ভুটান (Bhutan) : ইতিহাস ও নামকরণ

কীভাবে হলো দেশের নাম (এশিয়া)

ড. মোহাম্মদ আমীন

ভুটান (Bhutan)

ভুটান ভারতীয় উপমহাদেশে হিমালয় পর্বতমালার পূর্বাংশে অবস্থিত। ভূটানের উত্তরে চীনের তিব্বত অঞ্চল, এবং দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিমে ভারত। ভূটান শব্দটি এসেছে সংস্কৃত শব্দ “ভূ-উত্থান” থেকে যার অর্থ ‘উঁচু ভূমি’। ভূটান সার্ক এর সদস্য রাষ্ট্র। রাজধানীর নাম থিম্পু। ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে ভুটানে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে জাতিসংঘ ভুটানকে রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

প্রাচীনকাল হতে দেশটি বিভিন্ন নামে পরিচিত থাকলেও নামকরণে ‘ভুটান’ প্রভাব হতে কখনও মুক্ত হতে পারেনি। দেশটি বিভিন্ন সময় কিংবা একই সময়ে বিভিন্নজনের কাছে ভুতানিস, ভোটান, ভোটানটার প্রভৃতি নামে পরিচিত ছিল। কথিত হয় সংস্কৃত শব্দ ভোতাস্তা হতে ভুটান শব্দের উৎপত্তি। বাংলায় ভোতাস্তা শব্দের অর্থ তিব্বতের শ্রেষ প্রান্ত বা তিব্বতের শেষ সীমা। আবার অনেকে মনে করেন ‘ভোডো হাতান’ শব্দ হতে ভুটান নামের উৎপত্তি। যার অর্থ তিব্বতের স্থান। তবে তিব্বতি ভাষায় ‘বডো’ শব্দের অর্থ নিচ। সুতরাং সে হিসাবে ‘বডো হাতান’ শব্দের অর্থ তিব্বতের নিচুভূমি। কিছু কিছু প-িতবর্গের অভিমত, সং¯ৃ‹ত ভু-উত্থান শব্দ হতে ‘ভুটান’ নাম এসেছে। যার অর্থ উঁচুভূমি বা উত্থিত ভূমি। অনেক ভুটানি নিজেদের দ্রুক ইয়োল বা দ্রুক-উল নামে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। এর অর্থ বজ্র ড্রাগনের দেশ বা ব্রজ ড্রাগনের ভূমি। দীর্ঘদিন ভুটান তিব্বতের সঙ্গে অভিন্ন ছিল।

ভুটানের মোট আয়তন ৩৮,৩৯৪ বর্গ কিলোমিটার বা ১৪,৮২৪ বর্গমাইল। তন্মধ্যে জলভাগ ১.১%। আয়তন বিবেচনা ভুটান পৃথিবীর ১৩৬-তম বৃহত্তম দেশ। ২০১২ খ্রিষ্টাব্দের অনুমিত হিসাব অনুযায়ী ভুটানের জনসংখ্যা ৭৪২,৭৩৭ এবং প্রতি বর্গকিলোমিটারে জনসংখ্যার ঘনত্ব ১৮.০ জন। মোট জনসংখ্যা বিবেচনায় এটি পৃথবীর ১৬৫-তম বৃহত্তম দেশ কিন্তু জনসংখ্যার ঘনত্ব বিবেচনায় ১৯৬-তম জনবহুল দেশ। ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের হিসাবমতে দেশটির জিডিপি ৫.৮৫৫ বিলিয়ন ইউএস ডলার। যা ব্রুনাইর সুলতানের মোট সম্পদের এক পঞ্চমাংশের চেয়ে একটু বেশি। ভুটানের জনগণের মাথাপিছু আয় ৭,৬৪১ ইউএস ডলার। এটি বিশ্বে ১১৪-তম। নমিনাল হিসাবে মাথাপিছু আয় ২,৭৩০ ডলার। যা বিশ্বেরর ১৩০-তম। গিনি ৩৮.৭ এবং এইচডিআই ০.৫৮৪ (মধ্যম), যা পৃথিবীর ১৩৬-তম। ভুটানের মুদ্রার নাম গুলট্রাম।

