ড. মোহাম্মদ আমীন
মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানী: এম এ জি ওসমানী
জেনারেল এম. এ. জি. ওসমানী নামে সমধিক পরিচিত মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানী ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দের ১লা সেপ্টেম্বর সিলেট জেলায় বালাগঞ্জ থানার (অধুনা ওসমানী নগর উপজেলা) পিতৃবাটিতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা খান বাহাদুর মফিজুর রহমান, মাতা জোবেদা খাতুন। খান বাহাদুর মফিজুর রহমানের দুই ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে ওসমানী কনিষ্ঠ। ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দে খান বাহাদুর মফিজুর রহমান আসামের সুনামগঞ্জ সদর মহকুমায় সাব-ডিভিশনাল অফিসার হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন৷
পিতার চাকরির কারণে ওসমানীর শৈশব-কৈশোর কাটে বিভিন্ন জায়গায়। গোহাটিতে ওসমানীর প্রাথমিক শিক্ষার সূচনা। ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ‘কটনস্ স্কুল অব আসাম’-এ ভর্তি হন। ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে ওসমানী সিলেট গভর্নমেন্ট পাইলট হাই স্কুলে ভর্তি হন ৷ তখন এই স্কুলটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ছিল৷ ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সমগ্র ব্রিটিশ ভারতে প্রথম স্থান লাভ করে মেট্রিক পাশ করেন৷ এই কৃতিত্বের জন্য ব্রিটিশ সরকার তাঁকে প্রাইওটোরিয়া পুরস্কারে ভূষিত করেন। তিনি ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।
ওসমানী ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে রয়্যাল আর্মড ফোর্সে ক্যাডেট হিসেবে যোগ দেন। দেরাদুনে ব্রিটিশ ভারতীয় মিলিটারি একাডেমিতে প্রশিক্ষণ শেষে তিনি ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে কমিশনড অফিসার হিসেবে যোগ দেন। সেসময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছিল। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর একটি ব্যাটেলিয়ানের কমান্ডার হিসেবে তিনি বার্মা (মিয়ানমার) সেক্টরে কাজ করেন। ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মেজর পদে উন্নীত হন। ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে ওসমানী ছিলেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সর্বকনিষ্ঠ মেজর। ১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে ওসমানী ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে লং কোর্স পরীক্ষা দিয়ে উচ্চস্থান লাভ করেন৷ সে বছর তিনি ইন্ডিয়ান পলিটিক্যাল সার্ভিসের জন্যও মনোনীত হন৷ তবে তিনি সামরিক বাহিনীতে থেকে যান৷ দেশবিভাগের পর ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ৭ই অক্টোবর ওসমানী পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। এসময় তার পদমর্যাদা ছিল লেফটেন্যান্ট কর্নেল। ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি চিফ অব জেনারেল স্টাফের ডেপুটি হন। ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর ১ম ব্যাটেলিয়নের অধিনায়ক নিযুক্ত হন৷ এরপর তিনি চট্টগ্রাম সেনানিবাস প্রতিষ্ঠা করেন৷ ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কর্নেল পদে উন্নীত হন। ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে পাক-ভারত যুদ্ধে তিনি পাকিস্তানের হয়ে যুদ্ধ করেন৷ ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে অবসরকালীন ছুটি নেন এবং ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই ফেব্রুয়ারি অবসর গ্রহণ করেন।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ওসমানী সীমান্ত পার হয়ে ভারতে প্রবেশ করেন। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১১ই এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে প্রদত্ত ভাষণে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবকাঠামো গঠনের কথা উল্লেখ করে এমএজি ওসমানীকে মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি ঘোষণা করেন। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ই এপ্রিল গঠিত মুজিবনগর সরকারে ওসমানীকে মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি করা হয়।
দেশ স্বাধীন হলে ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৬শে ডিসেম্বর তাঁকে জেনারেল পদমর্যাদা (অক্রিয়) বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রদান করা হয় এবং তিনি প্রথম সশস্ত্র বাহিনী প্রধান হিসেবে নিযুক্তি পান। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ১২ই এপ্রিল তিনি অবসর নিয়ে অভ্যন্তরীণ নৌ যোগাযোগ, জাহাজ ও বিমান মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে মন্ত্রিসভায় যোগ দেন। ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দের মার্চে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম

সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়৷ ওই নির্বাচনে ওসমানী নিজ এলাকা থেকে অংশ নিয়ে ৯৪ শতাংশ ভোটে বিজয়ী হন৷ এরপর তিনি ডাক, তার, টেলিযোগাযোগ, অভ্যন্তরীণ নৌ যোগাযোগ, জাহাজ ও বিমান মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে তিনি মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে একদলীয় বাকশাল ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হলে তিনি সংসদ সদস্যপদ এবং আওয়ামী লীগের সদস্যপদ ত্যাগ করেন। ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৯শে আগস্ট খন্দকার মোশতাক আহমেদের প্রতিরক্ষা বিষয়ক উপদেষ্টা পদে নিয়োগ পান। তবে ৩রা নভেম্বর জেলহত্যার ঘটনার কারণে পদত্যাগ করেন। ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে ওসমানী ‘জাতীয় জনতা পার্টি’ নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। ১৯৭৮ ও ১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দের ৩রা জুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জিয়াউর রহমান জয়লাভ করেন।
ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসার্থে লন্ডন থাকাকালীন ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই ফেব্রুয়ারি এমএজি ওসমানী মারা যান। তাঁকে পূর্ণ সামরিক মর্যাদায় সিলেটে সমাহিত করা হয়। ঢাকার ‘ওসমানী উদ্যান’ ও বাংলাদেশ সচিবালয়ের বিপরীতে ‘ওসমানী মেমোরিয়াল হল তাঁর স্মৃতি বহন করে চলেছে।৷ তাঁর বাসভবনকে করা হয়েছে জাদুঘর৷ সরকারি উদ্যোগে সিলেট শহরে তাঁর নামে একটি মেডিকেল কলেজ, হাসপাতাল ও আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ৷