ড. মোহাম্মদ আমীন
সংযোগ: https://draminbd.com/যতিচিহ্নের-ব্যবহার/
যতিচিহ্নের ব্যবহার: যতিচিহ্ন সমূহের ব্যবহার
বিরামচিহ্নের শ্রেণিবিভাগ: বাক্যে অবস্থান বিবেচনায় বিরামচিহ্নকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথা : ১. প্রান্তিক বিরামচিহ্ন, ২. বাক্যান্তৰ্গত বিরামচিহ্ন
বাংলা ভাষায় ২৬টির মতো যতিচিহ্ন রয়েছে। তন্মধ্যে ৪টি বাক্যের শেষে, ১৫টি বাক্যের ভেতরে এবং বাক্যের আগে বা পরে ৭টি ব্যবহৃত হয়।যতিচিহ্ন দুই প্রকার। যথা: (ক). প্রান্তিক যতিচিহ্ন এবং (খ). বাক্যান্তৰ্গত বিরামচিহ্ন। বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত বিরাম বা যতি চিহ্নসমূহ হলো: ১. দাঁড়ি (।), ২. জোড়দাঁড়ি (॥), ৩. কমা (,), ৪. সেমিকোলন ( ; ), ৫. কোলন ( : ), ৬. হাইফেন (-), ৭. ড্যাশ (—), ৮. কোলন ড্যশ ( :—), ৯. প্রশ্নবোধক চিহ্ন (?), ১০. বিস্ময়চিহ্ন (!), ১১. ঊর্ধ্বকমা ( ’), ১২. বিকল্পচিহ্ন (/), ১৩. বিন্দু বা সংক্ষেপণ চিহ্ন (.), ১৪. ত্রিবিন্দু বা বর্জন চিহ্ন (…), ১৫. একক উদ্ধৃতিচিহ্ন (‘ ’), ৬. জোড়উদ্ধৃতিচিহ্ন বা কোটেশন মার্ক (“ ”), ১৭. প্রথমবন্ধনী ( ), ১৮. তৃতীয়বন্ধনী ( [ ]), ১৯. ইলেক বা লোপচিহ্ন ( ’ ), ২০. সমান চিহ্ন ( = ), ২১. ধাতু দ্যোতকচিহ্ন (√), ২২. পরবর্তী রূপবোধকচিহ্ন (<), ২৩. পূর্ববর্তী রূপবোধকচিহ্ন (>), ২৪. উচ্চারণচিহ্ন (/ /), ২৫. যোগচিহ্ন, ২৬. প্রশ্নাবেগচিহ্ন (?!)
কমা [ ,] বলে, “দম নে!” দাঁড়ি [।] বলে, “দাঁড়া!”
দুই দাঁড়ি [।।] দিলেও নেই কোন তাড়া।
জিজ্ঞাসা [?] চিহ্নে, প্রশ্ন কি বুঝি?
আশ্চর্য চিহ্নে [!], বিস্ময়ই খুঁজি।
ড্যাশ [—] দিলে থেমে যাই, হাইফেনে [-] থামি না
উদ্ধৃতি চিহ্নে [“/”], কদাচিৎ ঘামি না!
বন্ধনী [{( )}] বন্ধন, লোপ [‘] থাকে উহ্য,
কোলন ড্যাশ [:—] দিয়ে যথা:— ডাল-ভাত ভোজ্য।
কোলন [:], কোলন, আর সেমি-কোলন [;],
একে একে সবকটা থেমে যায় দোলন!
১. দাঁড়ি বা পূর্ণচ্ছেদ (।) : প্রশ্নসূচক ও বিস্ময়সূচক বাক্য ব্যতিরকে অন্যান্য বাক্যের সমাপ্তিসূচক চিহ্নটি দাঁড়ি বা পূর্ণচ্ছেদ। বিবৃতিমূলক, নির্দেশাত্মক ও

অনুজ্ঞাসূচক বাক্য দাঁড়ি দিয়ে শেষ করা হয়। ছোটো বাক্য কেবল দাঁড়ি দিয়ে সমাপ্ত করা যায়। তবে দীর্ঘ বাক্য, যেখানে পরিপূর্ণ উপলব্ধির জন্য অন্য কোনও চিহ্নের প্রয়োজন সেখানে উপযুক্ত স্থানে দাঁড়ি ছাড়াও অন্যান্য বিরামচিহ্ন ব্যবহার করা আবশ্যক। বাংলা বাক্যে পরোক্ষ প্রশ্ন কিংবা পরোক্ষ বিস্ময় প্রকাশের ক্ষেত্রে প্রশ্নসূচক কিংবা বিস্ময়সূচক চিহ্নের পরিবর্তে দাঁড়ি ব্যবহার করা হয়। যেমন: তিনি কী করেছেন না করেছেন তা আমার জানা নেই। ব্যাপারটা কী তা বোঝা যাচ্ছে না। দাঁড়ির প্রাচুর্য বাক্যকে দীর্ঘ হতে দেয় না, নাতিদীর্ঘ বাক্য সর্বোত্তম বাক্য। তাই লেখায় যত বেশি দাঁড়ি ব্যবহার করা যায়, বাক্য তত চমৎকার হয়। তবে তা যেন বাক্যের আদর্শ, অর্থ এবং সৌন্দর্যকে ব্যাহত না করে সেদিকে বিশেষভাবে লক্ষ রাখা প্রয়োজন। আগে, বিশেষ করে কবিতায় জোড় দাঁড়ি ব্যবহৃত হতো। এর কাজ ছিল দাঁড়ির মতো। তবে এখন জোড়দাঁড়ির ব্যবহার বিরল।
২. জোড়দাঁড়ি(।।): প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে যতিচিহ্ন হিসেবে কেবল এক দাঁড়ি (।) এবং জোড় দাঁড়ি (।।) ব্যবহৃত হতো। অন্য কোনো বিরামচিহ্ন ছিল না।বাংলা প্রাচীন পুথিতে শব্দ বা পদগুলো একসঙ্গে লেখা হতো। যেমন: সীতাহারাআমিযেনমনিহারাফণী । কবিতার প্রথম চরণের শেষে এক দাড়ি এবং দ্বিতীয় চরণের শেষে জোড় দাঁড়ি ব্যবহারের নিয়ম ছিল। যেমন: মধযুগের কবি আব্দুল হাকিমের লেখায়ー
যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী।
সেসব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি। ।
যতিচিহ্নের প্রয়োগবিধি সম্পর্কে আরও জানার জন্য দেখতে পারেন: যতিচিহ্নের প্রয়োগবিধি।
৩. কমা (,): বাক্যে কমা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু অবহেলিত। স্বল্পকালের বিরতিপ্রকাশক এ চিহ্নটির ব্যবহার বাক্যকে সুন্দর এবং অর্থকে সহজবোধ্য করে তুলে। বাক্যের অন্তঃস্থ বিরামচিহ্ন হিসেবে কমার গুরুত্ব অন্য যে-কোনো বিরামচিহ্নের চেয়ে অধিক। বাক্যে কমা ব্যবহারের ক্ষেত্রে নিম্নবর্ণিত বিষয়গুলো খেয়াল রাখা উচিত।
১. একটি বাক্যের একাধিক অংশের মধ্যে সামান্য সময়ের জন্য থামার দরকার হলে কমা ব্যবহার করা হয়। একাধিক বক্তব্য প্রকাশ করা হলে প্রতিটি বক্তব্যের সুস্পষ্ট প্রকাশের জন্য বাক্য থেমে থেমে পড়া প্রয়োজন হয়। কমা থামার স্থান নির্দেশ করে। যেমন: সফিক, কামাল এবং ছাত্তার শুধু নয়, সঙ্গে জাফরও ছিল। বাবা, আমি খােই? তিনি থামলেন, পুরোপুরি থামা নয়, গতি কমানো, বললেন, কল্পনাকে যারা বাস্তবতার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়, তারাই নাস্তিক। সহমত, ভাই।
২. বাক্যের অভ্যন্তরে উদ্ধৃতির মধ্যে সংলাপ থাকলে প্রথম উদ্ধৃতি চিহ্নের পূর্বে কমা বসাতে হয়। যেমন : “হঠাৎ তিনি বলে উঠলেন, ‘দেখুন, ধর্মের আড়ালে মানুষ কীভাবে মানুষ মারছে।” বাক্যে পরোক্ষ উক্তির পর প্রত্যক্ষ উক্তি থাকলে পরোক্ষ উক্তির পর কমা বসাতে হয়। যেমন: আসামি বললেন, “আমি নির্দোষ, আমি খালাস প্রার্থনা করি।”
৩. নইলে, নচেৎ, না হলে, তা হলে, নতুবা, নয়তো, হয়তো ইত্যাদি ‘অন্যথাজ্ঞাপক’ অব্যয় ব্যবহৃত হলে বাক্যে অর্থের স্পষ্টতার জন্য অব্যয়ের পূর্ববর্তী শব্দের শেষে কমা বসাতে হয়। যেমন : খুব সাবধানে ধরো, নইলে ব্যথা পাবে। করো, নতুবা মরো।
৪. বাক্যে দুরান্বয় ব্যবহার করা হলে দুরান্বয়ঘটিত বাক্যাংশের পূর্বে ও শেষে কমা দিতে হয়। ব্যাকরণগত সংযোগহীন অংশকে (প্যারেনথিসিস) পৃথক করার জন্য কমা বসাতে হয়। যেমন : রহিম যেমন ফর্সা তেমন বলিষ্ঠ, দেখলে মায়া হয়, ইচ্ছে করে কাছে ডাকতে। (২) রাজ দাঁড়িয়ে, সামনে মানুষ আর মানুষ, আরও আসছে, থামার কোনও লক্ষণ নেই।
৫. বড়ো কোনও অঙ্কের পঠন ও অনুধাবনের সুবিধার জন্য কমা বসানো হয়। সাধারণত সহস্র, লক্ষ, কোটি প্রভৃতির পরে কমা বসে। যথা : ৮৩,৬৫০ (তিরাশি হাজার ছয়শত পঞ্চাশ)। অর্থাৎ, বড়ো রাশিতে হাজার, লক্ষ, কোটি প্রভৃতিকে স্পষ্টভাবে বোঝাতে কমা ব্যবহার করা যায়।
৬. তারিখ লেখার সময় কমা বসানো একটি বহুল প্রচলিত রীতি। অর্থাৎ মাসের তারিখের পরে ‘বার’ বা ‘সাল’ উল্লেখ থাকলে মাসের তারিখের পরে কমা বসে। বারের পরে সাল উল্লেখ থাকলে বারের পরেও কমা বসে। যেমন: উদাহরণ: ২০ মে, ২০০০ খ্রিষ্টাব্দ, বৃহস্পতিবার মীম বান্দরবান জেলায় জন্মগ্রহণ করে।
৭. বাক্যে একাধিক বিশেষ্য কিংবা বিশেষণ পদের বিবৃতি প্রকাশের ক্ষেত্রে কমা বসাতে হয়। অর্থাৎ পরস্পর সম্বন্ধযুক্ত একাধিক বিশেষ্য বা বিশেষণ পদ একসঙ্গে বসলে শেষ পদটি ব্যতীত বাকি পদগুলোর পরে কমা ব্যবহার করতে হবে। যথা : জনি বুদ্ধিমান, সাহসী এবং জ্ঞানী। মীম, সানি, হারুন এবং রব কক্সবাজার গিয়েছে।
