জোর নয়, স্বাভাবিক পরিবর্তনই কাম্য
ড. মোহাম্মদ আমীন
বাঙালি ছাড়া পৃথিবীর আর কোনো জাতি নিজের মাতৃভাষাকে জটিল বলে না; বলে না— সহজ করার জন্য বর্ণমালা থেকে বর্ণের সংখ্যা কমিয়ে দিতে। আমি যদি কোনো বিষয় না বুঝি এবং কঠিন মনে হয়, সেটি কি বিষয়ের দোষ, না কি আমার? আমি হিন্দি বুঝি না, চায়নিজও— এর জন্য ভাষা নয়, আমার অজ্ঞতাই দায়ী। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা বলেই মাতৃভাষাকে অন্য ভাষার চেয়ে বেশি বেশি জানার জন্য অধিক অধ্যয়ন প্রয়োজন, মা বলেই তাকে অন্য কারো মায়ের চেয়ে অধিক সম্মান, শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা প্রয়োজন। এবং বেশি জানতে হলে অবশ্যই বাংলাকে অন্য ভাষার চেয়ে বেশি অধ্যয়ন অপরিহার্য, কিন্তু আমরা তা করি না। না-করে দোষ চাপিয়ে দিই ভাষার উপর।
অধ্যয়ন না করে যারা মাতৃভাষাকে সহজ করার অজুহাতে সমোচ্চারিত বর্ণকে অপ্রয়োজনীয় মনে করে বর্ণমালা থেকে বাদ দেওয়ার কথা বলেন, তারা কি নিজের মা-সন্তানকে মোটাসোটা বলে, কোলে নেওয়ার সুবিধার্থে হাত-পা বা শরীরের কিছু মাংসপিণ্ড কেটে হালকা করে দেওয়ার চিন্তা করছেন? কোনো বিবেকবান কিন্তু অমন করবে না, অতিরিক্ত চর্বি হলে ব্যায়াম বা খাদ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে ধীরে ধীরে তা কমিয়ে চৌকশ অবয়ব দেওয়ার চেষ্টা করাই হবে উত্তম। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মের অবিরাম প্রক্রিয়ায় যা ঘটে তা অবশ্যই প্রয়োজন, এমন পরিবর্তনই হচ্ছে আধুনিকতা এবং যুগোপযোগিতা, বাকিটা বর্বরতা। একশ বছর আগের বাংলা এখনকার মতো ছিল না। বাংলা ধীরে ধীরে বর্তমান অবয়বে এসেছে। পরিবর্তনই স্বাভাবিকতা এবং স্বাভাবিক পরিবর্তনই প্রেম; জোর করে কিছু করা ধর্ষণ।
নিজের অজ্ঞতা ঢাকার জন্য যেসব লোক মাতৃভাষাকে জটিল আখ্যায়িত করে সহজ করার জন্য বর্ণমালা থেকে বর্ণ ছাটাই করার প্রস্তাব দেন, তারা কেন তাদের শরীর থেকে অতিরিক্ত একটি কান, একটি চোখ, একটি নাসারন্ধ্র বাদ দেন না? পায়ের আঙুলগুলোও তো অপ্রয়োজনীয়, সেগুলোই বা কেন কেটে ফেলেন না? মাথার চুলও তো অপ্রয়োজনীয়, সেগুলোই বা কেন এসিড দিয়ে জ্বালিয়ে হালকা হয়ে যান না? যুক্তাক্ষর বাংলার অনুপম সৌন্দর্যের নিপুণ রূপময়তা। অনেকে তাও বাদ দিয়ে দিতে চান, তাহলে ভাষাটি আর বাংলা রইল কীভাবে? এর চেয়ে যুক্তাক্ষরহীন ইংরেজিতে চলে গেলেই তো হয়।
পৃথিবীতে বাংলার চেয়ে অনেক বেশি কঠিন ভাষা রয়েছে। ইংরেজিও বাংলার চেয়ে অনেক কঠিন এবং অবৈজ্ঞানিক। এর অধিকাংশ বর্ণের উচ্চারণ শব্দভেদে ভিন্ন হয়ে যায়। মাতৃভাষাকে কঠিন বলা শুধু অজ্ঞতা নয়, ঐতিহ্যহীনতা, সঙ্গে সঙ্গে মারাত্মক অসভ্যতাও বটে। মাতৃভাষার সঙ্গে এমন আচরণ মায়ের সঙ্গে অসদাচরণের তুল্য। কুলাঙ্গার পুত্র ছাড়া এমন আচরণ মায়ের সঙ্গে কেউ করে না।
আমি পরিবর্তন-বিরুদ্ধ নই, বরং পরিবর্তনের পক্ষে। তবে পরিবর্তন মানে অস্ত্রোপচার করে মানুষের মুখে হুনুমানের মুখ বসিয়ে দেওয়া নয়। প্রতিনিয়ত আমাদের দৈহিক অবয়ব এবং প্রকৃতির পরিবর্তন ঘটছে, কিন্তু তা এতই স্বাভাবিক যে এ পরিবর্তন সহজে ধরা পড়ে না এবং কারও উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়াও সৃষ্টি করে না। ভাষা প্রকৃতির মতো, এর পরিবর্তন হবে এবং তা যেন হয় প্রকৃতির মতো অবিরাম আর স্বাভাবিক গতিতে- এটাই আমার কথা। তাহলে তা কারও অনুধাবনে বিঘ্ন সৃষ্টি করবে না। অস্ত্রোপাচার অনিবার্য না-হলে কাম্য নয়; অন্তত ভাষার ক্ষেত্রে বিষয়টি আরও কঠিন।
অনেকে বলেন, অমুক ভাষার অমুক বর্ণ হারিয়ে গেছে, অমুক ভাষার কেন; আমাদের ভাষারও অনেক বর্ণ এখন ব্যবহৃত হয় না, হারিয়ে গেছে। তা গেছে প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে, যাবে বলেই কি আমাকে যাবার আগে ফেলে দিতে হবে? মরে যাব বলেই কি আমাকে মৃত্যু আসার আগে মৃত্যুকে বরণ করে নিতে হবে? এমন যারা ভাবেন তাদের উচিত, তাদের দাঁতগুলো স্বাভাবিক নিয়মে একদিন ঝরে যাবে বলে ঝরার আগে ফেলে দেওয়া। তা কি উচিত হবে? শুধু ভাষা নয়, মানুষের দৈহিক অবয়বেরও অনেক পরিবর্তন ঘটেছে, আদিম মানুষের চেহারা আর আধুনিক যুগের মানুষের চেহার অভিন্ন নয়; অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এই পরিবর্তন কিন্তু মাকেল জ্যাকসনের মতো অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে করা হয়নি, হয়েছে স্বাভাবিক নিয়মে এবং ধীরে ধীরে প্রকৃতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে।
কেউ যদি প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মকে উপেক্ষা করে জটিলতার অজুহাতে ভাষাকে রাতারাতি কেটেকুটে পরিবর্তন করে ফেলতে চান, তো সেটি হবে অস্ত্রোপচার করে লিঙ্গ পরিবর্তনের মতো ভয়াবহ। ভাষা প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই পরিবর্তন হবে– এমন পরিবর্তনই জীবন্ত ভাষার প্রাণ, সৌন্দর্য এবং আধুনিকতা। কিন্তু সহজকরণের নামে যারা বলপূর্বক ভাষার অঙ্গহানি করে রাতারাতি পরিবর্তন করতে চান তারা ধর্ষকের মতোই কুলাঙ্গার।
বাংলা বানান কোথায় কী লিখবেন এবং কেন লিখবেন১