূর্ব বাংলা নিয়ে ‘আমার পূর্ব বাংলা’ নামের একটা কবিতা আছে, কবিতাটির লেখক কে?
বলো, আমি লিখে নিচ্ছি।
সৈয়দ আলী আহসান। তিনি ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে মাগুরা জেলার আলোকদিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক ছিলেন।
এই প্রশ্নগুলোই করব, যথেষ্ট হয়েছে, আমার আর লাগবে না, বলেই সহকর্মী বিসিএস পরীক্ষার ভাইভা নিতে চলে গিয়েছিল।
সাধারণত প্রথম পছন্দকে ঘিরে আপনাকে করা প্রশ্নরাজি আবর্তিত হতে পারে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় পছন্দ নিয়েও প্রশ্ন করা হয়। তবে সাধারণত প্রথম পছন্দ থেকে বেশি প্রশ্ন করা হয়। এসব প্রত্যেকটি প্রশ্ন হয় বিষয়ভিত্তিক। ব্যাখ্যা ছাড়াও অধিকাংশ প্রশ্নের উত্তরে সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান এবং বিশ্বাসযোগ্য তথ্য দিতে হয়।
পররাষ্ট্র ক্যাডার প্রথম পছন্দ হিসেবে রেখেছে, এমন এক প্রার্থীকে জিজ্ঞাসা করা হলো : কলকাতায় অবস্থিত বাংলাদেশের হাইকমিশন অফিসে প্রথম বাংলাদেশের পতাকা প্রথম উত্তোলন করা হয়েছিল। এবং উত্তোলন করেছিলেন কে এম শিহাব উদ্দিন, তাঁর বাড়ি বাংলাদেশের কোন উপজেলায়?
প্রার্থী সঠিক উত্তর দিতে পারেননি। তার বাড়ি চট্টগ্রাম জেলার চন্দনাইশ উপজেলায়। দ্বিতীয় প্রশ্ন করা হয়েছিল, বাংলাদেশকে প্রথম ভারত না কি ভুটান স্বীকৃতি দিয়েছিল? প্রার্থী বলেছিলেন, ভারত, কিন্তু প্রশ্নকারী দ্বিমত পোষণ করে বলেছিলেন, ভুটান।
প্রশাসন ক্যাডার আপনার প্রথম পছন্দের হলে প্রশাসন-বিষয়ক প্রশ্ন বেশি করতে পারে, পুলিশ ক্যাডার প্রথম পছন্দ হলে, পুলিশবিষয়ক প্রশ্ন বেশি করা হয়- সাধারণত এমনটিই দেখা যায়। তবে এর কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। পুলিশ ক্যাডার প্রথম পছন্দের তালিকায় থাকলেও আপনাকে প্রশ্ন করা হতে পারে- শেষ পছন্দ পোস্টাল ক্যাডার থেকে। বোর্ড জানতে চাইতে পারে কেন আপনার এটি প্রথম পছন্দ এবং অন্যটি শেষ পছন্দ হলো।
পুলিশ ক্যাডার প্রথম পছন্দের, এমন এক প্রার্থীকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে দেশ ভাগের পর বর্তমান বাংলাদেশ পুলিশ-এর প্রথম নাম কী ছিল?
প্রাথী বলেছিল, ইস্ট বেঙ্গল পুলিশ।
দ্বিতীয় নাম?
ইস্ট পাকিস্তান পুলিশ।
কোন সনে এটি হয়েছিল?
জানি না।
স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্রে বর্ণিত তালিকা অনুযায়ী শহিদ পুলিশের সংখ্যা কত? এর উত্তর প্রার্থী দিতে পারেননি। স্মর্তব্য, প্রশ্নটির উত্তর ১২৬২ জন।
এ ধরনের প্রশ্ন করে ভাইভা বোর্ড আপনার পছন্দের ক্যাডারে সম্পর্কে আপনি কতটুকু জ্ঞাত, তা জানার প্রয়াস নেয়। এর মাধ্যমে বোর্ড এটাও জানতে চান আপনি ওই ক্যাডারের প্রতি কতটুকু আগ্রহী এবং আপনার পছন্দের সঙ্গে আগ্রহ আর অভিজ্ঞানের মিল আছে কি না।
প্রথম পছন্দ কাস্টমস এক্সসাইজ অ্যান্ড ভ্যাট ক্যাডার পছন্দের একজন প্রার্থীকে কাস্টমস-এর ইতিহাস এবং বাংলাদেশ কাস্টমস বিষয়ে কয়েকটি বিষয়ভিত্তিক প্রশ্ন করা হয়, কিন্তু তিনি প্রশ্নগুলোর উত্তর দিয়ে ভাইভা বোর্ডকে সন্তুষ্ট করতে পারেননি। এরপর ভাইভা বোর্ডের চেয়ারম্যান, তাকে প্রশ্ন করলেন, আপনি কাস্টমস ক্যাডার প্রথম পছন্দ দিলেন কেন?
