ড. মোহাম্মদ আমীন
ঢাকায় অবস্থিত ভারতীয় হাইকমিশন থেকে জানা যায়, ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে ১ লাখ ৩০ হাজারেরও বেশি বাংলাদেশি নাগরিককে ভারত গমনের জন্য মেডিকাল ভিসা দেওয়া হয়েছে। রোগী প্রতি তিন লাখ টাকা খরচ ধরলেও ১ লাখ ৩০ হাজার রোগীর চিকিৎসায় বাংলাদেশি ৩৯০০ কোটি টাকা ভারতে চলে গেছে। বিদেশিদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে ভারত যা আয় করে তার ৫০ ভাগ আসে বাংলাদেশ থেকে। বাংলাদেশের বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিবছর বাংলাদেশিরা বিদেশে চিকিৎসা করতে গিয়ে প্রায় ২.০৪ বিলিয়ন টাকা খরচ করে থাকে। এ অর্থ বাংলাদেশের মোট আয়ের ১.৯৪%। ডিজিসিআইঅ্যান্ডএস-এর হিসাবে, ২০১৫-১৬ অর্থবছর মেডিকেল ট্যুরিজম থেকে ভারত আয় করেছে মোট ৮৮ কোটি ৯৩ লাখ ডলার। এর মধ্যে বাংলাদেশ থেকেই গেছে ৩৪ কোটি ৩৫ লাখ ডলার। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১১ কোটি ১৩ লাখ ও ইরাক থেকে ৫ কোটি ডলার আয় করেছে ভারত।
ভারতে কেন বাড়ছে বাংলাদেশি রোগীর সংখ্যা ? বাংলাদেশের স্থানীয় চিকিৎসকের উপর আস্থার অভাব এবং ভুল চিকিৎসার ভয়ে অনিচ্ছা ও আর্থিক অক্ষমতা সত্ত্বেও বাংলাদেশিরা বিদেশ গিয়ে চিকিৎসা নিয়ে থাকেন, বলা যায় চিকিৎসা নিতে বাধ্য হয়। এ দুটি দূর করা গেলে বিদেশ গিয়ে চিকিৎসার প্রবণতা আশি ভাগ কমে যাবে।
ভারত হতে চিকিৎসা-ফেরত রোগীদের অভিমত, আস্থাহীনতা ও ভুল চিকিৎসা ছাড়াও চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িতদের হার্দিক আচরণ এবং আন্তরিক দেখভাল বাংলাদেশি রোগীদের চিকিৎসার জন্য ভারত গমনের অন্যতম একটি কারণ। চিকিৎসক ও নার্সদের অমায়িক ব্যবহারের কারণে রোগী এবং রোগীর আত্মীয়স্বজন আনন্দ, আবেগ আর আস্থায় বিমোহিত হয়ে পড়ে। ফলে মূল চিকিৎসার আগেই ৩০ ভাগ সুস্থ হয়ে যান। একই মানের চিকিৎসা যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে পরীক্ষার সঠিক ফল পাওয়া যায়। বাংলাদেশে একেক ডায়াগনস্টিক সেন্টারের একই রোগীর পরীক্ষার একেক ধরনের ফল দিয়ে থাকে। ফলে বাংলাদেশে ভুল চিকিৎসার হার অনেক বেশি। ভারতে তা অনেক কম। ভারতে চিকিৎসার নামে কোনো ধরনের হয়রানির শিকার হতে হয় না। একই ডায়াগনস্টিক পরীক্ষা একাধিকবার করানো, রোগীকে সময় কম দেয়া, বাড়তি আয়ের জন্য রোগীকে অতিরিক্ত সময় কেবিন বা বিছানায় রাখার প্রবণতা নেই সেখানে। অধিকন্তু সার্বিক বিবেচনায় চিকিৎসার খরচও কম। ফলে বাংলাদেশের নাগরিকরা চিকিৎসার জন্য ভারত চলে যায়।
বিস্তারিত : http://bcsadmindoc6.blogspot.com/2018/10/blog-post_97.html
ভারতে কী ঝামেলা এবং হয়রানি কম হয়? না। ভারতে যাবার জন্য ভিসা-সংগ্রহ থেকে শুরু করে যাতায়াত, অবস্থান, খাওয়া-দাওয়া, ম্যাডিক্যাল টেস্ট ও রিপোর্টের জন্য দীর্ঘ অপেক্ষা প্রভৃতি বিষয়ে যথেষ্ট ঝামেলা ছাড়াও প্রচুর হয়রানি এবং আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। অধিকন্তু একবার চিকিৎসার জন্য গেলে ফলোআপ হিসেবে আরো অনেক বার ভারত যেতে হয়। তারপরও ভারত-ফেরত রোগীরা বাংলাদেশে এসে ভারতের চিকিৎসা ব্যবস্থার এতই উচ্ছসিত প্রশংসা করে যে, অনিচ্ছুকরাও দেশে চিকিৎসার কথা বাদ দিয়ে ভারত চলে যায়। কেন এমন প্রশংসা? এর কারণ হচ্ছে আস্থা, বিশ্বাস এবং হার্দিক আচরণ। তবে শুধু ব্যবহারের জন্য বাংলাদেশিরা চিকিৎসার জন্য ভারত যাচ্ছেন তা নয়। কারণ এমন অনেক প্রভাবশালী রোগী আছেন তারা খুব ভালো ব্যবহার পেয়ে থাকেন। তবু তারা বিদেশ চলে যায়। চিকিৎসার জন্য ভারত যাবার সবচেয়ে বড়ো কারণ স্থানীয় ডাক্তারদের প্রতি চরম অনাস্থা এবং ভুল চিকিৎসার ভয়।
আমি মনে করি, শুধু ডাক্তার নয়, এজন্য জনগণ এবং সাধারণ রোগীদের দায়ও কম না। বিদেশের প্রতি আমাদের দুর্বলতা একটা অসভ্য বদভ্যাসে পরিণত হয়েছে। বাজারে গেলে কেবল হাঁসমুরগি ছাড়া প্রত্যেক কিছুতে বিদেশি তমকা খুঁজে বেড়াই। অধিকন্তু ভারতীয় চিকিৎসকদের কৌশল ও প্রচারের কাছেও আমরা মার খাচ্ছি। এ বিষয়ে সরকার ও জনগণের কার্যকর সচেতনতা প্রয়োজন এবং মাথা থেকে এই সচেতনতা শুরু করতে হবে।