ড. মোহাম্মদ আমীন
মাতারি কী?
মাতারি একটি আঞ্চলিক শব্দ। বাংলা একাডেমী বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধানমতে এটি কুমিল্লা, সিলেট, ময়মনসিংহ, বগুড়া ও ঢাকা অঞ্চলের শব্দ। তবে এসব অঞ্চল ছাড়াও বাংলাদশের আরো অনেক অঞ্চল; ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও আসামের বরাক

উপত্যাকার বিভিন্ন এলাকায় মাতারি শব্দটি প্রায় একই অর্থে বিভিন্ন আঙ্গিকে প্রচলিত আছে। এটি একটি প্রাচীন শব্দ। মৌর্য ও গুপ্ত যুগে মাতারি শব্দটি মাতা বা সংসারের প্রধান, সমাজের নেত্রী, কত্রী, পরিচালক, শ্রেষ্ঠ, নির্ভরক প্রভৃতি অর্থ দ্যোতিত করার জন্য ব্যবহৃত হতো। গবেষণায় প্রতীয়মান হয়েছে যে, বাংলার প্রাচীন যুগ থেকে মাতারি শব্দটি দিয়ে মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার চালক বা প্রধান নারীকে নির্দেশ করা হতো। তবে শব্দটি এখন আগের সে অর্থ হারিয়ে ফেলেছে। দেখা যাক, কেন সে তার আদি অর্থ হারিয়েছে।
অনেকে মনে করেন, মাতারি শব্দটি কেবল তুচ্ছার্থে ব্যবহৃত একটি নেতিবাচক শব্দ। কারো কারো মতে, এটি একটি গালি, অনেকে এটাকে গালি হিসেবে ব্যবহারও করে থাকেন। তাই সাধারণভাবে ‘মাতারি’ শব্দটিকে তুচ্ছার্থে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। আসলে বিষয়টি আদৌ তা নয়। মাতা শব্দের অর্থ মা, জননী, গর্ভধারিণী, মাতৃ বা কন্যাস্থানীয় নারী এবং মাতারি হচ্ছে ‘মাতা’-এর ধারক, সংসারের নেত্রী; মাতাঋষি। বৈয়াকরণদের অভিমত, মাতারি শব্দটি উপমহাদেশে আর্য আগমনের সময় প্রচলিত হয়েছে। ভাষা বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মাতারি শব্দটি ফারসি মাদর এবং ইংরেজি মাদার থেকে অভিন্ন অর্থ নিয়ে বা অনুরূপ মর্যাদা নিয়ে আগত।
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র মতে, মাতা শব্দের সঙ্গে রি যুক্ত হয়ে মাতারি (মাতা+রি) শব্দের উদ্ভব।এই রি হচ্ছে ঋষি-রি। মাতা থেকে থেকে উদ্ভূত ‘মাতারি’ শব্দের অর্থ মাতা-ঋ; মাতা-ঋষি। মাতা শব্দ থেকে উদ্ভূত বলে উৎসকালে মাতারি (মাতাঋ) অতি সম্মানজনক শব্দ ছিল। বাংলা একাডেমী বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধানমতে, মাতারি শব্দের অর্থ বয়স্ক স্ত্রীলোক, ঝি-চাকরানি, মা, চাচি, স্থানীয় মহিলা প্রভৃতি।বর্তমানে সাধারণ্যে শব্দটি যতই তুচ্ছার্থে ব্যবহৃত হোক না কেন, অভিধানে এখনো মাতারি শব্দটি ‘মা’ অর্থ নির্দেশ করে। অধিকন্তু, আভিধানিক অর্থসমূহের কোনোটিই নেতিবাচক নয়, যদিও মাতারি শব্দকে নেতিবাচক মনে করা হয়। এমন মনে করার অন্যতম কারণ হচ্ছে মাতৃতান্ত্রিক সমাজের পতন এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজের উত্থান।
মাতারি শব্দের নিহিত ও আদি অর্থ কী? মাতার দায়িত্বে যিনি নিয়োজিত থাকেন তিনিই মাতারি। মাতার ক্রিয়া, কৃ বা রি বা ঋষির কর্ম যে নারী বা রি(স্ত্রী)-এর ওপর ন্যস্ত তিনিই মাতারি। সেক্ষেত্রে একজন নারী ‘মাতা’ না হয়েও মাতারি হতে পারেন। মাদার তেরেসা একজন মাতারি। তিনি কাজ কাজ করতেন, সেবা করতেন মানুষের এবং পশুপাখির- যেমন করেন বাড়ির ঝি-চাকরানি।বাবা না হয়েও পুরুষতান্ত্রিক সমাজে একজন পুরুষ হতে পারেন সংসারের কর্তা। যেমন : আমার পিতামহ যতদিন জীবিত ছিলেন ততদিন তিনিই ছিলেন সংসারের কর্তা। যদিও সংসারের প্রধান অর্থদাতা ছিলেন বাবা। সেকালে সাধারণভাবে ‘নারী’ই হতেন সংসারের প্রধান, সমাজের সর্দার, সংসারের রক্ষক, সবার নির্ভরক। সুতরাং, মাতারি কেবল মাতা বা জননী নন, তারও অধিক।
প্রাচীন বাংলায় আদিবাসীদের পরিবার ছিল মাতৃপ্রধান, এখনো উপজাতীয় সমাজে তা দেখা যায়। তখন মা-ই ছিললেন সংসারের সর্বেসর্বা। সংসারের ঋ বা ঋষি; সংসারের সব কাজই মাকে করতে হতো। সংগত কারণে মাতাই ছিলেন মাতারি, মাতাই ছিলেন পরিবারের সবচেয়ে সম্মানিত নারী, তাই তাকে বলা হতো মাতাঋষি বা মাতারি। পরবর্তীকালে আদিম মাতৃপ্রধান পরিবার ব্যবস্থার বিবর্তন এবং পিতৃপ্রধান সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করলে মাতারি শব্দটি তার আদি সম্মানজনক অর্থ হারাতে থাকে।
এ অবস্থায়, পিতৃপ্রধান সমাজ ব্যবস্থার প্রারম্ভিক প্রসারকালে পুরুষগণ নিজেদের শ্রেষ্ঠ হিসেবে উপস্থাপন করে তাদের পূর্বতন নেতা ‘মাতারি’কে প্রতিহিংসাবশত ঝি-চাকরানি প্রভৃতি তুচ্ছার্থে ব্যবহার করতে শুরু করে। ফলে ‘মাতারি’ শ্রেষ্ঠ হয়েও পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষের ঈর্ষায় পড়ে তার শ্রেষ্ঠত্ব হারিয়ে ফেলে।
শুবাচ গ্রুপের লিংক: www.draminbd.com
All Link : শুবাচে প্রকাশিত গুরুত্বপূর্ণ লেখা
All Links/2 শুবাচির প্রশ্ন থেকে উত্তর
১. স্যমন্তক: এক মলাটে স্যমন্তক সম্পূর্ণ উপন্যাস একসঙ্গে।
২. অর্হণা: অর্হণা : এক মলাটে সম্পূর্ণ উপন্যাস অর্হণা।
৩. সন্মিত্রা: সন্মিত্রা সম্পূর্ণ উপন্যাস : প্রথম থেকে শেষ পর্ব।
৪. তিনে দুয়ে দশ: তিনে দুয়ে দশ সম্পূর্ণ উপন্যাস একসঙ্গে।
৫. তিনে দুয়ে দশ: এক মলাটে নিউটনের ছাত্রী সমগ্র পর্ব
পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি. পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.