প্রার্থী বলেছিলেন, এটি সরকারের রাজস্ব আয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠান। আমি সৎ থেকে সরকারের রাজস্ব আয়ে সহায়তা করব।
তখন চেয়ারম্যান সাহেব বললেন, আপনি তো কাস্টমস বিষয়ে কিছুই জানেন, যাকে জানেন না, তাকে কীভাবে ব্যবহার করবেন?
পররাষ্ট্র ক্যাডারের সদস্য হতে ইচ্ছুক প্রার্থীদের অ্যাম্বাসাডর, কনস্যুলার, হাইকমিশন, পররাষ্ট্র কার্যক্রম, বাংলাদেশের বৈদেশিক সম্পর্ক নীতি প্রভৃতি বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়।
একবার এরূপ এক প্রার্থীকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দেশের ভিতরে ও বাহিরে পররাষ্ট্র মান্ত্রিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে বাংলার প্রচলন করেছিলেন কে?
প্রার্থী প্রশ্নটির উত্তর দিতে পারেননি।
প্রসঙ্গত, এই প্রচলনটি করেছিলেন জনাব মোস্তফা ফারুক মোহাম্মদ।
এ ক্যাডার কেন প্রথম পছন্দ, বা ওই ক্যাডার কেন দ্বিতীয় পছন্দ- এটি একটি সাধারণ প্রশ্ন। প্রায় প্রত্যেক পরীক্ষার্থীকে প্রশ্নটি করতে দেখা যায়। আপনি যদি অধ্যয়ন করেন এবং সত্যিকার অর্থে ক্যাডারকে এবং ক্যাডারের কাজকে ভালোবেসে পছন্দক্রম নির্ধারণ করে থাকেন, তাহলে আপনার উত্তর অবশ্যই ভাইভা বোর্ডকে সন্তুষ্ট করতে সক্ষম হবে। আপনি যদি গ্রান্থিক হয়ে যান এবং কেবল নোট বা নেটভিত্তিক উত্তর দিয় ভাইভা বোর্ডকে সন্তুষ্ট করতে চেষ্টা করেন, তাহলে আপনার আশা পূরণ না-ও হতে পারে।
মনে রাখবেন, প্রত্যেকটি ক্যাডার অত্যাবশ্যক বলেই সরকার তার সৃষ্টি করেছেন। প্রতিটি ক্যাডার সরকার নামের একটি শরীরের এক একটি অনিবার্য অঙ্গ। অতএব প্রতিটি ক্যাডারই দেশের জন্য প্রয়োজনীয়।
কেন আপনি এ ক্যাডার পছন্দ করছেন?
এই কমন প্রশ্নের উত্তরে সবাই প্রায় একই রকমের উত্তর দেন।
একই ভঙ্গি প্রকাশ করে বলেন, দেশের জন্য নিঃস্বার্থভাবে কাজ করার জন্য এই ক্যাডারই আমার কাছে উপযুক্ত মনে হয়েছে।
এক প্রার্থীর নাম জাহেদ। তিনি ইংরেজি বিভাগের ছাত্র এবং খুব ভালো ফল। শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার সব যোগ্যতা কানায় কাানয় উপছে পড়ছে। তবে তিনি প্রথম পছন্দ দিয়েছেন পুলিশ ক্যাডার।
তাকে প্রশ্ন করা হলো, আপনি কেন পুলিশ ক্যাডার পছন্দের প্রথম তালিকা রাখলেন?
প্রাথী বললেন, স্যার, পুলিশ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আইনশৃঙ্খলা একটি দেশের উন্নতির মূল বিষয়। পুলিশ এর প্রধান রক্ষক। এমন কোনো কাজ নেই, যেখানে পুলিশ লাগে না। আমি মনে করি এই ক্যাডারে নিয়োগ পেলে আমি আমার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের মাধ্যমে দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারব। আত্মীয়স্বজনের কাছেও আমি অধিক গুরুত্ব পাব।
বোর্ড তাকে বললেন, শিক্ষা ক্যাডারে গেলে কি আপনি আপনার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের মাধ্যমে দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হবে না? আপনার উচিত ছিল, শিক্ষা ক্যাডার প্রথম পছন্দে থাকা; কিন্তু আপনি তা করেননি, উদ্দেশ্য কী?