ভুটানের রাজধানী থিম্পু। এটাই পৃথিবীর একমাত্র রাজধানী যেখানে কোনো ট্রাফিক লাইট নেই। ট্রাফিক লাইটের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তবে জনগণের আপত্তির মুখে তা তুলে ফেলা হয়। সাদা হাতমোজা পরিহিত পুলিশ দিয়ে সেখানকার ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করা করা হয়। ভুটানের পতাকায় পৌরাণিক কাহিনির ভয়ঙ্কর ড্রাগনের চিত্র অঙ্কিত। ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের পতাকাটি গৃহীত হয়।

আর্থনীতিক সূচক পরিমাপের ক্ষেত্রে ভুটানে জিডিপির পরিবর্তে (১) টেকসই উন্নয়ন, (২) পরিবেশ সুরক্ষা, (৩) সাংস্কৃতিক সংরক্ষণ এবং (৪) সুশাসন- এ চারটি উপাদান বিবেচনা জিএনএইচ (Gross National Happiness or GNH) সূচক নির্ধারণ করে। যা জিডিপির চেয়ে অনেক কার্যকর প্রতীয়মান হয়েছে। তবে এর পরিমাপ কঠিন এবং অত্যন্ত সূক্ষ্ণ। তারপরও এটি বিশ্বব্যাপী একটি আলোড়ন সৃষ্টি করে। নিজস্ব সংস্কৃতি সংরক্ষণে ভুটান অত্যন্ত কঠোর। রাজকীয় নির্দেশবলে সবাইকে ভুটানের প্রচলিত পোশাক পরিধান ও আচার-আচরণ মেনে চলতে হয়।

১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দের পূর্ব পর্যন্ত এ দেশে কোনো সড়ক, অটোমোবাইল, টেলিফোন, পোস্টাল পদ্ধতি বা বিদ্যুৎ ছিল না। ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দের পূর্ব পর্যন্ত ভুটানিজদের টেলিভিশন বা ইন্টারনেট উপভোগেরও কোনো সুযোগ ছিল না। ভুটান পৃথিবীর একমাত্র দেশ, যেখানে যত কার্বন নির্গত হয় তার বহুগুণ শোষিত হওয়ার মতো অবস্থা এখনও রয়ে গেছে।

ভূটানের অধিবাসীরা ভূটানি নামে পরিচিত। প্রতি বছর জনসংখ্যা ২% হারে বাড়ছে। ভূটানে দ্রুপকা জাতির লোক প্রায় ৫০%। এর পরেই আছে নেপালি (৩৫%) এবং অন্যান্য আদিবাসী বা অভিবাসী জাতি। দেশের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ লোক লামাবাদী বৌদ্ধধর্মে বিশ্বাসী। বাকিরা ভারত ও নেপালি ধারার হিন্দু ধর্ম পালন করে। ভূটানের সাক্ষরতার হার প্রায় ৬০%। জনগণের প্রায় ৯৪% শতাংশ কৃষিকাজে নিয়োজিত। বেকারত্বের হার ৩.১% (২০০৫ খ্রিষ্টাব্দের প্রাক্কলন)। জংখা বা ভূটান দেশটির সরকারি ভাষা। এছাড়াও এখানে আরও প্রায় ১০টি ভাষা প্রচলিত।

বুড্ডিজম ভুটানের রাষ্ট্রধর্ম। হিন্দু দ্বিতীয় বহুল প্রচলিত ধর্ম। (Dzongka) ভটুনের সরকারি ভাষা। ভুটানের ৫৪.৩ ভাগ লোক বয়স্ক এবং ৭৬.২ ভাগ যুবক শিক্ষিত। ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে ভুটান প্রথম বৈদেশিক পর্যটক আগমনের অনুমতি দেওয়া হয়। পৃথিবীতে ভুটানই একমাত্র দেশ যেখানে তামাক নিষিদ্ধ। ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দ হতে এ তামাক নিষিদ্ধকরণ আইন কার্যকর করা হয়।