৮. বাক্যের বা বাক্যাংশের প্রারম্ভে ‘অবশ্য, পক্ষান্তরে, নতুবা’ ইত্যাদি সাপেক্ষবোধক বা শর্তজ্ঞাপক শব্দ থাকলে সাপেক্ষবোধক শব্দের পরে কমা বসে। যেমন : যা করার ভেবে চিন্তে করো নতুবা, আমার কিছুই করার থাকবে না।
৯. সম্বোধন পদের পরে আগের বা পরে কমা বসে। যেমন: রব, এদিকে এসো। সম্বোধন পদের পরে কিংবা

আগে কমা ব্যবহার না করলে অর্থের বিপর্যয় ঘটতে পারে। যেমন: ‘বাবা খাওয়ার পর কথা হবে।’— বাক্যটিতে ‘বান্ধবী’-র পরে কমা ব্যবহার না-করায় বাক্যটির অর্থ কেউ এমন বুঝতে পারে — বাক্যটি যিনি লিখেছেন, তিনি কাউকে বলছেন যে, তিনি ‘বাবা-নামক কোনো খাবার খাওয়ার পর কিংবা বাবাকে খাওয়ার পর কথাবার্তা বলবেন। ‘শুভ জন্মদিন বোন।’ কমার যথাযথ প্রয়োগ না-ঘটার কারণে এই বাক্যটির অর্থও অনেকের কাছে বিভ্রান্তিকর হতে পারে। সম্বোধন পদ বাক্যের শুরুতে ব্যবহৃত হলে পদটির পরে এবং শেষে ব্যবহৃত হলে পদটির আগে কমা ব্যবহার করা সমীচীন। যেমন: মা, খাওয়ার পর কথা হবে। শুভ জন্মদিন, বাবা। স্যার, কেমন আছেন? আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ, জনাব। প্রসঙ্গত, বাক্যে অনেক ক্ষেত্রে সম্বোধন পদ হিসেবে ক্রিয়াবিশেষ্যও ব্যবহৃত হয়। সেক্ষেত্রে ওই ক্রিয়াবিশেষ্যের পরে কমা বসাতে হবে। যেমন: চল, একটু ঘুরে আসি। পড়, আল্লাহ্র নামে। যাও, আমি একটু পরে আসছি।
৪. সেমিকোলন (;): কমা ও সেমিকোলন ব্যবহারের উদ্দেশ্য প্রায় অভিন্ন। সেমিকোলনের স্থানে কমার চেয়ে বেশি, কিন্তু দাঁড়ির চেয়ে কম থামতে হয়। বাক্যের ভেতরে শুধু থামার জন্য কমা-সেমিকোলন ব্যবহার করা হয় না। অর্থ প্রকাশে কমা ও সেমিকোলন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
১. পৃথক ও স্বাধীন দুটি বাক্যকে সংযোজক অব্যয় দিয়ে যুক্ত করা হয়। সেমিকোলন সংযোজক অব্যয়ের পরিবর্তে বাক্যদ্বয়কে সংযোজন করার জন্য ব্যবহৃত হয়। বাক্যে একাধিক বক্তব্য থাকলে এবং বক্তব্যসমূহ শুধু কমা দিয়ে স্পষ্ট করা সম্ভব না হলে কিংবা কমার বহুল উপস্থিতি ‘কমা-বিভ্রাট’ সৃষ্টি করলে সেমিকোলন বসাতে হয়। যেমন : বললাম, থামুন, তিনি থামলেন না, থামতে চান না; আবার ডাকলাম, তিনি পেছনে না তাকিয়ে হনহন করে চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
২. কোনও বাক্যের বাক্যাংশগুলো ‘যদিও, নয়তো, নতুবা, কিংবা, তা ছাড়া, পক্ষান্তরে, উপরন্তু’ ইত্যাদি সংযোজক অব্যয় দিয়ে শুরু হলে মধ্যখানে সেমিকোলন বসে। যেমন : জাফর মোটেও অভদ্র নয়; বরং তুমিই তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছ।
৪. নাম, পদ, গুণ ইত্যাদির শ্রেণি বিন্যাসে সমপ্রকৃতির বিষয়গুলোকে সেমিকোলন দিয়ে একত্রে রাখা হয়। যেমন : আম, জাম, লিচ; গরু, ছাগল, ভেড়া; হাস, মুরগি, কোয়েল; বই, খাতা, কাগজ; সবকিছু কেনা হয়েছে।
৫. অভিধানে বিভিন্ন সমার্থক শব্দকে কিঞ্চিৎ ভিন্নার্থক শব্দ হতে কিংবা ভিন্নার্থের শব্দগুলোকে পরস্পর হতে পৃথক করার জন্য সেমিকোলন ব্যবহার করা হয়।
৬. বাক্যের এক অংশের বক্তব্য অস্পষ্ট বা অসম্পূর্ণ থাকলে সেমিকোলন দিয়ে পরবর্তী বাক্যাংশে তা সম্পূর্ণ বা স্পষ্ট করা হয়। যেমন : আমি শেষ; একমাত্র বাড়িটা ছিল, তাও নিলাম হয়ে গেল, এখন কী করি।
২. আইনের কোনও ধারায় এক বা একাধিক উপধারা কিংবা শর্ত থাকলে তা পৃথককরণের জন্য সেমিকোলন ব্যবহার করা হয়।
৩. কোনও তালিকায় বিদ্যমান একাধিক ব্যক্তির নাম ও পদের তালিকা অনুধাবনের সুবিধার্থে সেমিকোলন ব্যবহার করা হয়। যথা: গঠিত কমিটিতে সভাপতি, মোহাম্মদ আজমল; সহ-সভাপতি, নুর উদ্দীন; সাধারণ সম্পাদক, হামদে আলী;..
