ড. মোহাম্মদ আমীন, বিসিএস (প্রশাসন), ১০ম ব্যাচ
ভাইভা বোর্ডে কেবল প্রাথীরা নার্ভাস বা ভয়াতুর হয়ে পড়েন তাই না, অনেক সময় ভাইভা বোর্ডের সদস্যবর্গও প্রার্থীর কাছে ভয়াতুর হয়ে পড়েন, যদি সেরকম তুখোর প্রার্থী হন। অভিজ্ঞতায় আমি এমন অনেক প্রার্থী দেখেছি, যারা ঝানু ঝানু জ্ঞানী ব্যক্তি নিয়ে গঠিত ভাইভা বোর্ডকেও মেধা, বিচক্ষণতা এবং প্রাজ্ঞিক আত্মবিশ্বাস দিয়ে কাঁপিয়ে দিয়েছেন। এবার এমন একটা ভাইভা বোর্ডের অভিজ্ঞতার কথা বলছি। আমি ছিলাম ওই ভাইভা বোর্ডের সদস্য সচিব। যারা ‘স্যমন্তক’ পড়েছেন তারা এ বিষয়ে কিছুটা হলেও অবহিত আছেন। (স্যমন্তক বইটি পড়লে বুঝবেন ইন্টারভিউতে সাহস ও প্রতিভাকে কীভাবে বিকশিত করা যায়।বইটির প্রকাশক পুথিনিলয়।)
জাতিসংঘের একটি অঙ্গ সংস্থার চাকুরির ভাইভা। নিয়োগ-পাওয়া প্রার্থীকে কিছুদিন বাংলাদেশে চাকুরি করতে হবে, তারপর দেশের বাইরে। সার্বিক বিবেচনায় বিসিএস-এর চেয়ে শতগুণ মর্যাদাকর চাকুরি। ক্যাবিনেট ডিভিশনের সচিব (ভারপ্রাপ্ত) আবদুল হামিদ খান ভাইভা বোর্ডের চেয়ারম্যান, সদস্য হচ্ছেন কবীর চৌধুরী এবং বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলাম। এটাতে পাস করতে পারলে ইফাদ (ওঋঅউ) এর প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে চাকুরি পাওয়া যাবে। বেতন সপ্তাহে অর্ধ লাখের উপরে। সনটা ১৯৯১, অতএব বুঝতে পারেন, চাকুরিটা কত গুরুত্বপূর্ণ। তখন বিসিএস (ক্যাডার) পদে চাকুরির প্রারম্ভিক বেতন ছিল মাত্র পাঁচ হাজার টাকা।
এই ভাইভা বোর্ডের সদস্যগণ পিএসসির চেয়ারম্যানেরও সিনিয়র এবং যে- কোনো বিবেচনায় পিএসসির যে-কোনো ভাইভা বোডের সদস্যবর্গের চেয়ে বিজ্ঞ, ঋদ্ধ, প্রাজ্ঞ, অভিজ্ঞ এবং চৌকশ।
যথাসময়ে সাক্ষাৎকার শুরু হয়ে গেল। লিখিত পরীক্ষায় প্রথম হয়েছেন একটি মেয়ে। খান সাহেবের নির্দেশমতে তাকে সবার শেষে ডাকা হলো। তিনি একজন মেয়ে, তদুপরি লিখিত পরীক্ষায় প্রথম হয়েছেন। তারপরও শেষে ডাকার কারণ ছিল, কারণটা হলো – তার মনোবল ভেঙে দেওয়া এবং ক্ষুধার্ত বানিয়ে ইন্টারভিউতে ভয়াতুর আর অস্থির করে তোলা।
রুমে ঢুকে মেয়েটি ভাইভা বোর্ডের সবাইকে বিনীতভাবে শ্রদ্ধা জানিয়ে কোনো অনুমতি ব্যতিরেকে সামনে রাখা নির্ধারিত চেয়ারটিতে বসে পড়ল। প্রসঙ্গত, ওখানে ওই একটি চেয়ারই কেবল খালি রাখা হয়েছে।
খান স্যার গম্ভীর গলায় কিছুটা শ্লেষ ঢেলে রাগতস্বরে বললেন, অনুমতি না-নিয়ে বেয়াদবের মতো বসে পড়লে যে? আদব কায়দা শিখোনি?