এতক্ষণ তিনি বেশ স্বতঃস্ফুর্ত ছিলেন। এমন প্রশ্ন আর মন্তব্য শুনে খুব নার্ভাস হয়ে গেলেন প্রার্থী। তার চোখ দুটো অস্থিরভাবে নাচানাচি করছিল। আসলে, তার ভয়াতুর হওয়ার কোনো কারণ ছিল না। ভাইভা বোর্ড তাকে আগের প্রশ্নটি কেবল ভিন্নভাবে পুনরায় করেছেন। তিনি আগের উত্তর দিতে পারতেন কিংবা স্বাভাবিকভাবে নিয়ে আগের বিষয়ের সঙ্গে নতুন কিছু সংযোজন করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা না করে ভয়াতুর হয়ে গেলেন। তার ভয়াতুর হওয়ার কারণ ছিল একটাই, তিনি প্রশ্নটাকে ভিন্নভাবে নিয়েছেন, ভাইভা বোর্ড বুঝে গেলেন, চোরের মন পুলিশ পুলিশ। আসলে তাকে ভয়াতুর করে তোলার জন্যই প্রশ্নটা করা হয়েছিল।
কিন্তু ভাইভা বোর্ডে কখনও ভয়াতুর হওয়া যাবে না। যারা ভয়াতুর হয়ে পড়েন তাদের কাছে কৃতকার্যতাও ভয়াতুর হয়ে যায়। মুখে হাসি রাখতে হবে, মনে করতে হবে- ওই সময় ভয়াতুরতা নয়, বরং হাসিটাই আপনাকে উতরে নেবে। আপনার হাসি ও প্রাণবন্ত ভাব ভাইভা গ্রহণকারীদেরও প্রাণবন্ত এবং হাস্যময় রাখে। হাস্যময় ব্যক্তি কখনো রূঢ় হতে পারেন না, অন্যদিকে, হাসি যাদের মুখে লেখে থাকে তাদের কাছে ভয়াতুরতা ঘেষতে পারে না। ভয়াতুরতা, টেনশন ও উত্তেজনার জনক। মানুষ উত্তেজিত হলে চিন্তাশক্তি এবং মগজ তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। সে তখন হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে। জানা জিনিসও তখন অজানা হয়ে যায়।
অতএব, ভাইভা বোর্ডে ভয়াতুরতা থেকে দূরে থাকা গেলে অর্ধেক জয় অনিবার্য হয়ে যায়। বাকি পঞ্চাশ ভাগের পঁচিশ ভাগ হচ্ছে আপনার আত্মবিশ্বাস। তথ্যজ্ঞানের ভূমিকা মাত্র- ২৫ ভাগ। হাসি সংক্রামক রোগের মতো। আপনি হাস্যমুখে থাকলে ভাইভা গ্রহণকারীগণও হাস্যমুখে থাকতে বাধ্য হবেন, কারণ আপনার হাসি যদি আন্তরিক হয়, তাহলে তা, তাঁদের সংক্রমিত করবেই। অধিকন্তু, হাসিমুখে থাকলে টেনশন অনেক কমে যায়। এতে ভাইভার পরিবেশ আপনার অনুকূলে চলে আসবে। মনে হবে, আপনি ভাইভা দিতে নয়, আপনার কয়েকজন সিনিয়র সহকর্মীর সঙ্গে নানা বিষয়ে আলোচনা করছেন। তবে, আপনার হাসি যেন আন্তরিক হয়।
প্রশ্নের উত্তর দিতে পারুন বা না পারুন কিংবা যতই আপত্তিকর কিংবা বিব্রতকর প্রশ্ন করা হোক না কেন, ভাইভা বোর্ডে ভয়াতুর হওয়া যাবে না। আপনি প্রথম প্রশ্ন পারলেন না, দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন; দ্বিতীয় প্রশ্ন পারলেন না, তৃতীয় প্রশ্ন পারবেন না- এটি আপনাকে কে বলল? আপনি যদি দুটি প্রশ্নের উত্তর দিতে না-পারায় ভয়াতুর হয়ে যান, তাহলে আপনার মানসিক অবস্থা এমন হয়ে যেতে পারে যে, আপনি তৃতীয় উত্তর জানা থাকা সত্ত্বেও দিতে পারবেন না। এমন অবস্থা, অনেক মেধাবী প্রার্থীকেও প্রত্যাশা হতে দূরে ঠেলে দিতে পারে। আপনি কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলেন না। এটা দোষের কিছু নয়- সহ¯্র কোটি প্রশ্ন থেকে চার-পাঁচটি প্রশ্ন আপনি পারলেন না- এতে লজ্জিত হওয়ারই বা কী আছে?
