মুদ্রাদোষ
ড. মোহাম্মদ আমীন
লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ নিতে এসে আমরা কয়েকজন প্রশিক্ষণার্থীর একটা মুদ্রাদোষ প্রবল হয়ে ওঠে। সেটি হলো – অন্যের ‘মুদ্রাদোষ’ ধরা। অন্যের দোষ ধরার চেয়ে মারাত্মক, কিন্তু সহজ দোষ আর হতে পারে না। তা জেনেও কাজটা অনেকের মতো আমরাও করতাম। মুদ্রাদোষকে যতই মুদ্রাদোষ বলা হোক না, এ দোষ কিন্তু ডলারদোষের চেয়েও ভয়ঙ্কর। মুদ্রদোষ, বাক্যকে খোঁড়া আর প্রকাশকে বিকৃত চেহারার মতো ভয়ঙ্কর করে তোলে।
সকাল ছয়টা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত ক্লাস চলত। কতক্ষণ আর ভালো লাগে— তাই অনেকে ক্লাসে ঘুমের ক্ষতিটা চোখ বুজে পুষিয়ে নিত। আমি ছিলাম আবার পালের গোদা। এমন জায়গায় বসতাম যাতে প্রশিক্ষকের চোখে আমার চোখ ধরা না-পড়ে। সন্ধ্যায় হতো বিশাল ক্লাস— সব সেকশনের একসঙ্গে। ঢাকা থেকে নামি-দামি বক্তারা যেতেন। সারাদিনের ক্লান্তি বড়ো বড়ো বক্তাদের বক্তব্যকে ঘুমকাতুরে বালকের ন্যায় হাস্যকর করে দিত। এর মাঝেও আমরা নানা উপায়ে বিনোদন খুঁজে নিতাম। তম্মধ্যে হাস্যকর বাক্য লিখে চিরকুট-প্রবাহ, বক্তার ত্রুটি-সন্ধান, চুটকি প্রভৃতি অন্যতম।
সান্ধ্য অধিবেশনে বড়ো বক্তাদের মধ্যে নরেন বিশ্বাস ছিলেন নিয়মিত। তিনি প্রতিসপ্তাহে একদিন আমাদের ক্লাস নিতেন। বিষয় ছিল ‘বাংলা ভাষা : প্রয়োগ ও অপপ্রয়োগ’। প্রথম দিন আনিসের নজরে পড়ে তাঁর মুদ্রাদোষ। মারাত্মক না-হলেও তো মুদ্রাদোষ— অতএব। প্রথমদিন প্রায় দুইশ বিসিএস অফিসার পেয়ে নরেন বিশ্বাস এত উদ্বেলিত হয়েছিলেন যে, ষাট মিনিটের একটা অধিবেশনে সত্তর বার ‘অতএব’ শব্দটি উচ্চারণ করে বসলেন। তাঁর ক্লাসে আমরা খাতায় রেকর্ড করতাম কয়বার তিনি ‘অতএব’ বলেন।
বুনিয়াদি প্রশিক্ষণের সমাপন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হয়ে এসেছিলেন জনাব আনিসুজ্জামান। তখন তিনি সরকারের জনপ্রশাসন বিষয়ক উপদেষ্টা। এক সময়কার জাঁদরেল আমলা— সিএসপি। সুনসান নীরবতার মধ্য দিয়ে তিনি বক্তব্য শুরু করলেন:
আমেরিকা যাচ্ছিলাম। আপনার স্ত্রী আমাকে বিমান বন্দর পর্যন্ত এগিয়ে দিল। আপনার বিমান বন্দরে গিয়ে আপনার স্ত্রী আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলেন। তখন আপনার এ সময়ের মতো আপনার ঘন ঘন বিদেশ যাবার রেওয়াজ ছিল না। আপনার স্ত্রীকে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করলাম। আপনার স্ত্রী আমার আদর পেয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। আপনার স্ত্রী আমাকে জড়িয়ে ধরল। জড়িয়ে ধরে বলল— ওগো, তোমাকে ছাড়া আমি কীভাবে থাকব। সত্যি আপনার স্ত্রীর ভালোবাসার কোনো তুলনা হয় না। কয়েক দিন বিদেশে ছিলাম। এ কয়দিন আপনার স্ত্রী আমাকে প্রতিদিন ফোন করেছে। আমিও আপনার স্ত্রীর জন্য একদিনও শান্তিতে থাকতে পারি নি। একে বলে আপনার স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসা। আজ আপনার সে স্ত্রী আমার কাছে নেই। তবু আপনার স্ত্রীর সকল স্মৃতি আমাকে এখনও উদাস করে রাখে।
বক্তৃতার মাঝে সবার হাসি তাঁর চোখেই পড়ে না। পড়লেও মনে করেছেন— আমরা তাঁর বক্তৃতায় মুগ্ধ হয়ে হাসছি। আমরা হিসেব কষে দেখেছি, ত্রিশ মিনিটের ঐ বক্তৃতায় তিনি একচল্লিশ বার ‘আপনি’ শব্দটা উচ্চারণ করেছিলেন।
সূত্র : রঙ্গরসে বাংলা বানান, ড. মোহাম্মদ আমীন।
তিলোত্তমা : বাংলা বানান কোথায় কী লিখবেন
মুদ্রাদোষ : জ্বি স্যার : কৌতুকে কৌতুকে সয়লাব
বাংলা বানান কোথায় কী লিখবেন এবং কেন লিখবেন/১
বাংলা বানান কোথায় কী লিখবেন এবং কেন লিখবেন
বাংলা ভাষার মজা, ড. মোহাম্মদ আমীন, পাঞ্জেরী পাবিলিকেশন্স লি.।