২০২০ সনের ফেব্রুয়ারি মাস অতি নিকটে অর্থাৎ আর একদিন পরেই । এই মাসটিকে ভাষার মাস বলা হয় । আবার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার মাসও বলা হয় । কেননা একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত । পৃথিবীর অনেক দেশে এই মাসটি মর্যাদার সাথে মাতৃভাষা দিবস হিসেবে বর্তমানে পালন করা হয়ে থাকে । আবার কোনো কোনো দেশ হয়তো জানে না অথবা তেমনভাবে পালনও করে না । কিছু মানুষের বিভিন্ন সময়ে একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপন সম্পর্কে বিভিন্ন সূত্র থেকে যা জানতে পেরেছি তা অত্যন্ত দুঃখজনক ও হতাশার । জানতে পেরেছি , অনেকেই জানে না একুশে ফেব্রুয়ারি কি ? কেন তা উদযাপন করা হয় ? কেউ বলছে বিশেষকরে এখনকার প্রজন্ম , মুক্তিযুদ্ধ শহীদ মিনার থেকে সংঘঠিত হয়েছিল, কারো মতে মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণ করা হয় বলে, আবার কেউ বলছে ৬৯-এর গণআন্দোলনের কারণে ইত্যাদি ইত্যাদি ।
আমার দু’কথা লেখার ইচ্ছে হলো এই কারণে যে, বাংলা ভাষা তথা নিজের মাতৃভাষাকে অবহেলা করে আমাদের অনেকের মাঝে ইংরেজি ও হিন্দি ভাষাপ্রীতি দেখে অবাক হতে হয় । ইলেকট্রনিক মিডিয়াগুলোতে যে সব কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী ও যুবক- যুবতী অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ করে থাকে,
জসীম উদ্দিন
তাদের অনেককেই ভুল বাংলা ও ইংরেজি উচ্চারণ করতে দেখা ও শোনা যায়, অনুষ্ঠান প্রযোজনায় যাঁরা দেখভালের দায়িত্বে থাকেন তাঁরাই বা কি করে চুপ করে থাকেন এসব দেখে বুঝি না । ইংরেজি যে খুব ভালো জানে তাও নয় , আবার বাংলাও যে জানে তাও নয়, ভাষার মাঝে ইংরেজি ও বাংলা মিশ্রণ তথা ফিউঝ্ন্ ( fusion ) করে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াগুলোতে যে হারে কথা বলা হয় প্রতিনিয়ত, ভাবতে আমাদের কষ্ট হয় । এই ফিউঝ্ন্ ( Fusion ) শব্দটি Fuse ( ফিউজ) শব্দ থেকে মূলত উদ্ভূত । যার অর্থ মিশ্রন, এর আরেকটি অর্থ হলো বিদ্যুত পরিবাহী তার বা নল , বিস্ফোরণ ঘটানোর কাজে সাধারণত সেফ্টি-ফিউজ ব্যবহার করা হয় , সেই ফিউজ-ই এখন ফিউঝ্ন্ । গানের মাঝেও সেই একই মিশ্রণ অর্থাৎ অন্য কোনো গান থেকে দু’চার কথা ও সুর মিলিয়ে সেই জগা খিচুড়িমার্কা গানকে ফিউঝ্ন্ করে আরেকটি গান সৃষ্টি করে পরিবেশন করা । এই ফিউঝ্ন্ দীর্ঘদিন থেকে শিক্ষিত অশিক্ষিত নির্বিশেষে সকলেই ফিউশন্ উচ্চারণে ব্যবহার করে আসছে , এই সব গানে কোন মেসেজ বা বার্তা পাওয়া যাবে না । স্রেফ বিস্বাদ খিচুড়ি । এতে উন্মাদনা বৈ কিছুই নেই । এক কথায় অপসংস্কৃতি । যা আমাদের সুন্দর সাংস্কৃতিক জগতকে দূষিত করছে । নষ্ট করে দিচ্ছে । কলুষিত করছে ।
