ড. মোহাম্মদ আমীন, বিসিএস (প্রশাসন), ১০ম ব্যাচ
বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ লোভী, তাই জঘন্য স্বার্থপর। নিজের দরিদ্র মায়ের চেয়ে ধনী শ্বাশুড়ির প্রতি অধিক আনত থাকে। ইংরেজ বিদায় নিল, কত বছর হলো, এখনও তারা স্বকীয় মর্যদায় ভূষিত হওয়ার গৌরব বুঝতে পারেনি। পারিবারিক দাওয়াতপত্রও ইংরেজিতে রচনা করে। এটি যে কত ভয়ঙ্কর হীনম্মন্যতা তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। মাতৃভাষার প্রতি তাদের প্রেম এখনও ইংরেজির নিচে। ইংরেজদের গোলামি ছিল তাদের কাছে বড়ো পূন্যের, মর্যদা আর গর্বের। শুধু ইংরেজী জানলে, আর কিছু না-জানলেও চলে। অথচ শ্রীলঙ্কা-ভুটানের ভিক্ষুক পর্যন্ত হরদম ইংরেজি বলতে পারে; অর্থাৎ যেসব বাঙালি ইংরেজি বলে তারা শ্রীলঙ্কা-ভুটানে গেলে ভিক্ষুকের মর্যদায় উন্নীত হতে পারবে। এখনও আমলারা ভুলভাল ইংরেজি বলে নিজেদের প্রাক্তন প্রভুর খাস গোলাম হিসেবে পরিচয় দিয়ে গর্ববোধ করে থাকেন। এদের উদ্দেশ করে ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ১২ই জুন বঙ্গবন্ধু এ চিটিতে লিখেছিলেন,
“গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে সরকারের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। বাংলা আমাদের জাতীয় ভাষা। তবুও অত্যন্ত দুঃখের সাথে লক্ষ করছি যে, স্বাধীনতার তিন বৎসর পরেও অধিকাংশ অফিস-আদালতে মাতৃভাষার পরিবর্তে বিজাতীয় ইংরেজী ভাষায় নথিপত্র লেখা হচ্ছে। মাতৃভাষার প্রতি যার ভালবাসা নেই, দেশের প্রতি যে তার ভালবাসা আছে একথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। দীর্ঘ তিন বৎসর অপেক্ষার পরও বাংলাদেশের বাঙ্গালী কর্মচারীরা ইংরেজী ভাষায় নথিতে লিখবেন সেটা অসহনীয়। এ সম্পর্কে আমার পূর্ববর্তী নির্দেশ সত্ত্বেও এ ধরণের অনিয়ম চলছে। আর এ উচ্ছৃঙ্খলতা চলতে দেয়া যেতে পারে না।”
ভুটান-শ্রীলঙ্কার কৃষক মজুরগণ যে মানের ইংরেজি কথা বলে, তা আমাদের আমলার শুনলে তাদের কাছে ছুটে যাবেন ইংরেজি শেখার জন্য। এই আমলারা ভাইভা বোর্ডে ইংরেজিতে মাঝে মাঝে প্রশ্ন করে নিজেদের ইংরেজিপনা প্রকাশের সুযোগ হাতছাড়া করেন না। আমাদের দেশের ঊর্ধ্বতন কর্তারা ইংরেজির প্রতি খুব দুর্বল। তারা মনে করেন, ইংরেজি জানলে সব জানা হয়ে যায়, অথচ ইন্দোনেশিয়ায় এমন হাজার হাজার দ্বীপ আছে যাদের কাঠুরেও আমাদের দেশের আমলাদের চেয়ে ভালো ইংরেজি জানেন। বাংলাদেশে ভালো চাকুরির জন্য ইংরেজি জানা অত্যাবশক নয়, কিন্তু আপনি যদি ভালো ইংরেজি জানান, তাহলে চাকুরিদাতা আমলাগণ মনে করেন যে, আপনি আধুনিক সেকশপিয়র, এই মাত্র প্রভুর দেশ হতে নেমে আসা বার্টাড রাসেল। এই ভুল ধারণা ইংরেজিতে ভুলভাল কথা বলতে পারা লোকদেরও প্রচুর অনিয়মতান্ত্রিক সুবিধা দিতে পারে। তাই ইংরেজি শিখতে পারুন বা না পরুন, বাংরেজি শিখতে যেন ভুল না হয়।