সবই পারতে হবে-এমন ধারনা পাগলও করে না। পারলে ভালো, কিন্তু না পারলে স্বাভাবিক সাবলীলতায় বলবেন, স্যার, আমি দুঃিখত, বিষয়টা আমার জানা নেই, কিংবা এই মুহূর্তে মনে করতে পারছি না। এ বিষয়ে একটি অভিজ্ঞতার কথা জেনে রাখুন:
একজন অফিসার, ধরুন তার নাম হোসেন।
তিনি জীবনে হাজারের কাছাকাছি ভাইভা নিয়েছেন, নিয়েছেন বহিঃস্থ পরীক্ষক হিসেবে, নিয়েছেন পিএসসির সদস্য হিসেবে।
এক প্রার্থীর ডাক পড়ল হোসেন সাহেবের বোর্ডে। প্রার্থী সালাম দিয়ে দরজা খুলে অনুমতি নিয়ে ঢুকলেন। অনুমতিসাপেক্ষে চেয়ারে বসে ভাইভা বোর্ডের সদস্যগণের মুখের দিকে একবার করে তাকিয়ে প্রশ্নের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। দেখে মনে হলো সাবলীল, স্বাভাবিক, বিনয়ী, অনুগত এবং শোভন। প্রার্থীর প্রথম পছন্দ কাস্টমস।
হোসেন সাহেব তাকে পর পর পাঁচটি প্রশ্ন করলেন। একটি প্রশ্নের উত্তরও তিনি দিতে পারলেন না। পাঁচটি প্রশ্নের একটিরও উত্তর দিতে না পারার পরও প্রার্থী ঠিক আগমনী সাবলীলতায় প্রাণবন্ত থেকে গেলেন। আরও দুটি প্রশ্ন করলেন হোসেন সাহেব। পারলেন না। এবার বিরক্ত হয়ে হোসেন সাহেব বললেন, আমি সাতটি প্রশ্ন করলাম, আপনি একটি উত্তরও দিতে পারলেন না। লজ্জা হয় না?
এই প্রশ্ন শুনে প্রার্থী স্মিত হেসে বললেন, স্যার, সাধারণ জ্ঞানে প্রশ্নের সংখ্যা পৃথিবীর বালিকণার সংখ্যার চেয়েও বেশি হতে পারে। আমি মাত্র সাতটি প্রশ্ন পারিনি, তাও আপনার মতো বিজ্ঞ লোকের কাছে। আমি বরং মুগ্ধ এবং কৃতজ্ঞ।
কেন? হোসেন সাহেব বিস্মিত হয়ে জানতে চাইলেন।
আপনার প্রশ্ন এবং আমার অজ্ঞতা, প্রকৃতপক্ষে আমার কাছে শেখার প্রেরণা।
তুমি কিন্তু একটি প্রশ্নের উত্তর দিয়েই দিয়েছ।
একজন সদস্য বললেন, তোমাকে ওভার স্মার্ট মনে হচ্ছে?
