ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের যমক
অভিজিৎ অভি
কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত(১৮১২-১৮৫৯) বাংলা সাহিত্যের একজন গুণী কাব্যশিল্পী। তাঁর লেখায় বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগ উভয় যুগের প্রভাব দেখা যায় এবং তাই তাঁকে যুগসন্ধিক্ষণের কবি বলা হয়।
যমক (একই বর্ণসমষ্টি একাধিকবার একাধিক অর্থে প্রয়োগ করা) ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের একটি প্রিয় কাব্যকৌশল। তাঁর কতগুলি যমকের নমুনা দেখলেই তা বোঝা যায়-
১। অতনু শাসনে তনু তনু অনুদিন (১ম তনু= দেহ, ২য় তনু= কৃশ)
২। ভাবে নাহি ভাবি ভাবি (১ম ভাবি= ভাবনা করি, ২য় ভাবি= ভবিষ্যৎ)

৩। আনা দরে আনা যায় কত আনারস (১ম আনা= টাকার ১/১৬ অংশ, ২য় আনা= আনয়ন করা)
৪। প্রকাশিয়া প্রভাকর শুভ দিন দিন (১ম দিন= দিবস, ২য় দিন= প্রদান করুন)
৫। মিথ্যার কাননে কভু ভ্রমে নাহি ভ্রমে (১ম ভ্রমে= ভুলে, ২য় ভ্রমে= ভ্রমণ করে)
৬। দুহিতা আনিয়া যদি না দেহ, নিশ্চয় আমি ত্যাজিব দেহ (১ম দেহ= প্রদান কর, ২য় দেহ= শরীর)
মজার ব্যাপার, এই বিস্ময়কর যমকপ্রতিভাকে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এভাবে সমালোচনা করেন- “দাশরথি রায় অনুপ্রাস যমকে বড় পটু—তাই তাঁর পাঁচালি লোকের এত প্রিয় ছিল। দাশরথি রায়ের কবিত্ব না ছিল, এমন নহে, কিন্তু অনুপ্রাস যমকের দৌরাত্ম্যে তাহা প্রায় একেবারে ঢাকা পড়িয়া গিয়াছে ; পাঁচালিওয়ালা ছাড়িয়া তিনি কবির শ্রেণীতে উঠিতে পান নাই। এই অলঙ্কার প্রয়োগে পটুতায় ঈশ্বর গুপ্তের স্থান তার পরে—এত অনুপ্রাস যমক আর কোন বাঙ্গালীতে ব্যবহার করে নাই। এখানেও মার্জিত রুচির অভাব জন্য বড় দুঃখ হয়।
অনুপ্রাস যমক সর্বত্রই দুষ্য এমন কথা আমি বলি না। ইংরেজিতে ইহা বড় কদর্য শুনায় বটে, কিন্তু সংস্কৃতে ইহার উপযুক্ত ব্যবহার অনেক সময়েই বড় মধুর। কিছুরই বাহুল্য ভাল নহে—অনুপ্রাস যমকের বাহুল্য বড় কষ্টকর। রাখিয়া ঢাকিয়া, পরিমিত ভাবে ব্যবহার করিতে পারিলে বড় মিঠে। বাঙ্গালাতেও তাই। মধুসূদন দত্ত মধ্যে মধ্যে অনুপ্রাসের ব্যবহার করেন,—বড় বুঝিয়া সুঝিয়া, রাখিয়া ঢাকিয়া, ব্যবহার করেন—মধুর হয়। শ্রীমান্ অক্ষয়চন্দ্র সরকার গদ্যে কখন কখন, দুই এক বুঁদ অনুপ্রাস ছাড়িয়া দেন—রস উছলিয়া উঠে। ঈশ্বর গুপ্তেরও এক একটি অনুপ্রাস বড় মিঠে—
বিবিজান চলে জান লবেজান করে।
ইহার তুলনা নাই। কিন্তু ঈশ্বর গুপ্তের সময় অসময় নাই, বিষয় অবিষয় নাই, সীমা সরহদ্দ নাই—একবার অনুপ্রাস যমকের ফোয়ারা খুলিলে আর বন্ধ হয় না। আর কোন দিকে দৃষ্টি থাকে না, কেবল শব্দের দিকে। এরূপ শব্দ ব্যবহারে তিনি অদ্বিতীয়। তিনি শব্দের প্রতিযোগীশূন্য অধিপতি।”
অভিজিৎ অভি, শুদ্ধ বানান চর্চা (শুবাচ)
বাংলাদেশ ও বাংলাদেশবিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ সাধারণজ্ঞান লিংক