ভালো ইংরেজি বলতে পারলে ইংরেজপ্রেমী, কিন্তু ইংরেজিতে অজ্ঞ আমলাদের চোখ চড়ক গাছে তুলে দিয়ে অর্ধেক নাম্বার নিয়ে নিতে পারেন। অতএব, যদি ইংরেজি জানেন, তাহলে ভাইভা বোর্ডে কথায় কথায় ফুটুসফাটুস ইংরেজি বলে যাবেন। আমলা দ্বারা গঠিত বোর্ড মনে করবে, আপনার চেয়ে জ্ঞানী, চৌকশ, প্রাণবন্ত, মেধাবী এবং আধুনিক প্রার্থী বাংলাদেশে আর নেই। আপনার ইংরেজি জ্ঞান তাদের কাছে আপনাকে সর্ববিষয়ে অভিজ্ঞ প্রতিভাত করে এমনভাবে মোহিত করে দিতে পারে যে, ভুটানের কাঠুরে কিংবা শ্রীলঙ্কার ভিক্ষুকের মতো আপনি অন্যকিছু না- জেনেও হয়ে যেতে পারেন নোয়াম চমস্কি। পেয়ে যেতে পারেন দুইশতে একশ নিরানবব্বই। আমি কিন্তু অভিজ্ঞতার আলোকে একথা বলছি, মজা করে নয়।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, আমাদের প্রাথীদের বেশির ভাগই, ভাইভা গ্রহণকারী আমলাদের মতো ইংরেজি পারেন না, ভুলভালও বলতে পারেন না। তাই যারা পারেন, তাদের বিসিএস ভাইভাতে পাস করার হার সবচেয়ে বেশি। বলা যেতে পারে, যে দেশে মোরগ নেই, সে দেশে মুরগিই মোরগ, কিন্তু তার যে অ-কোষ নেই সে হিসেব কে করে? এজন্য আপনার উচিত, ইংরেজি লেখার ও বলার অভ্যাস একটু আগেভাগে শুরু করা এবং যখনই সুযোগ আসে তখনই চর্চা চালিয়ে যাওয়া। এটি আপনি যে-কোনো জায়গায় করতে পারেন।
আমার আপনার উচিৎ মোটামুটি ইংরেজি বলতে পারা এবং মওকা পেলেই ঝেড়ে দেওয়া। তবে যারা এমন ভুলভাল ইংরেজিও বলতে পারেন না, তাদের অত হা-পিত্যেশ করার কিছু নেই। আমি ভুলভাল ইংরেজিও বলতে পারি না, তবে বাংলা আমি পারি, আমার মাকে চিনে নিতে আমার ভুল হয় না। ভাব মারার জন্য বলছি না, যারা চাকুরিটা পেয়েছেন তাদের অনেকেই নিজের মাতৃভাষাটা পর্যন্ত পারেন না। ভাইভার জন্য যে কয়দিন সময় আছে সে কয় দিন চেষ্টা করলে প্রয়োজনীয় চলনসই ইংরেজি শেখা যাবে। ডেস্ক্রাইব ইয়োরসেলফ, ডেস্ক্রাইব ইয়োর ইডুকেশন ব্যাকগ্রাউন্ড, হোয়াই ইজ ইট ইয়োর ফার্স্ট চয়েস? হোয়াট ইউ উইল ডূ ইন দ্যাট সিচুয়েশন, টেল মি এবাউট ইয়োর ডিস্ট্রিক্ট ইত্যাদি বিষয়গুলো মোটামুটি ঝড়ঝড়ে ইংরেজিতে না থেমে ভুলভাল বলে যেতে পারবেন।
এবার আসি আসল কথায়। আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে ইংরেজির গুরুত্ব অপরিসীম। বর্তমান বিশ্বে কোনো দেশ এককভাবে চলতে পারে না, বিশেষ করে আমাদের বাংলাদেশের মতো আর্থনীতিকভাবে দুর্বল দেশের ক্ষেত্রে তা আরো বেশি প্রয়োজনীয়। নিজেকে, নিজের দেশকে বিশ্বে তুলে ধরতে হলে এবং জ্ঞানবিজ্ঞানে বিশ্বমানের বইপুস্তক অধ্যয়নে ইংরেজি ভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। বিষয়টি বিবেচনা করে ভাইভা বোর্ডে ইংরেজি ভাষাজ্ঞানকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। বিশেষ করে, ক্যাডার পছন্দ বিবেচনায় ইংরেজি ভাষাজ্ঞান অপরিহার্য। পররাষ্ট্র ক্যাডারকে যারা এক নম্বর পছন্দে রাখেন, তাদের জন্য ইংরেজি ভাষায় দক্ষ হওয়াটাকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়। যদিও কুটনীতিক হওয়ার জন্য এটি কোনো শর্তই না, কিন্তু আমাদের দেশের আমলাগণ মনে করেন এটাই কুটনীতিক হওয়ার অন্যতম শর্ত।