এর আরো একটি নাম আছে, ইংরেজিতে বলা হয় মেড্লি ( Medley ), যার আভিধানিক অর্থ জগাখিচুড়ি, কয়েকটি গানের কথা ও সুরকে একটি গান বানিয়ে পরিবেশন করা । রীতিমত পাগলামি ছাড়া আর কিছু হতে পারে না । Medley শব্দটি Anglo-French শব্দ Middle English Medlee থেকে উদ্বূত যাকে Medley, Fusion নামে আমরা বলে থাকি অথচ দুটোইসমার্থক শব্দ । পৃথিবী বিখ্যাত সংগীত দল ‘ বিটল্স্ ( বর্তমানে Beetles.) প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৬০ সনে জন লেনন ও জর্জ হ্যারিসন (John Lennon; George Harrison‘) এর হাত ধরে, তাঁদের সেই গানেরও একটা মর্মার্থ ছিল, বিটল্স্ এর গান আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে বিশ্বজনমত সৃষ্টিতে অনেক সহায়ক হয়েছিল । তাতে জনমত সৃষ্টিতে দারুন বার্তা ছিল । যদিও তাঁরা এই জগাখিচুড়ি মার্কা গানের ধারক ও বাহক হিসেবে পরিচিত। ‘বিটল্স্ এ ধরণের গান পরিবেশন করতো বলেই এই গান কে A Medley of Beatles songs বলা হয়ে থাকে । পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অনেক কিছুই আমাদের সংস্কৃতিতে ঢুকে পড়েছে । ভালো কিছু এলে তা অবশ্যই গ্রহনীয় শোভনীয় । কিন্তু আমাদের সুস্থ্ ধারার সংস্কৃতির অবক্ষয় আমরা কেউ চাই না ।
কিন্তু আমরা চুপ করে থাকি কেন ? ভুল ত্রুটি আমাদের সাংস্কৃতিক জগতকে তলানিতে যে ঠেকাচ্ছে তা কে দেখবে ? আরো কষ্ট লাগে ইংরেজি এক আধটুকু যা বলে ভুল উচ্চারণ, আমি হলফ করে বলতে পারবো, টানা দু’মিনিট ইংরেজি কথা বলার সামর্থ এরা অধিকাংশই রাখে না বলেই বাংলার আশ্রয় নেয়, ভাবখানা এমন এরা ভালো ইংরেজিও জানে বাংলাও জানে ।তবে আরেকটা শ্রেণি আছে আমাদের মাঝে বিশেষ করে বর্তমান প্রজন্মের তাদের ইংরেজী রীতিমত ঈর্ষণীয়,চমৎকারভাবে বলে ওরা, কিন্তু যারা সংস্কৃতির নামে অপসংস্কৃতিতে ডুবে আছে তারা ? যখন গান পরিবেশন করে কথা বলে লক্ষ্য করবেন যেমন , আমাড় মোটেও ভাল্ লাগেনাই ঐ গানটি , কেন তোড় তো তাকে পছন্দ বলেই আমি জানি, কিড়ে তোড় কি হলো ? মন খাড়াপ কড়িস্নে । এই হলো তাদের বাংলা বলার ধরণ । কেন ? এসব ভাঁড়ামি ( buffoonish) ও ভনিতা কেন ? এদের থেকে সুন্দর আচরণ কিভাবে আশা করবো ? বর্তমান প্রজন্ম, জাতি কি শিখবে ? এই অপসংস্কৃতির ব্যাপক প্রচলন আমাদের পাশের দেশেও প্রায় দেখা যায় । কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ শিক্ষাদানের চেয়ে পরোক্ষ শিক্ষার প্রভাব অনেক বেশী কার্যকর হয়, যেমনটা পরোক্ষ ধূমপায়ীদের ক্ষতি সাধন করে মূল্যবান জীবনকে মৃত্যূর কোলে ঠেলে দেয় । বিশেষত যে কোন মন্দ বিষয়েই এর প্রভাব বেশী পড়তে দেখা যায় । নিজের মাতৃভাষার পরে আরো দশটি ভাষা জানা অনেক ভালো, প্রশংসনীয় । কিন্তু জগাখিচুড়ি মার্কা কথা ও গান কি করে সুস্থ্ সংস্কৃতির অংগনে ভালো অবদান রাখবে ? এ সব গানের পরিবেশন আর কথা বলার ধরণ যদি দৃষ্টিকটু বা দোষণীয় হয় তবে আমরা কি করে অগ্রসর হবো ? আমাদের শিক্ষা ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের দেখ্ ভালের কোনো দায়-দায়িত্ব নেই ? দেশের সুধী গুণীজন কি কিছুই বলবেন না ? তাঁদেরও কি মুখবুঁজে অন্য দিকে ফিরে থাকা ভালো দেখাবে ? একটি জাতির সভ্যতা প্রকাশ পায় সে জাতির প্রতিটি নাগরিকের দেশ প্রেম, শিক্ষা ও সুস্থ্ সংস্কৃতির চর্চার মধ্য দিয়ে । বর্তমান পৃথিবী শিক্ষা,প্রযুক্তি ও সভ্যতায় চরম শিখরে অবস্থান করছে বলে আমরা সবাই দাবি করি । আসলে কি তাই ?