স্যার, মাতাপিতার নিকট তার সন্তানের চেয়ে শ্রেষ্ঠ আর কে হতে পারে? হোসেন সাহেব বললেন, আপনি তেলবাজ। আামাদের খুশি করার জন্য এসব বলে যাচ্ছেন। আসলে আপনি কিছুই জানেন না।
প্রার্থীর মানসিক শক্তি, স্থৈর্য, অভিযোজন সক্ষমতা প্রভৃতি যাচাইয়ের জন্য প্রশ্নটি করা হয়েছিল। এসব প্রশ্নে অনেক পরীক্ষার্থী অধৈর্য হয়ে পড়েন, কিন্তু এই প্রার্থী আগের মতো স্বাভাবিক ও হাসিমুখে বিনীত ভঙ্গিতে বললেন, আপনাদের সন্তুষ্টির মধ্যে আমার উদ্দেশ্যপূরণ নিহিত। যাই বলুন, আমি আপনার অনুগত।
একটি প্রশ্নের উত্তরও এই প্রাথী দিতে পারেননি, তবু তিনি দুইশ নাম্বারে ১৯৬ পেয়েছিলেন।
এই প্রার্থীর নাম ছিল মাহবুব।
তিনি কাস্টমস ক্যাডারই পেয়েছিলেন। কিন্তু জয়েন করেননি, এখন লন্ডনের সবচেয়ে প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। একটি অনুবাদ প্রতিষ্ঠান খুলেছেন। অনুবাদ থেকে যা আয় হয়, তা দিয়ে বর্তমান বাংলাদেশের দশ সচিবকে খাওয়াতে পারবেন। তকে প্রশ্ন করেছিলাম, কেন জয়েন করোনি? আমার প্রশ্নের উত্তরে বলেছিল, রাস্তায় পান বিক্রি করলেও মাসে ত্রিশ হাজার টাকা পাওয়া যায়। আমি তো ঘুস খাব না।
ভয়াতুর হওয়ার অনেকগুলো কারণ আছে। তন্মধ্যে একটি হচ্ছে, ইংরেজিতে উত্তর দিতে অক্ষমতা। প্রশ্নের উত্তর জানা আছে, কিন্তু ভাষাজ্ঞানের সীমাবদ্ধতার জন্য উত্তর দিতে পারছেন না। কোনো একটি বিষয়ে বোর্ড আপনাকে ইংরেজিতে বক্তব্য দিতে বলতে পারেন, কিংবা প্রশ্ন করতে পারেন ইংরেজি। ইংরেজিতে প্রশ্ন করলে আপনাকে ইংরেজিতে উত্তর দিতে হবে, নইলে বিষয়টাকে অশোভন বা অযোগ্যতা ধরা হয়। তবে যদি বলা হয়, রিসাইট এ বেঙ্গলি পয়েম, সেক্ষত্রে আপনি ইংরেজিতে উত্তর দিতে পারবেন না। যারা বিসিএস পরীক্ষায় ভাইভা পর্যন্ত যান- তাঁদের সবাই কমবেশি ইংরেজি জানেন, কিন্তু অনভ্যাসের কারণে বলতে পারেন না। ফলে জানা প্রশ্নের উত্তরও ভীষণ অজানা হয়ে যায়। এটি অনেক বড়ো দুর্বলত। এই দুর্বলতা কাটানোর জন্য বন্ধুদের সঙ্গে, বাসায় পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ইংরেজি বলার অভ্যাস করতে পারেন। ইংরেজি পত্রিকা পাঠ, ইংরেজি সংবাদ শ্রবণ, বিবিসি-সহ বিদেশি নামিদামি ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ইংরেজ খবর শুনেও ইংরেজি ভাষার অনভ্যস্ততা বহুলাংশে দূর করা যায়।
মাঝে মাঝে বিখ্যাত কোনো কবির লেখা কবিতা হতে কয়েক লাইন আবৃত্তি করার জন্য বলতে পারেন। এটি সাধারণত না পারার কথা নয়, কারণ এমন কবিতার নাম বলা হয়, যা প্রায় সবার জানা থাকে। যদিও না-ও পারেন তাতেও কিছু যায় আসে না। কারণ সবাই পারলে যে আপনাকে পারতে হবে, তা ঠিক নয়, যৌক্তিকও নয়। প্রত্যেক ব্যক্তি একক এবং অদ্বিতীয় সত্তা।
উপরের বর্ণনা মন দিয়ে পড়–ন এবং সেভাবে প্রস্তুতি নিন। আপনি যেহেতু ভাইভা পর্যন্ত আসতে সক্ষম হয়েছেন, সেহেতু আপনি কম জানেন এমন বলা ঠিক হবে না। সাধারণ জ্ঞানে আপনি দক্ষ বলেই এতদূর আসতে পেরেছেন। ভাইভার জন্য আরও জোর দিয়ে পড়ুন, তবে এজন্য হাতিঘোড়া মারা কিছু করতে হবে না। প্রতিদিন ঘটে যাওয়া দেশ বিদেশের গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলো সংগ্রহ করে জিকেন খাতায় তুলুন আর মনের মধ্যে ভালোভাবে গেঁথে রাখুন। বাজারে সাধারণ জ্ঞানের বিভিন্ন বই পাওয়া যায়। সেগুলো পড়লে মোটামুটি ধারণা পেয়ে যাবেন। আবারও বলছি, ক্যাডার ও আপনার অধীত বিষয়গুলো ভালোভাবে পড়ে আসবেন। বিস্তারিত: বিসিএস প্রিলিমিনারি থেকে ভাইভা কৃতকার্য কৌশল