বিসিএস ভাইভাতে সাধারণত বাংলায় প্রশ্ন করা হয়। তবে প্রত্যেক প্রার্থীকে ইংরেজিতে কয়েকটা প্রশ্ন করা হয়ে থাকে। কিন্তু যাদের প্রথম পছন্দ পররাষ্ট্র ক্যাডার, তাদের কিছু কিছু ক্ষেত্রে কোনো কোনো বোর্ডে সবগুলো প্রশ্ন ইংরেজিতেও করা হয়ে থাকে। যদিও একজন বাঙালি হিসেবে তা উচিত নয় এবং নৈতিকতা ও আত্মমর্যাদা-বিরুদ্ধ। বিদেশি ভাষা হিসেবে প্রায় প্রত্যেক পরীক্ষার্থীর ইংরেজি ভাষায় দুর্বলতা থাকতে পারে। আপনারও যদি থেকে তাহলে উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই। আপনি ইচ্ছা করলে, অন্য পড়ার ব্যাঘাত না-ঘটিয়ে খবর দেখার সময়, পরিবারের সদস্য কিংবা বন্ধুবান্ধব প্রমুখের সঙ্গে কথা বলার সময় ইংরেজির চর্চা করতে পারেন।
অনেকে এজন্য কোচিং করেন। অনেকে বলেন, কোচিং আত্মবিশ্বাস বাড়ায় এবং শেখার কৌশল বাতলে দেয়। যারা কোচিং করছেন, করতে থাকুন। তবে, আমি মনে করি কোচিং না-করলেও অসুবিধা নেই। তবে এটাও সত্য যে, এখন কোচিংকারীর সংখ্যা এত বেড়ে গেছে যে, না-করলে মনে হবে আপনি অড ম্যান আউট। এক্ষেত্রে আপনার আত্মবিশ্বাসে কিছুটা দুর্বলতাও এসে যেতে পারে। অতএব, কোচিং করা না করা এটি ব্যক্তিগত বিষয়। আমি মনে করি, কোচিং শুধু টাকা নষ্ট করে না, যাওয়া-আসার জন্য সময়ও নষ্ট করে, যদি আপনি জিকেন খাতায় অভ্যস্ত না হোন।
আমি বিসিএসের জন্য কোচিং করা দূরে থাক, কোনো কোচিং আছে তাও আমার জানা ছিল না। অবশ্য, আমাদের সময় বিসিএস কোচিং ছিল কি না জানি না। আমাদের পরিচালিত এক জরিপে দেখা গিয়েছে, সাধারণ ক্যাডারে পছন্দের তালিকায় টিকেছে এবং ভালো ফল করেছে এমন প্রার্থীর ৪৫ ভাগই কোনো কোচিং করেননি। তাদের কথা, আত্মবিশ্বাস নিয়ে নিয়মিত অধ্যয়ন করলে কোচিং অর্থহীন। বরং কোচিং করা এবং যাওয়া আসায় সময়টাই কেবল নষ্ট হয়। অর্থের কথা না-হয় বাদই দিলাম।
ইংরেজিতে সবারই সমস্যা থাকে। তাই এই সমস্যা নিয়ে ভাবার দরকার নাই, ভাবুন এটা সবারই জন্য কম-বেশি একই। ইংরেজী বলার ভীতিটা যাদের বেশি, তারা নিয়মিত তা চর্চা করতে পারেন। কীভাবে করবেন সেটি আপনার বিষয়। তবে এজন্য নিজের মোবাইল সেট, ইলেকট্রনিক মিডিয়া, বন্ধুবান্ধব সবার সহায়তা নিতে পারেন। তবে, বিসিএস পাসের জন্যও যদি কোচিঙে ভর্তি হোন, তাহলে আপনার বিসিএস না-দেওয়ার পরার্শই আমি দেব।
বিস্তারিত: বিসিএস প্রিলিমিনারি থেকে ভাইভা কৃতকার্য কৌশল