৫. কোলন (:): বাংলায় কোলন (:) চিহ্নের আগমন পঞ্চাশ-ষাট বছরের বেশি নয়। তাই অনেকের কাছে চিহ্নটির ব্যবহার পরিষ্কার নয়। তবে ইংরেজিতে চিহ্নটির ব্যাপক ব্যবহার দেখা যায়। আগে যে সকল স্থান ও ক্ষেত্রে ড্যাশ (-) বা কোলন ড্যাশ (:-) চিহ্ন দেওয়া হতো, বর্তমানে সেসব স্থান বা ক্ষেত্রসমূহে কোলন (:) ব্যবহার করা হয়। সুতরাং কোলন চিহ্নটি ড্যাশ বা কোলন ড্যাশের বিকল্প চিহ্নমাত্র। কেউ ইচ্ছে করলে কোলন চিহ্নের পরিবর্তে ড্যাশ বা কোলন দিতে পারেন।
কোলন পদের সঙ্গে সেঁটে বসবে না কি পৃথক বসবে?
কোলন (:) বাক্যস্থ পদের সঙ্গে সেঁটে লিখবেন না কি ফাঁক রেখে লিখেবেন? এ বিষয়ে কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। অনেকে বলেন ফাঁক রেখে লেখা উত্তম। যেমন— আমরা চার ভাই। যথা : করিম, রহিম, কামাল ও জামাল। তবে, কম্পিউটার কম্পোজের সময় বাক্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে দ্বিতীয় লাইনে চলে যায়। সেখানে পদের সঙ্গে কোলনকে সেঁটে না লিখলে ওই কোলন দ্বিতীয় লাইনে গিয়ে একটি বিচ্ছিন্ন চিহ্নের মতো অবস্থান করবে। যেমন: রহিম আমার বন্ধু। আমরা সেদিন দুজন রাতে এক পথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম আমরা চার ভাই। যথা : করিম, রহিম, কামাল ও জামাল যথা : করিম, রহিম, কামাল ও জামাল। এক্ষেত্রে কোলনচিহ্নটি প্রথম পদের সঙ্গে সেঁটে এবং দ্বিতীয় পদ থেকে ফাঁক রেখে লেখা উচিত। যেমন: আমরা চার ভাই। যথা: করিম, রহিম, কামাল ও জামাল।
কোলনের ব্যবহার: বাক্যের অর্ন্তগত কোনও অংশকে বিশদ করাই কোলনের দায়িত্ব। বাক্যে কোলনের পূর্ববর্তী যেসব বিশেষ্য, সর্বনাম বা বিশেষণপদ সরবরাহ করার কথা বলা হয়েছে, কোলনের পরবর্তী অংশে সেগুলো উপস্থাপন করা হয়। যেমন— সার্ক সম্মেলনে যে সাতটি রাষ্ট্র যোগ দিয়েছে, সেগুলো হলো : শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, নেপাল, মালদ্বীপ, ভারত, ভুটান ও বাংলাদেশ।
১. বাক্যেও কোনও অংশে বক্তা উদাহরণস্বরূপ ব্যক্তি বা বস্তু ইত্যাদির কথা ব্যক্ত করতে চাইলে সে ব্যক্তি বা বস্তুর নাম বিধৃত করার সুবিধার্থে কোলন ব্যবহার করা হয়। যেমন : বিশিষ্ট কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে: আহমদ ছফা, ফররুখ আহমদ, আহমদ মুসা এবং আহমেদ হুমায়ুন, আহমদ কামাল, আহমদ শরীফ, আহমদ ইকবাল, আহমদ রেজা প্রমূখ আহমদ গোষ্ঠীর বুদ্ধিজীবী নামে পরিচিত।
২. উদ্ধৃতির আগে কোলন চিহ্নের ব্যবহার লক্ষণীয়। যেমন— সিরাজ বললেন: মূর্খ মানুষ পশুর চেয়ে নিকৃষ্ট।
৩. সময় প্রকাশে কোলন ব্যবহার করা হয়। যেমন— ১০:০৬ মিনিটের সময় বজ্রপাত ঘটে। তাপাঙ্ক শূন্যের নিচে নেমে গেলে তা আমরা ড্যাশ দিয়ে প্রকাশ করি।
অনেকে কোলন (:) চিহ্নকে বিসর্গ (ঃ) অক্ষরের সঙ্গে অভিন্ন মনে করেন। এটি ঠিক নয়। বিসর্গ একটি অক্ষর কিন্তু কোলন একটি চিহ্ন।