সেই ষোড়শ শতাব্দির মধ্যযুগীয় কবি আব্দুল হাকিম, বাড়ী নোয়াখালীর সুধারাম মতান্তরে সন্দীপ, তাঁর রচনার বহু স্থানে বাংলা ভাষার প্রতি তাঁর যে অনুরাগ, মমত্ববোধ প্রকাশ করেছেন যা অকল্পিত । প্রায় চার’শ বছরের বেশী । তাঁর মাতৃভাষা ও দেশপ্রেম সমকালীন ও পরের শতকের সাহিত্যিকগণের কাছে তাঁকে এক বিশেষ মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করে রেখেছিল । কালের বিবর্তনে ও অসুস্থ্ সংস্কৃতির যাঁতাকলে পড়ে এই মহান কবিকে নিয়ে আজ আর কিছু লেখা হয় না । আমরা অনেকেই আজ ভুলতে বসেছি আব্দুল হাকিম নামে বাংলা সাহিত্য জগতে গৌরব করার মত কোনো কবি ছিলো । এই তো কিছুদিন আগেও তাঁর লেখা [বঙ্গবাণী] কবিতাটি মাধ্যমিকের পাঠ্য বই থেকে পড়ানো হতো , তা আজ কোথায় যেন উধাও হয়ে গেছে । শুবাচের ড.মোহাম্মদ আমীন তাঁর একটি লেখায় মধ্যযুগীয় কবি আব্দুল হাকিমের উদ্ধৃতি যেমন দিয়েছেন তাঁরই মত আমাকেও বলতে হচ্ছে যারা নিজ মাতৃভাষাকে অবহেলা করে বিজাতীয় ভাষাকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চায় কবি আব্দুল হাকিম তাদের উদ্দেশ্যে তাঁর কবিতায় বলেন ,
‘’ যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী। সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।। দেশি ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুয়ায়। নিজ দেশ তেয়াগি কেন বিদেশ ন যায়।। মাতা পিতামহ ক্রমে বঙ্গেত বসতি। দেশী ভাষা উপদেশ মনে হিত অতি।”
To provide the best experiences, we use technologies like cookies to store and/or access device information. Consenting to these technologies will allow us to process data such as browsing behavior or unique IDs on this site. Not consenting or withdrawing consent, may adversely affect certain features and functions.
Functional
Always active
The technical storage or access is strictly necessary for the legitimate purpose of enabling the use of a specific service explicitly requested by the subscriber or user, or for the sole purpose of carrying out the transmission of a communication over an electronic communications network.
Preferences
The technical storage or access is necessary for the legitimate purpose of storing preferences that are not requested by the subscriber or user.
Statistics
The technical storage or access that is used exclusively for statistical purposes.The technical storage or access that is used exclusively for anonymous statistical purposes. Without a subpoena, voluntary compliance on the part of your Internet Service Provider, or additional records from a third party, information stored or retrieved for this purpose alone cannot usually be used to identify you.
Marketing
The technical storage or access is required to create user profiles to send advertising, or to track the user on a website or across several websites for similar marketing purposes.