অন্য কেউ হলে ভীষণ মুষড়ে যেতেন; ভয়াতুর হয়ে অস্থিরতা শুরু করে দিতেন। মেয়েটি মুষড়ে পড়লেন না। বরং এমনভাবে উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন যেন, খান স্যার বোকার মতো প্রশ্ন করে ফেলেছেন। ঢোকার সময় মেয়েটির মুখ ছিল কিছুটা আড়ষ্ট, হয়তো ক্ষুধার তাড়না। খান স্যারের ধমক-ভরা প্রশ্ন মেয়েটির মুখে অচিরাৎ আলো ছিটিয়ে দিল যেন, প্রাণবন্ত হয়ে গেলেন তিনি। ধমক নয়, যেন এক থালা বিরিয়ানি দিয়েছেন।
বিনীত গলায় মেয়েটি বলল, স্যার, আমি, ভাইভা বোর্ডে কখন কোথায় কীভাবে কী করতে হবে তা ভালোভাবে জানি। আপনাদের কর্মপরিধি, ঋদ্ধতা, কাজের স্বরূপ প্রভৃতিও আমার জানা আছে। আপনাদের মতো বিজ্ঞ লোকের কাছে জ্ঞানের বিকল্প নেই।
মানে? খান স্যার প্রশ্ন করলেন।
: আমি সাক্ষাৎপ্রার্থীর বসার জন্য নির্ধারিত চেয়ারে আমি বসেছি। এখানে কেবল একটা চেয়ারই খালি রাখা হয়েছে। পূর্ব-নির্ধারিত বিষয় নিয়েও যদি একজন সচিবের নির্দেশনার অপেক্ষায় সময়ক্ষেপণ করি তাহলে এত কষ্ট করে যাচাই-বাছাইয়ের প্রয়োজন কী? যেকোনো একজনকে নিয়োগ দিয়ে দিলেই তো হয়!
খান স্যারের মুখ দেখে বুঝলাম তিনি মেয়েটির জবাবে খুশি হয়েছেন। যদিও এমন অকপট জবাব আশা করেননি। স্যারের মুখে একটা মলিন আভা এসে আবার মিলিয়ে গেল। আমি শঙ্কায় ভুগছি, মেয়েটাকে না বের করে দেন।
সিগারেটে জোরে একটা টান দিয়ে চায়ের কাপে ঠোঁট লাগিয়ে খান স্যার বললেন, চাকরিতে নিয়োগ পেলেও কী তুমি নির্দেশ ছাড়া কাজ শুরু করবে?
: আমার কর্মপরিধির বিবরণ বিজ্ঞপ্তিতে আছে। তাছাড়া, কর্মবিধিমালাও রয়েছে। এ অবস্থায়, আসলেই নির্দেশনা দরকার কি না, ভালোভাবে জেনে কাজ শুরু করব। সংশয় হলে পরামর্শ নেব। প্রতিকাজে অনুমতি গ্রহণ অযোগ্যতার পরিচায়ক।
কবীর চৌধুরী প্রশ্ন করলেন, তুমি কে?
: আমি একজন মানুষ, একজন মেয়ে, একজন বাংলাদেশি, একজন ছাত্রী, একজন চাকরিপ্রার্থী, একজন সাক্ষাৎকারপ্রার্থী, একজন …।
: রাইট আনসার, অসংখ্য উত্তর হতে পারে। আমি জানতে চাইছি নাম কী?
: আমার নাম রাকখসনা, ডাক নাম রাকু।
তোমার প্রিয় ব্যক্তি? খান স্যার জানতে চাইলেন।
: আমি।
: তুমি ছাড়া?
