বাংলা ভাষার মজা
সম্মানীয় সভাপতি অর্থ ‘বিশেষ কচুর সভাপতি’
ড. মোহাম্মদ আমীন
অনেকে বলে থাকেন, সম্মানীয় সভাপতি। ‘সম্মানীয়’ শব্দটির অর্থ জানা থাকলে এমন বলতেন বলে মনে হয় না।অবশ্য কাউকে হেয় করার জন্য বললে সেটি অন্য কথা। মাননীয় শব্দের পূর্বে ‘সম’ উপসর্গ যুক্ত করলে শব্দটি হয় সম্মাননীয়, কোনোভাবে সম্মানীয় নয়। কারণ ‘সম্মানীয়’ শব্দের অর্থ বিশেষ কচু সম্পর্কিত সভাপতি বা বিশেষ কচুর তৈরি সভাপতি বা বিশেষ কচুর সভাপতি। কেন এমন অর্থ হবে, তা নিচে সংক্ষেপে বর্ণনা করা হলো :
সম্মানীয় = সম+ মানীয়। আরো ভাঙলে পাই : সম+মান+ ঈয়। ‘সম’ যখন উপসর্গ, তখন তার নিজের কোনো অর্থ থাকে না। তবে অন্য শব্দের প্রারম্ভে বসলে মূল শব্দের অর্থকে পরিবর্তন করে দেয়। যেমন : ‘প্রদান’ শব্দের অর্থ কাউকে কিছু দেওয়া কিন্তু ‘সম+প্রদান = সম্প্রদান’ অর্থ নিঃস্বার্থভাবে দেওয়া। ‘মান’ শব্দের পূর্ব ‘সম’ বসালে অর্থ কিছুটা পরিবর্তন হয় কিন্তু কখনো ‘ঈয়- প্রত্যয়’ যুক্ত হবে না। কারণ ‘ঈয়-প্রত্যয়’ কেবল নাম শব্দের পরে বসে।
উপসর্গের মতো প্রত্যয়েরও কোনো অর্থ নেই। তবে এটিও শব্দের অর্থ বদলে দিতে পারে। যেমন : গাছ শব্দের অর্থ উদ্ভিদ, বৃক্ষ প্রভৃতি। এর সঙ্গে ই-প্রত্যয় যুক্ত হলে হয়, ‘গাছি’। এর অর্থ এমন লোক যে গাছে উঠতে জানে। কিছু কিছু প্রত্যয় আছে যা ধাতুর পরেও বসে আবার নাম শব্দের পরেও বসে। এগুলোকে উভচর প্রত্যয় বলে। আবার কিছু কিছু প্রত্যয় আছে যা কেবল ধাতুর পরে বা নাম শব্দের পরে বসে। ঈয়-প্রত্যয় উভচর প্রত্যয় নয়। এটি শুধু নাম শব্দের পরে বসে। যেমন : জাতীয়, ইউরোপীয়, রাজকীয়, রাষ্ট্রীয়, ধর্মীয় প্রভৃতি। প্রসঙ্গত, জাতীয় শব্দের অর্থ জাতি-সম্পর্কিত, ইউরোপীয় শব্দের অর্থ ইউরোপের, বা ইউরোপে নির্মিত, ইউরোপে উদ্ভূত বা ইউরোপে তৈরি প্রভৃতি। এই নিয়মে ‘মানীয়= মান+ঈয়’ শব্দের অর্থ হয় মান সম্পর্কিত বা মান নির্মিত। কারণ ঈয় -প্রত্যয় একটি তদ্ধিত প্রত্যয়। তাই প্রত্যয়টি যে ‘মান’ এর পরে বসে, সেই ‘মান’-কে নামশব্দ হতে হয়।
‘মান’ শব্দের বিভিন্ন অর্থ আছে। যেমন : মান ভাষা। এই মান ‘মা’ ধাতু দিয়ে তৈরি। একটি ‘মান’ হলে মর্যাদা, আর একটি মান অর্থ মন খারাপ করা বা মাইন্ড করা। উভয় শব্দের মূল ‘মান’ ধাতু। সুতরাং এর কোনোটির মূল নামশব্দ নয়। তাই এগুলোর সঙ্গে ঈয়-প্রত্যয় যুক্ত হয় না। ‘মান’ বলে আর একটি শব্দ অভিধানে পাওয়া যায়। এর অর্থ কচু, বিশেষ ধরনের কচু; যার সংস্কৃত প্রতিশব্দ ‘মাণক’। এটাই অর্থাৎ কচু্ই একমাত্র ‘মান’ যার সঙ্গে ‘ঈয়-প্রত্যয়’ যুক্ত হতে পারে। সেক্ষেত্রে ‘মানীয়’ শব্দের অর্থ হয় : কচু সম্পর্কিত বা কচুর তৈরি এবং সম্মানীয় শব্দের অর্থ হয় বিশেষ কচু সম্পর্কিত বা বিশেষ কচুর তৈরি।
মাননীয় = মা+ অনীয়। ‘অনীয়’ একটি কৃৎ প্রত্যয়। যোগ্য প্রকাশে এটি ধাতুর সঙ্গে যুক্ত হয়। সেক্ষেত্রে ‘মাননীয়’ শব্দের অর্থ দাঁড়ায় ‘মানার যোগ্য’ বা সম্মানের যোগ্য। অনুরূপভাবে, করণীয় (করার যোগ্য), স্মরণীয় (স্মরণের যোগ্য), বরণীয় (বরণের যোগ্য), পালনীয় (পালনের যোগ্য) প্রভৃতি।
‘মাননীয়’ শব্দের পূর্বে ‘সম’ উপসর্গ যুক্ত করলে হয় ‘সম্মাননীয়’। তখন এর অর্থ হয় বিশেষভাবে মানার যোগ্য, বিশেষভাবে সম্মানের যোগ্য। সম্মানিত = সম+মান+ত। এখানে ‘ত’ একটি কৃৎ প্রত্যয়। ‘হয়েছে’ অর্থ প্রকাশে ধাতুর সঙ্গে ‘ত-প্রত্যয়’ যুক্ত করে বিশেষণ গঠন করা যায়। এ নিয়মে ‘মান’ শব্দের সঙ্গে ‘ত’ যুক্ত হলে গঠিত হয় ‘মানিত’। যার অর্থ মানা হয়েছে এমন। একইভাবে ‘সম্মানিত সভাপতি’ কথার অর্থ হয় বিশেষভাবে মানা হয়েছে এমন সভাপতি।এরূপ আরো শব্দ আছে। যেমন : পঠিত, গঠিত, পালিত, রক্ষিত, সঞ্চিত প্রভৃতি।কিন্তু ‘সম্মানীয় সভাপতি’ বললে তার অর্থ হয় বিশেষ কচু সম্পর্কিত সভাপতি বা বিশেষ কচুর তৈরি সভাপতি। ভাগ্যিস আমাদের সভাপতিগণ এর অর্থ জানেন না। নইলে কিন্তু ছাড়তেন না।
অতএব বলুন ‘মাননীয় সভাপতি’ সম্মাননীয় সভাপতি, সম্মানিত সভাপতি; সম্মানীয় সভাপতি বলবেন না। কিন্তু যদি, কাউকে অপমানিত করতে চান, তাহলে সম্মানীয় বলতে পারেন।
সূত্র : বাংলা ভাষার মজা, ড. মোহাম্মদ আমীন, পাঞ্জেরী পাবিলিকেশন্স লি.।
—————————————–