৬. হাইফেন (-): বাংলায় বহুল ব্যবহৃত যতিচিহ্নের মধ্যে হাইফেন (-) অন্যতম। বাক্যের সঙ্গে নয়, মূলত শব্দের সঙ্গে শব্দের সম্পর্ক সৃষ্টি করে একাধিক শব্দকে এক শব্দ হিসেবে চিহ্নিত করাই হাইফেনের কাজ। এর আর একটি উদ্দেশ্য সহজবোধ্যতা প্রদান। হাইফেন দেখতে ড্যাশের(—) মতো হলেও দৈর্ঘ্যে হাইফেন(-), ড্যাশের চেয়ে বেঁটে। এর ব্যবহার প্রকৃত অর্থে বিরামচিহ্নের মতো নয়। সাধারণত উচ্চারণের সুবিধা প্রদানের উদ্দেশ্যে শব্দকে সহজবোধ্য করার লক্ষ্যে সমাসবদ্ধ পদে বর্ণসমষ্টির সংযোগ প্রকাশের জন্য হাইফেন ব্যবহার করা হয়।যেমন: যে-কেহ। যে-কোনো। যে-কোনোটা। যে-কোনোরকম।যে-কোনোরকমে। যে-কে-সেই। আম-জাম-কাঁঠাল-কলা। এছড়াও হাইফেনের আরও অনেক ব্যবহার রয়েছে। হাইফেন তার অব্যবহিত পূর্ববর্তী ও পরবর্তী উভয় শব্দের সঙ্গে সেঁটে বসে। যেমন: হাত- ফেরতা বা হাত -ফেরতা বা হাত – ফেরতা নয়; হাত-ফেরতা। তেমনি: হাত-পা। সদর-অন্দর। নিচে যতিচিহ্নের চৌদ্দটি ব্যবহার দেওয়া হলো:
বাকীগুলো দেখার জন্য দেখুন : হাইফেন/ যতিচিহ্নের ব্যবহার সংশ্লিষ্ট লিংক: এই লেখায় ক্লিক করলে বাকিগুলো দেখা যাবে।
৭. ড্যাশ (—): বাক্যে বিধৃত কোনও বিবৃতি সম্পূর্ণ করতে কিংবা বিশদ করতে ড্যাশচিহ্নের ব্যবহার করা হয়। ড্যাশ এবং হাইফেন একই রকম হলেও ড্যাশ হাইফেনের চেয়ে একটু লম্বা। সাধারণত বাক্যে সংশ্লিষ্ট উদাহরণ বিস্তারিতভাবে উপস্থাপনের জন্য ড্যাশ ব্যবহার করা হয়। যেমন: কাল তিন প্রকার, যথা— বর্তমান, অতীত ও ভবিষ্যৎ। এখানে যথা শব্দের পরের চিহ্নটি (—)। নিচে ড্যাশ-এর বিস্তারিত ব্যবহার দেওয়া হলো—
৮. কোলন ড্যাশ (:—): কোলন (:) আর ড্যাশ (—) মিলে কোলন ড্যাম। বাংলায় আগের এর বহুল ব্যবহার ছিল। এখন অনেক কমে গেছে। সাধারণত যেখানে কোলন প্রয়োজন সেখানে কেউ কেউ কোলন ড্যাশ ব্যবহার করতেন। নিচের কোলন ড্যাশের ব্যবহার দেওয়া হলো—
১. বাক্যের কোনও অংশকে বিশদ করার জন্য কোলন ড্যাশ (:—) ব্যবহার করা হয়। যেমন:
সত্যবাদী ছড়ায় লেখা আছে:—
“মিথ্যা বলা মহাপাপ,
চরমতর অভিশাপ।
মিথ্যা কথা যারা কয়
তারা কোন মানুষ নয়।”
৩. কোলন ড্যাসের পরিবর্তে শুধু কোলন দিয়ে লেখা যায়। যেমন— লিঙ্গ দুই প্রকার। যথা:— পুংলিঙ্গ এবং স্ত্রীলিঙ্গ।
৯. প্রশ্নচিহ্ন (?): প্রশ্নবোধক বাক্যে প্রশ্নচিহ্ন দিয়ে বাক্য শেষ করা হয়। প্রশ্নবোধক বাক্যে প্রশ্নচিহ্ন না দেওয়া হলে তা আর প্রশ্নবোধক বাক্য থাকে না। প্রশ্নচিহ্ন সাধারণত বাক্যের শেষে বসে। যথা: তুমি কোথায় যাচ্ছো? আমি যাব> আমি যাব? তবে কোনও বক্তব্য কিংবা বক্তব্যের অংশবিশেষ নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থাকলে সংশ্লিষ্ট অংশের পর প্রথমবন্ধনী দিয়ে প্রশ্নচিহ্ন বসানো হয়। যথা: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯৯২(?) খ্রিস্টাব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। পরোক্ষ প্রশ্নযুক্ত বাক্যে প্রশ্নচিহ্ন ব্যবহার করা উচিত নয়। যেমন: সারাদিন এত শ্রম কী করে যে সম্ভব তা বুঝি না।
১০. বিস্ময়চিহ্ন (!): বিস্ময়সূচক বাক্যের শেষে চিহ্নটি (!) ব্যবহার করা হয়। তাছাড়া কোনও বাক্যের গভীর আবেদন, অবিশ্বাস, জোরালো অনুভূতি, সাংঘাতিক কষ্ট, আবেগ, অনুভূতি প্রভৃতি প্রকাশের জন্য বিস্ময়চিহ্ন ব্যবহার করা হয়। বিস্ময়চিহ্ন শুধু বাক্যের সমাপ্তি বুঝায় না, বরং বাক্যের উচ্চারণেও নির্দেশনা দেয়। যেমন: হায় আল্লাহ! এবং হায় আল্লাহ। এই দুটো বাক্যের উচ্চারণ একই রকম নয়। প্রথম বাক্যটি বিস্ময়তার সঙ্গে কিন্তু দ্বিতীয় বাক্যটি সাধারণভাবে উচ্চারিত হবে।
