আইনুল হোসাইন (Ainul Hossain)
বাংলা আমাদের মাতৃভাষা এবং এরই সাথে সাথে অফিস-আদালতের ভাষা হওয়া সত্ত্বেও কেন আমাদের ইংরেজি শিখতে হয়?
– আমাদের জাতীয় মুদ্রা টাকা হওয়া সত্ত্বেও কেন আমাদের ডলার, ইউরোর মূল্য জেনে রাখতে হয়? আমাদের যত উচ্চ শিক্ষার বই বেশিরভাগই কেন

ইংরেজিতে? কেন সেখানে ডলার/সেন্টে ম্যাথ করতে হয়? কেন টাকায় নয়? কেন আমরা এখন লক্ষ/কোটিতে হিসেব না করে মিলিয়ন/বিলিয়ন/ট্রিলিয়নে হিসেব করি? কেন ইংরেজি জানা ছাড়া জব হয় না? আর যদি ইংরেজি জানাই লাগে তাহলে এত মাতৃভাষা মাতৃভাষা করে চিল্লানো? শুধুই কি আবেগ?
– ঔপনিবেশিক শাসকরা যখন এদেশে ব্যবসায়-বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে এখানে আসে তখন তারা এখানকার ভাষা-সংস্কৃতি আয়ত্ত করতে চেষ্টা করতো। মধ্যযুগের ব্যাকরণ/সাহিত্য গুলোর দিকে তাকালে কিছু বিদেশি লেখক/গবেষকদের সম্পর্কে ধারণা পাবেন আপনি। কিন্তু যখনই তারা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছে এদেশে তখন আর এসব নিয়ে মাথা ঘামায়নি, আমরাই মাথা ঘামিয়েছি তাদের ভাষা নিয়ে। তাদের অনেক শব্দকে আমাদের ভাষায় স্থান দিয়েছি আমাদের নিজের অজান্তেই এবং দুঃখজনক হলেও সত্য এখনো দিচ্ছি। এর কারণ হতে পারে হয় আমাদের ও-ই শব্দগুলোর যথার্থ প্রতিশব্দ নেই, অথবা ও-ই শব্দগুলো সম্পূর্ণ নতুন, অথবা আমাদের মানসিকতা নেই/ছিলনা সেগুলোর আত্তীকরণের। এবং এর ফল ভোগ করতেই হচ্ছে – বাল্যশিক্ষায় মাতৃভাষার অ আ এর সাথে শিখতে হচ্ছে A B।
-আমার মাঝে মাঝে করুণা হয় আফ্রিকান দেশসমূহের জন্য। প্রায় দেশের নিজস্ব ভাষা থাকলেও সেগুলার ব্যবহার নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তাদের অফিস-আদালতে ব্যবহার করতে হয় ফরাসি, বেলজিয়ান, স্প্যানিশ, ইংরেজি। এর চেয়ে দুঃখের কী হতে পারে!
– আমাদের কেনই বা ইংরেজি শিখতে হবে? *আমরা(মুসলিমরা) কেন আরবি শিখি? বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ধর্মীয় বিষয়গুলো ভালোভাবে বুঝতে।
*কেন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ফারসি/সংস্কৃত/পালি শিক্ষা দেয়া হয়? এর কারণ এদের সাথে বাংলা ভাষার একটা যোগসূত্র আছে। বাংলার অনেক সাহিত্যই ফারসি থেকে অনূদিত।
*কেন ফরাসি/স্প্যানিশ শেখে? ভাষার সৌন্দর্য অবলোকন করতে অথবা বিদেশে পাড়ি জমাতে।
*জার্মান? একটা সুন্দর ভবিষ্যত তৈরী করতে।
*একই বিষয়গুলো হয়তো চীনা/কোরিয়ান/জাপানিজ ভাষার ক্ষেত্রে ও প্রযোজ্য হতে পারে (ইউটিউবে কেউ একজন বলেছিল তামিল ভাষার ব্যাকরণের সাথে নাকি কোরিয়ান ভাষার ব্যাকরণের অনেক মিল আছে)।
-তাইলে কেন আমাদের ইংরেজি শিখতে হবে? এটার সাথে আমাদের ধর্মীয় কোন সংযোগ হয়তো নেই, বা এটি বাংলা ভাষার কোন ভাই/বোন, মাতা/পিতা ও নয়, ফরাসি/স্প্যানিশ এর মত অতটা সুন্দর ও নয়। তবে হ্যাঁ ইংরেজি ভাষার কিছু সাহিত্যের অনুবাদ/ভাবান্তর বাংলায় হয়েছে, যেমন – মুখরা রমণি বশীকরণ, কমলাকান্তের জবানবন্দি ইত্যাদি (এর বেশি আপাতত মাথায় নেই)।
-ধরুন, আমরা বাঙালিরা একসাথে সবাই সিদ্ধান্ত নিলাম- আজ থেকে আর ইংরেজি নয়, সবকিছু হবে বাংলাতেই। সব হিসেব হবে টাকায়। সকল প্রকারের শিক্ষা হবে বাংলাতেই। সকল প্রকার আমদানি/রপ্তানি হবে শুধুমাত্র টাকাতে। যারা ও-ই শর্তে রাজি হবে না তাদের সাথে আমরা বাণিজ্য বন্ধ করে দিবো।

সাথে সাথে ঘোষণা দিলাম চীনাদের মত নিজস্ব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বানাবো, এর জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা (প্রোগ্রাম) বাংলাতেই লিখবো, এর জন্য যেরকম গণনাকারী যন্ত্র (কম্পিউটার) লাগবে সবগুলোই আমাদের দেশেই তৈরি করবো। যত প্রকার চিপ, র্যাম, রোম, সমন্বিত বর্তনী (ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট) লাগবে সব গুলোর যৌক্তিক গেট (লজিক গেইট) বাংলা অক্ষরে ক খ দ্বারা লিখবো। সমস্ত বীজগাণিতিক সমীকরণ x y এর পরিবর্তে ক খ দ্বারা লিখবো।
কী মাথা ঘুরাচ্ছে? এগুলো কিছুই না। আরো অনেককিছুই আপনাকে এগিয়ে নিতে হবে। এর জন্য যথেষ্টসংখ্যক বিজ্ঞানী, গণিতবিদ, বিশেষজ্ঞ, অনুবাদক প্রয়োজন হয়। আছে কি?