অতীতে ভূটান পাহাড়ের উপত্যকায় অবস্থিত অনেকগুলি আলাদা আলাদা রাজ্যে বিভক্ত ছিল। ১৬শ শতকে একটি ধর্মীয় রাষ্ট্র হিসাবে এর আবির্ভাব ঘটে। ১৯৫০-এর দশক পর্যন্ত ভূটান একটি বিচ্ছিন্ন দেশ ছিল। ১৯৬০-এর দশক থেকে বৈদেশিক সাহায্য নিয়ে দেশটি একটি আধুনিক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হতে শুরু করে। তবে এখনও এটি বিশ্বের সবচেয়ে অনুন্নত দেশগুলির একটি।

ভূটানে অতীতে একটি পরম রাজতন্ত্র প্রচলিত ছিল। বর্তমানে সাংবিধানিক রাজতন্ত্র প্রচলিত। ভূটানের রাজার উপাধি ড্রাগন রাজা, তিনি রাষ্ট্রপ্রধান। মন্ত্রীদের একটি কাউন্সিল রাষ্ট্রের নির্বাহী কার্য পরিচালনা করে। সরকার ও জাতীয় সংসদ উভয়ের হাতে আইন প্রণয়ণ ক্ষমতা ন্যস্ত। এছাড়া খেনপো উপাধিধারী দেশের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা রাজার সবচেয়ে কাছের পরামর্শদাতার অন্যতম। ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দে একটি রাজকীয় আদেশবলে রাজনীতিক দল গঠনের নিষেধাজ্ঞা তুলে দেওয়া হয়।

ভূটানের প্রায় ৭০% এলাকা অরণ্যাবৃত। মধ্যভাগের মালভূমির মধ্যকার উপত্যকাগুলিতেই বেশির ভাগ লোকের বাস। স্থলবেষ্টিত দেশ ভূটানের আকার, আকৃতি ও পার্বত্য ভূ-প্রকৃতি সুইজারল্যান্ডের সদৃশ বলে দেশটিকে এশিয়ার সুইজারল্যান্ড বলা হয়।

ভূটানের মুদ্রার গুলট্রামের বিনিময় হার ভারতীয় রুপির সাথে সম্পর্কিত । ভূটানের অর্থনীতি বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষুদ্র অর্থনীতির একটি। এটি মূলত কৃষি ও বনজ সম্পদ নির্ভর অর্থনীতি। ভূটানের জনসংখ্যার প্রায় ৬০% এই দুই ধরনের পেশায় জড়িত।

ভুটানের পতকাটি অদ্ভুদ। পৌরানিক কাহিনির ড্রাগনের চিত্র খচি পতাকাটি দেখতে ভয়ঙ্কর মনে হয়। ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে ভুটানের বর্তমান পতাকাটি আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় পতাকা হিসাবে গ্রহণ করা হয়।


মরক্কো (Morocco) : ইতিহাস ও নামকরণ

মরিশাস (Mauritius) : ইতিহাস ও নামকরণ

মোজাম্বিক (Mozambique): ইতিহাস ও নামকরণ

 

এশিয়া : এশিয়া মহাদেশ : ইতিহাস ও নামকরণ

আফগানিস্তান (Afghanistan) : ইতিহাস ও নামকরণ

আযারবাইজান (Azerbaijan) : ইতিহাস ও নামকরণ

আর্মেনিয়া (Armenia) : ইতিহাস ও নামকরণ

বাহরাইন (Bahrain) : ইতিহাস ও নামকরণ

বাংলাদেশ (Bangladesh) : ইতিহাস ও নামকরণ

সূত্র:  কীভাবে হলো দেশের নাম, ড. মোহাম্মদ আমীন, পুথিনিলয়, বাংলাবাজার, ঢাকা।

Language
error: Content is protected !!