১১. ঊর্ধ্বকমা (’): ঊর্ধ্বকমার ব্যবহার ইদানীং নেই বললেই চলে। অসমাপিকা ক্রিয়ায় ঊর্ধ্বকমা দেওয়ার নজির থাকলেও বর্তমানে তা অনাব্যশক ও বাহুল্য বলে বিবেচিত। শতাব্দকে অঙ্কে প্রকাশের সময় সংক্ষেপণ চিহ্ন হিসেবে ঊর্ধ্বকমা ব্যবহার করা হয়। যেমন : ২১ ফ্রেব্রুয়ারি ‘৫২ খ্রিস্টাব্দ প্রভৃতি।
১২. বিকল্পচিহ্ন (/): দুই বা ততোধিক শব্দ বা বাক্যের মধ্যে যে কোনটি হতে পারে বুঝানোর জন্য বিকল্পচিহ্ন ব্যবহার করা হয়। উদাহরণ :
১. যন্ত্রটি ঢাকা/চট্টগ্রাম শহরে পাওয়া যাবে।
২. প্রশ্নে একাধিক বিকল্প উত্তর হতে ঠিক উত্তরটা বের করার কৌশলে বিকল্প চিহ্ন ব্যবহার করা হয়। যেমন : আমাদের জাতীয় কবি কে? রবীন্দ্রনাথ/ মধুসূদন/নজরুল/ জীবনানন্দ।
৩. কবিতার লাইনকে প্রকাশ করতে বিকল্পচিহ্ন দেওয়া হয়। যেমন: চিরসুখী জন/ভ্রমে কি কখন/ ব্যথিত বেদন…।
১৪. ত্রিবিন্দুচিহ্ন বা এলিপসিস (. . .):
১. বাক্যের বা উদ্ধৃতির কোনও অংশ বাদ দেওয়া হয়েছে বুঝাতে ত্রিবিন্দু ব্যবহার করা হয়। কারও বক্তব্য বা কোনও রচনা সম্পূর্ণ উল্লেখ না করে কিয়দংশ বাদ দেওয়া হলে বর্জিত অংশগুলোর স্থানে ত্রিবিন্দুচিহ্ন ব্যবহার করা হয়। যথা : তিনি লিখেছেন, “আমি আর এদেশে থাকব না।… যে দেশে বিচার … সে দেশে না থাকাই উত্তম।”
২. কথা/বাক্য অসমাপ্ত রেখে দেওয়া হয়েছে বুঝাতে ত্রিবিন্দু ব্যবহৃত হয়। যথা: ইন্নালিল্লাহে … রাজেউন। পরের কারণে… আপনার কথা…।
৩. কেউ যখন আমতা-আমতা করে বলেন, কিংবা বাক্য শুরু করেও শেষ করেন না কিংবা শেষ করার সুযোগ পান না তখন, তা বুঝানোর জন্য ত্রিবিন্দুচিহ্ন ব্যবহার করা হয়।
১৫. একক উদ্ধৃতিচিহ্ন: একক বাক্যে কোনো পদ বা বিষয়কে পৃথকভাবে নির্দেশিত করে তার গুরুত্ব বা দৃষ্টি আকর্ষ নির্দেশের জন্য একক-উদ্ধৃতিচিহ্ন ব্যবহার করা হয়। যেমন:
১ .কোনও বাক্যে ব্যবহৃত গ্রন্থ, পত্রিকা ইত্যাদির উপর উদ্ধৃতিচিহ্ন দেওয়া হয়। যেমন: রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা’ একটি উপন্যাস। ‘সমাচার দর্পন’ একটি পত্রিকা।
২. বাক্যে কোনও শব্দ বা বিষয়কে গুরুত্ব দিতে কিংবা গুরুত্ব প্রকাশ করার প্রয়োজন হলে উদ্ধৃতিচিহ্ন দেওয়া হয়। যেমন: সাহিত্যিক ‘যাযাবরের’ ‘দৃষ্টিপাত’ গ্রন্থটি পড়লে তুমি বুঝতে পারবে ‘প্রেম’ কী।
৪. উদ্ধৃতির মধ্যে ‘উদ্ধৃতি’ বসানোর প্রয়োজন হতে পারে। সেক্ষেত্রে তিনটি উদ্ধৃতিচিহ্ন ব্যবহার করতে হয়। যেমন : “শিক্ষক বললেন,

‘তোমার নাম কী?’”
৫. অনেক সময় একাধিক অনুচ্ছেদকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রাখতে হয়। সেক্ষেত্রে উদ্ধৃতি শুরুর স্থানে উদ্ধৃতিচিহ্ন বসানো হয়। পরবর্তী অনুচ্ছেদের প্রারম্ভে আবার উদ্ধৃতিচিহ্ন বসে। এভাবে ক্রমান্বয়ে যেতে থাকে এবং উদ্ধৃতিভুক্ত সর্বশেষ অনুচ্ছেদের যেখানে উদ্ধৃতি শেষ হয় সেখানে সমাপ্তি উদ্ধৃতি দেওয়া হয়।
যেমন: “আমার পক্ষে এখানে থাকা সম্ভব নয়। মানুষের জন্য মানুষের যে বোধটুকু থাকা আবশ্যক তা কারো নেই।
“না থাক, কিন্তু তা আয়ত্বে আনার প্রয়াসকে যারা খারাপ চোখে দেখে, নিরুৎসাহ দিয়ে মানবতাকে পদদলিত করে, তারা মানুষ নয়।
‘তো কী?