– আপনি ভাবতে পারেন একটা সাধারণ বিষয়ে এত বড় ফতোয়া কেন দিচ্ছি? ভাষা কোন সাধারণ বিষয় না। এটি এক দিনে তৈরি হয়নি, একদিনে প্রসার ও সম্ভব না। এটি একটি জাতির সাধনা হওয়া উচিত। যে জাতি যত বেশি সমৃদ্ধ সে জাতির কাছে তাদের ভাষাকে একটা ব্রান্ডভ্যালু তৈরি করা সময়ের ব্যাপার মাত্র। কিন্তু আমাদের? না আছে এত এত ভালো বিজ্ঞানী, গণিতবিদ, শিক্ষাবিদ (তবে প্রচুর পরিমাণ রাজনীতিবিদ, যুক্তিবিদ আছে)। আমরা কীভাবে পারবো?
সহজ উত্তর সাধনা। আমরা চাইলেই আমাদের ভাষাকে তুলে ধরতে পারি বিশ্বদরবারে। তবে তার জন্য আগে আমাদের নিজেদের একটা জাতীয় স্বীকৃতি তৈরি করে নিতে হবে। তাহলেই আমাদের ভাষাকে ও আমরা ইংরেজি, ফরাসি, স্প্যানিশ, জার্মান ভাষার মত জনপ্রিয় করতে পারবো।
ভাষা ও ভাবনা-২
বাংলা একাডেমি নিজেই তো ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করে, নিজেই ভুলে ভরা, আমরা কী শিখবো সেখান থেকে!
-একটা অফলাইন ইংরেজি শব্দকোষে ‘Academy’ শব্দটা খোঁজ করলাম, উত্তর এলো- শিক্ষায়তন, উচ্চশিক্ষায়তন, সংস্কৃতি-পরিষৎ, পণ্ডিতসভা। এবার একটা বাংলা অফলাইন শব্দকোষে খুঁজলাম, উত্তর পেলাম- এথেন্সের সন্নিকটে স্থাপিত প্লেটোর শিক্ষাদান— কেন্দ্র, শিল্প সাহিত্য বিজ্ঞান প্রভৃতির চর্চা ও গবেষণার কেন্দ্র, সারস্বতকেন্দ্র, কোনো বিষয়ে প্রশিক্ষণদানের উদ্দেশ্যে স্থাপিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
-এবার কিছু কাছাকাছি শব্দ খোঁজ করলাম, যেমন- সংস্থা(association, guild, club, society), প্রতিষ্ঠান(establishment,institution,institute), গবেষণা কেন্দ্র(research center)।
-এনজিও (NGO) শব্দটা তে আমাদের কোন আপত্তি নেই কেন? এটাও তো ইংরেজি সংক্ষিপ্ত রুপের বাংলা প্রতিবর্ণীকরণ ছাড়া আর কিছু নয়। যদি এটাকে বাংলাতে লিখতে যায় তাহলে এভাবেই লিখতে হবে বেসরকারি সংস্থা/প্রতিষ্ঠান/সংঘ ইত্যাদি। কিন্তু লিখি না কেন? সহজ উত্তর – এভাবে লিখতে গেলে এনজিওর সংজ্ঞাটাই পাল্টে যাবে। কারণ তখন এনজিও বলতে সকল বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকেই বুঝাবে হোক সেটা ব্যাংক, বিমা কিংবা অন্য যেকোন বেসরকারি ব্যবসায়, অব্যবসায় প্রতিষ্ঠানকে। এইজন্য এটাকে আমরা ইংরেজিতেই রেখে দি।
-আমরা কেদারা না বলে চেয়ার বলি কেন? কেউ বেশি ভাষাপ্রেমী হয়েও বলে উঠতে পারে আজ থেকে আমি কেদারাই বলবো চেয়ার না। ঠিক আছে, তবে মাথায় রাখলে চলবে কেদারা ও কিন্তু বিদেশি শব্দ।
-Nas Daily এর একটা ভিডিও তে একটা পর্ব ছিলো ‘Selective empathy’ নিয়ে। এটার মানে হল মানুষের দৃষ্টিকে শুধুমাত্র একটি বিষয়ের উপর নিবদ্ধ করে রাখা যাতে করে সে অন্য দিকে মাথা ঘামাতে না পারে। একাডেমি শব্দটার প্রতি ও ভাষাপ্রেমীদের ক্ষোভ দেখে আমার এ-ই ‘Selective empathy’র কথা মনে পড়ে।
নিচের এ-ই অংশটুক আমি Morshed Hasan স্যারের থেকে কপি করেছি-