: আপনি।
তোষামোদ করার জায়গা পাও না! খান স্যারের ভারিক্কি গলার মধ্যেও চিড় ধরার আভাস পাওয়া গেল। তিনি মনে মনে হয়তো ঘাবড়ে গিয়েছেন।
রাকু বলল, প্রথম উত্তরটাই আমাকে বের করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। আপনি তেমন করেননি, দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরও আমি প্যাঁচিয়ে ফেলেছি, অবশ্য সুনির্দিষ্ট উত্তর দেওয়ারও কোনো সুযোগ ছিল না। তারপরও আপনি রাগ করেননি। আমি আমার মতো করে উত্তর দিয়েছি। এত মর্যাদাসম্পন্ন চেয়ারে থেকেও আপনার বিবেচনাবোধ আমাকে মুগ্ধ করেছে।
: আর একজন প্রিয় ব্যক্তির নাম বলো।
: রঞ্জন স্যার। তিনি আমার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। আমাকে কন্যার মতো ¯েœহ করতেন। তাঁর বাসায় থেকেই আমি পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছি।
: একটা প্রাণী শুধু পিছন দিকে সাঁতার দিতে পারে, তার নাম কী?
: চিংড়ি।
: চিংড়ি পেছনে হাঁটায় অভ্যস্ত হলো কেন?
: চিংড়ির মল থাকে মাথায়, তাই।
: চার আর চার যোগ করার পর উত্তর এলো ষোলো, কেন?
: ভুল হয়েছে তাই।
: ওয়াটার লু যুদ্ধ সংঘটিত না হলে কী হতো?
: প্রশ্নটা স্যার আপনি করতেন না। কে-ই বা চিনত ওয়াটার লু? যুদ্ধই ওয়ারটার লু নামের স্থানটিকে বিখ্যাত করেছে।
: তুমি বলতে চাইছ, যুদ্ধ বিখ্যাত হওয়ার একটি শর্ত।
: স্যার।
: যুদ্ধ আর শান্তির মধ্যে তফাত কী?
: যুদ্ধের সময় পিতাকে সন্তানের লাশ বহন করতে হয়, শান্তির সময় সন্তানই পিতার লাশ বহন করে। এছাড়া আমি আর কোনো পার্থক্য দেখি না।
: তোমার বয়স কত?
: সতেরো বছর তিন মাস।
: লিখিত পরীক্ষায় তুমি কেমন করেছ বলে মনে হয়?
: এটা স্যার প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা। একজনকেই নেওয়া হবে। আমি নিরানব্বই পেলেও ভালো করেছি বলতে পারব না।
: কেন?
: কেউ একশও পেয়ে যেতে পারেন।
: যদি তোমার চাকরিটা না-হয় কী করবে?
: এখনও আমার চাকুরি নেই। অন্য কোথাও চেষ্টা করব।
: বাচ্চা মেয়ে, ভালো রেজাল্ট, অল্প বয়স, কেরানির চাকরি কেন?
: সাক্ষাৎকারে যোগ্যতা যাচাই করা হয়। অভাব-অভিযোগের কথা বলা কি উচিত হবে স্যার?
: অভাব-অভিযোগের কথা না-বলেও উত্তর দেওয়া যায় যায় না?
: স্থান, সময় ও কার্য বিবেচনায় এই মুহূর্তে একটা চাকরি অতি জরুরি।
খান স্যার অবাক হয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আছেন। মেয়েটি এমনভাবে উত্তর দিচ্ছিলেন যেন, প্রতিটা প্রশ্নের উত্তর বছর বছর ধরে মুখস্থ করে আসছে। তার সাবলীল ভঙ্গিমা দেখে মনে হচ্ছিল খান স্যার নিজেই কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন।
আর একটা সিগারেট জ্বালিয়ে বললেন, তোমার প্রিয় কবি কে?
: রবীন্দ্রনাথ।
: তোমার প্রিয় একটি কবিতার চারটি চরণ বলো?