“পশ্বাধম পশু, আমি তাদের ঘৃণা করি।”
১৬. জোড় উদ্ধৃতিচিহ্ন: জোড়-উদ্ধৃতি ও একক-উদ্ধৃতির মধ্যে পার্থক্য থাকলেও অনেকে দুটির ব্যবহার সম্পর্কে সচেতন থাকেন না। দুটির ব্যবহার ভিন্ন। নিচে তা বলা হলো:
১. প্রত্যক্ষ উক্তি প্রকাশে জোড় উদ্ধৃতিচিহ্ন ব্যবহার করা হয়। যেমন: আকবর বললেন, ‘‘আমি দিল্লির সম্রাট।”
২. কোনো ব্যক্তির উদ্ধৃতি অবিকল তুলে ধরার ক্ষেত্রে জোড় উদ্ধৃতি ব্যবহার করা হয়। যেমন: মীর মশাররফ হোসেন লিখেছেন, “মাতৃভাষার প্রতি যার শ্রদ্ধা নেই সে মানুষ নহে।”
৩. বাক্যের ক্ষেত্রে জোড় উদ্ধৃতি এবং পদ বা বাক্যাংশের ক্ষেত্রে একক উদ্ধৃতি ব্যবহার করা হয়।
১৭. প্রথম বন্ধনী ( ): বন্ধনী চিহ্ন তিন প্রকার। যেমন: প্রথম বা বক্র বন্ধনী ( ), দ্বিতীয় বা গুম্ফ বন্ধনী { } এবং তৃতীয় বা সরল বন্ধনী [ ]। মূলত গণিত শাস্ত্রে এগুলো ব্যবহৃত হলেও বিশেষ ব্যাখ্যামূলক অর্থে সাহিত্যে প্রথম বন্ধনী ব্যবহৃত হয়। তবে সাহিত্যে দ্বিতীয় বন্ধনীর ব্যবহার নেই। এর ব্যবহার নিচে দেওয়া হলো:
১. কোনো বক্তব্যকে বিশদ করা প্রয়োজন হলে প্রথম বন্ধনী ব্যবহার করা হয়। যেমন: জাফর ও রাজীব আমাকে কামালের সঙ্গে যেতে বলেছেন। সে (কামাল) আমার প্রতিবেশি।
২. প্রয়োজনে এক বা একাধিক শব্দ বা বাক্যকে প্রথম বন্ধনীর মধ্যে রেখে আরও বিশদ করা হয়। যেমন: ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বহুভাষাবিদ পণ্ডিত (ইংরেজি, ফারসি, হিন্দি; সম্ভবত জার্মানও জানতেন) ছিলেন।
৩. কোনও বক্তব্য কিংবা বক্তব্যের অংশবিশেষ নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থাকলে সংশ্লিষ্ট অংশের পর প্রথমবন্ধনী দিয়ে প্রশ্নচিহ্ন বসান হয়। যথা: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯৪৩(?) খ্রিষ্টাব্দে মারা যান।
১৮. তৃতীয় বন্ধনী: বাংলা ভাষায় তৃতীয় বন্ধনীর ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উদ্ধৃতির ব্যাখ্যা বা জটিলতা এড়ানোর জন্য উদ্ধৃতিস্থ বাক্যের কোনও শব্দ বা শব্দাবলির শুদ্ধরূপ তৃতীয় বন্ধনীর মধ্যে দেওয়া হয়। উৎসমূলে যা লেখা আছে সেটি ভুলসহ উদ্ধৃত করে শুদ্ধটি তৃতীয় বন্ধনীর মধ্যে লিখে দিলে অনেক জটিলতা ও সংশয় এড়ানো যায়। তাহলে পাঠক মূল উদ্ধৃতি এবং শুদ্ধ দুটিই জানতে পারেন। যেমন : কোনও গ্রন্থে লেখা আছে— ‘মাইকেল মুধুসুদন দত্ত যশোড় জেলার সাঘরদাড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।’ এ বাক্যটিকে উদ্ধৃতি দিয়ে লেখা হয়েছে- “মাইকেল মুধুসুদন [মধুসূদন] দত্ত যশোড় [যশোর] জেলার সাঘড়দাড়ি [সাগরদাড়ি] গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন”। কোনো বিষয়ে একাধিক ব্যখ্যার প্রয়োজন হলে এবং প্রথম বন্ধনী দিয়ে তা পর্যাপ্ত মনে না হলে তৃতীয় বন্ধনী দিতে হয়। যেমন: নজরুলের (বিদ্রোহী কবি) প্রথম গদ্য রচনা “বাউণ্ডুলের আত্মকাহিনী” [প্রকাশ ১৯১৯, পত্রিকা সওগাত] একটি অসাধারণ গল্প।
১৯. ইলেক বা লোপচিহ্ন বা উর্ধ্বকমা: ঊর্ধ্বকমার ব্যবহার আগে প্রবলভাবে দেখা যেত। কোনও শব্দে, বিশেষ করে কবিতায় যদি কোনও অক্ষর ইচ্ছে করে বাদ দেওয়া হতো তখন ঊর্ধ্বকমা দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া হতো যে, এখানে একটি অক্ষর বাদ দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে কবিতায় এ ধরনের প্রয়োগ

তেমন দেখা যায় না। দ্বিতীয়ত : ক্রিয়াপদের চলিত রূপ লেখার সময় ঊর্ধ্বকমা খুব বেশি ব্যবহার করা হতো। যেমন: হ’ল (হইল)। আবার সংখ্যা লেখার সময়ও এর ব্যবহার দেখা যেত। যেমন : দু‘(দুই), শ‘(শত) ইত্যাদি। ইদানীং ঊর্ধ্বকমার ব্যবহার উভয় বাংলায় ব্যাপকভাবে কমে গিয়েছে। প্রমিত বাংলায় ঊর্ধ্বকমার ব্যবহার নিরুৎসাহিত করা হয়।
তবে ঊর্ধ্বকমা না দিলে যদি অর্থ বা উচ্চারণে জটিলতা সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে সেক্ষেত্রে এটি ব্যবহার করা উচিত। যেমন :