১) বাঙালি প্রমিত বাংলা বানান নিয়ে সুযোগ পেলেই ঝেড়ে আক্রোশ ঝাড়ে বাংলা একাডেমির ওপর। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে বাঙালি প্রমিত বাংলা বানানের ইতিহাস জানে না।
২) বাংলা বানানের রাজ্যে তখন বিশৃঙ্খলা চলছিল। ১৯৩২ সালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ভাষা অধ্যয়ন ও গবেষণার ক্ষেত্রে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন অধ্যাপক হিসেবে দুবছরের জন্য যোগদান করেন। তখনই তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে বাংলা চলিত বানান প্রমিতকরণের প্রস্তাব করেন।
৩) কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রস্তাব অনুমোদন করে কেন্দ্রীয় বানান সংস্কার কমিটি গঠন করেন। কমিটির সভাপতি ছিলেন রাজশেখর বসু এবং সাধারণ সম্পাদক চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য। কমিটির সদস্য ছিলেন প্রমথ চৌধুরী, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়সহ ১১ জন।
৪) ১৯৩৬ সালে বাংলা বানানের নিয়ম পুস্তিকা প্রকাশিত হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় স্বাক্ষর করে এতে সম্মতি দেন।
৫) ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর ১৯৫৫ সালে পূর্ব পাকিস্তানে বাংলা একাডেমির জন্ম হয়। জন্মলগ্নেই বাংলা একাডেমি বাংলা বানানের প্রমিত নিয়মের জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রবর্তিত পুস্তিকাটির নিয়ম হুবহু অনুসরণ করে।
৬) এরপরে খুব সামান্য কিছু সংস্কার ব্যতিরেকে সেই নিয়মটিই বাংলা একাডেমির নামে চলছে। সাধারণ মানুষ যখন বাংলা একাডেমিকে এ বিষয়ে গালমন্দ করে তখন কী তারা বিখ্যাত বৈয়াকরণ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়সহ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেই তা প্রকারান্তরে করছে না!
৭) ১৯৩৬ সালের পর প্রায় একশো বছর গড়াতে চলল, এ ভারি আশ্চর্যকথা যে এখনও অনেকে জানেন না বাড়ী, গাড়ী কী প্রকারে বাড়ি, গাড়ি হয়ে গেল!
অনুসজ্জা: মিনহা সিদ্দিকা
সূত্র: ভাষা ও ভাবনা, আইনুল হোসাইন , শুদ্ধ বানান চর্চা(শুবাচ)।
বিসিএস প্রিলি থেকে ভাইভা কৃতকার্য কৌশল
ড. মোহাম্মদ আমীনের লেখা বইয়ের তালিকা
বাংলাদেশ ও বাংলাদেশবিষয়ক সকল গুরুত্বপূর্ণ সাধারণজ্ঞান লিংক
বাংলা বানান কোথায় কী লিখবেন এবং কেন লিখবেন/১
বাংলা বানান কোথায় কী লিখবেন এবং কেন লিখবেন/২
বাংলা বানান কোথায় কী লিখবেন এবং কেন লিখবেন /৩
ইউরোপ মহাদেশ : ইতিহাস ও নামকরণ লিংক
কি না বনাম কিনা এবং না কি বনাম নাকি
মত বনাম মতো : কোথায় কোনটি এবং কেন লিখবেন
ভূ ভূমি ভূগোল ভূতল ভূলোক কিন্তু ত্রিভুবন : ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ
মত বনাম মতো : কোথায় কোনটি এবং কেন লিখবেন
প্রশাসনিক প্রাশাসনিক ও সমসাময়িক ও সামসময়িক
লক্ষ বনাম লক্ষ্য : বাংলা বানান কোথায় কী লিখবেন
ব্যাঘ্র শব্দের অর্থ এবং পাণিনির মৃত্যু
যুক্তবর্ণ সরলীকরণ আন্দোলন : হাস্যকর অবতারণা