: বিপদে মোরে রক্ষা কর, এ নহে মোর প্রার্থনা
বিপদে আমি না যেন করি ভয়।
দুঃখতাপে ব্যথিত চিত্তে নাই বা দিলে সান্ত¡না
দুঃখে যেন করিতে পারি জয়।
: তোমাকে কত নম্বর দেওয়া উচিত?
: এ বিবেচনা স্যার সম্পূর্ণ আপনার।
: আমার জায়গায় তুমি হলে কত দিতে?
: দশে দশ দিতাম।
: আর একটা প্রশ্ন করব বলতে পারলে দশে দশই দেব। করব?
: না স্যার।
: কেন?
: এত নম্বর দিলে অহংকার এসে যাবে। পরীক্ষার খাতায় একশ ভাগ খাঁটি হওয়া হয়তো সম্ভব, কিন্তু পরে ওই স্থানে টিকে থাকা সম্ভব না-ও হতে পারে।
: দশে দশ দিয়ে আমি তোমাকে অহংকারীই করে দেব। অহংকার পতনের মূল।
: পতন হতে হলে স্যার উঠতে হয়। না-উঠলে পতন হওয়ার সুযোগ কই।
: তুমি আসলেই মেধাবী, চা চলবে?
: না স্যার।
: কেন?
: আমি কালো, চা পান করলে আরও কালো হয়ে যাব। বিশ্বাস না-করলেও চায়ের টাকা বাঁচানোর জন্য মা এমন বলতেন। প্রতিবাদ করতাম না।
: কেন প্রতিবাদ করতে না?
: প্রতিষ্ঠা করতে না-পারলে প্রতিবাদ করা অর্থহীন।
: তুমি তো অভাবের কথা বলেই দিলে!
: ভাইভা স্যার শেষ। এখন বলা যায়।
: গান করতে পার?
: পারি স্যার।
: একটা গান কর।
: একদিন চিনে নেবে তারে,
তারে চিনে নেবে
অনাদরে যে রয়েছে কুণ্ঠিতা।
স্যার বললেন, চমৎকার। আমরা তোমাকে চিনে নিলাম।
হারমোনিয়াম বাজাতে জানো? খান স্যার জানতে চাইলেন।
: কিছু কিছু, স্কুলে শিখেছিলাম।
: বাসায় হারমোনিয়াম আছে?
: না স্যার।
রাকু বের হয়ে যাওয়ার পর খান স্যার কিছুক্ষণ ঝিম মেরে থেকে আর একটা সিগারেটে আগুন দিলেন। রাকুর উত্তরপত্রে চোখ বুলাতে বুলাতে ফিসফিসিয়ে বললেন, এমন মেধাবী মেয়ে দেখিনি। সনদ ইন্টারের কিন্তু মেধা? ওহ মাই গড, তার পুরো শরীরটা যেন মাথা।
আমি বললাম, হাতের লেখা কী সুন্দর!
খান স্যার বললেন, তুমি লেখা দেখলে, কথাগুলো শুনলে না?
: শুনেছি স্যার।
: কথা নয় যেন বৃষ্টির আওয়াজ, কী অঝোরে ঝরিয়ে গেল। যাও মেয়েটাকেই নিয়োগ দিয়ে দাও। সম্ভব হলে কালই জয়েন করতে বলো।
এই ফাঁকে একটা কথা বলে রাখি। আপনি যতই তুখোড় হোন না কেন, রাকুর মতো করবেন না। কারণ, আপনার ভাইভা যারা নিচ্ছেন, তারা এই ভাইভা বোর্ডের সদস্যগণের মতো তুখোড় হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এখানে আপনি যদি নিজের জ্ঞান দেখাতে চান, তাহলে তারা ঈর্ষাকাতর হয়ে আপনাকে শেষ করে দিতে পারে। মনে রাখবেন, অল্পবিদ্যা সবসময় ভয়ঙ্কর।
বিস্তারিত: বিসিএস প্রিলিমিনারি থেকে ভাইভা কৃতকার্য কৌশল