১. হাইফেনের বিকল্প হিসেবে: পা’টা সরাও [এখানে ঊর্ধ্বকমা না-দিলে পা কিন্তু পাটা হয়ে যেতে পারে]।
তুমি কা’কে ভালবাস? (এখানে উর্ধ্বকমা না-দিলে কাহাকে শব্দটি ‘কাকে’ বুঝাতে পারে।)
আমার মা’র অসুখ। (এখানে ঊর্ধ্বকমা না-দিলে মা কিন্তু মার বুঝানোর আশঙ্কা হেসে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।)
মুলা’র ক্ষেতে পানি দিতে হবে। (মুলা’র শব্দে ঊর্ধ্বকমা না-দিলে এটি মুলার নামের কোনও ব্যক্তিকে বুঝাতে পারে।)
চা’র কাপ (এখনে ঊর্ধ্বকমা না-দিয়ে বাকটি হয়ে যেতে পারে— “চার কাপ”।)
২. সাল বা খ্রিষ্টাব্দের বর্জিত সংখ্যা প্রকাশে: ২১ ফেব্রুয়ারি, ’৫২।
উপসংহারে বলা যায়, বাক্যে এক বা একাধিক বর্ণকে বর্জন করা হলে, তা প্রকাশের জন্য বর্জিতস্থানে ইংরেজি ভাষায় অ্যাপসট্রফি বলে পরিচিত (’) লোপচিহ্নটি ব্যবহৃত হয়। বাংলায় একে ‘ঊর্ধ্বকমা’ বলা হয়। আধুনিক-প্রমিত বানানে ‘ঊর্ধ্বকমা’ বর্জনীয়। তাই ঊর্ধ্বকমা ব্যবহার না করা বাঞ্ছনীয়।
২০ . সমানচিহ্ন: একটি শব্দ অর্থে বা বর্ণনায় নির্দেশিত বিষয়ে অভিন্ন প্রকাশে সমান চিহ্ন ব্যবহার করা হয়। যেমন: সূর্য= রবি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দে (= ১২৬৮ বঙ্গাব্দ) জন্মগ্রহণ করেন।
২১. ধাতু দ্যোতক চিহ্ন (√): শব্দের ব্যুৎপত্তি বিশ্লেষণ, সন্ধি বা প্রকৃতি-প্রত্যয়ে কোনটি ধাতু তা স্পষ্টভাবে দেখানোর জন্য ধাতু দ্যোতক চিহ্ন (√) ব্যবহার করা হয়। যেমন: তৎসম ‘সহপাঠী’ শব্দের ব্যুৎপত্তি হচ্ছে, সহ+√পঠ্+ইন্। কমণ্ডলু= (ক+√মণ্ড্+অলু)।
২২. পরবর্তী রূপবোধক চিহ্ন (<): শব্দের বিবর্তনে কোনটির পর কোনটি এসেছে বা প্রথমিটর পরর্বতী রূপ কী তা নির্দেশ করার জন্য পরবর্তী রূপবোধক চিহ্ন (<) ব্যবহৃত হয়। যেমন: হাত< হত্থ< হস্ত; চাঁদ<চন্দ<চন্দ্র। চামার<চম্মআর< চামার।
২৩. পূর্ববর্তী রূপবোধক চিহ্ন (>): একটি শব্দের পূর্ববর্তী রূপ কী তা নির্দেশের জন্য পূর্ববর্তী রূপবোধক চিহ্ন (>) ব্যবহার করা হয়। যেমন: সংস্কৃত > প্রাকৃত > তদ্ভব। মৎস> মচ্ছ> মাছ। দুগ্ধ, দুদ্ধ> দুধ। বাংলা ভাষা বিবর্তনের রূপরেখা: ইন্দো-ইউরোপীয় > সতম > আর্য > ভারতীয় > প্রাচীন ভারতীয় আর্য > প্রাচীন ভারতীয় কথ্য আর্য > সংস্কৃত > গৌড়ি প্রাকৃত > তদ্ভব(বাংলা)
২৪. উচ্চারণচিহ্ন / /: উচ্চারণচিহ্ন (/ /) শব্দের উচ্চারণ নির্দেশ করে। কোনো শব্দের উচ্চারণ কেমন তা বানানের পাশে লিখলে বানান ও উচ্চারণের পার্থক্য নির্দেশের জন্য উচ্চারণ-বানানের উভয় পাশে চিহ্নটি দেওয়া হয়। যেমন: অশ্বত্থ শব্দের উচ্চারণ : অশ্শত্থো। এটি লেখা হয়: অশ্বত্থ /অশ্শত্থো/। অনুরূপ: এতদ্ব্যতীত /এতোদ্বেতিতো/, ঔর্ণনাভ /অউ্র্নোনাভো/, তদ্ব্যতীত / তদ্বেতিতো, উদ্বোধন / উদ্বোধোন্/ , বিদ্বান /বিদ্দান্/, বিদ্বিষ্ট/বিদ্দিশ্টো/, বিদ্বেষ/বিদ্দেশ্/, বিদ্বত্তম/বিদ্দত্তম/, উদ্বুদ্ধ /উদ্বুদ্ধো/।
২৫. যোগচিহ্ন: সন্ধি বা সংখ্যায় যোগচিহ্ন ব্যবহার করা হয়। যেমন: বিদ্যা+আলয়= বিদ্যালয়, ৭+৫= ১২।
বিভিন্ন যতিচিহ্নের বিরতিকাল: কমায় (,) সাধারণভাবে ১ (এক) বলতে যে সময় প্রয়োজন সে পরিমাণ সময় এবং সেমিকোলনে (;) কমার দ্বিগুণ সময় বিরতি দিতে হয়। দাঁড়ি (।), প্রশ্নচিহ্ন(?), বিস্ময়চিহ্ন (!), কোলন (:), কোলন-ড্যাশ (:-), ড্যাশ (—) প্রভৃতি যতিচিহ্নের প্রত্যেকটিতে এক সেকেণ্ড করে থামতে হয়। প্রথম বন্ধনী, দ্বিতীয় বন্ধনী, তৃতীয় বন্ধনী, হাইফেন (-) ও ইলেক বা লোপচিহ্নে (’) থামার প্রয়োজন নেই।
বিসিএস প্রিলি থেকে ভাইভা কৃতকার্য কৌশল
ড. মোহাম্মদ আমীনের লেখা বইয়ের তালিকা
বাংলাদেশ ও বাংলাদেশবিষয়ক সকল গুরুত্বপূর্ণ সাধারণজ্ঞান লিংক
বাংলা বানান কোথায় কী লিখবেন এবং কেন লিখবেন/১
কি না বনাম কিনা এবং না কি বনাম নাকি
মত বনাম মতো : কোথায় কোনটি এবং কেন লিখবেন
মত বনাম মতো : কোথায় কোনটি এবং কেন লিখবেন