কীভাবে হলো দেশের নাম (ইউরোপ)
ড. মোহাম্মদ আমীন
যুক্তরাজ্য (United Kingdom)
যুক্তরাজ্য ইউরোপীয় মূল ভূখণ্ডের উত্তর-পশ্চিম উপকূলের সন্নিকটে অবস্থিত একটি স্বাধীন দ্বীপরাষ্ট্র। রাষ্ট্রটির সরকারি নাম The United Kingdom

of Great Britain and Northern Ireland । রাষ্ট্রটি চারটি সাংবিধানিক রাষ্ট্র: ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, ওয়েল্স্ এবং উত্তর আয়ারল্যান্ড-এর সমন্বয়ে গঠিত। চারটি সাংবিধানিক রাষ্ট্র যুক্ত হয়ে গঠিত। তাই এর নাম যুক্তরাজ্য।
যুক্তরাজ্য অনেকগুলো দ্বীপ নিয়ে গঠিত। দ্বীপগুলোকে একত্রে ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জ নামে অভিহিত করা হয়। এদের মধ্যে সর্ববৃহৎ দ্বীপটির নাম বৃহৎ ব্রিটেন বা গ্রেট ব্রিটেন। গ্রেট ব্রিটেনের সবচেয়ে বড় ও জনবহুল ভাগটির নাম ইংল্যান্ড, যা দ্বীপের দক্ষিণ ও পূর্ব অংশ গঠন করেছে। পশ্চিম অংশে আছে ওয়েলস এবং উত্তরে স্কটল্যান্ড। আয়ারল্যান্ড দ্বীপের উত্তর-পূর্ব প্রান্তে উত্তর আয়ারল্যান্ড অবস্থিত। আয়ারল্যান্ড দ্বীপ ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের ২য় বৃহত্তম দ্বীপ। এই দ্বীপের সিংহভাগ জুড়ে অবস্থিত আয়ারল্যান্ড প্রজাতন্ত্রের সাথে যুক্তরাজ্যের একমাত্র স্থল সীমান্ত রয়েছে। যুক্তরাজ্যের বাকী অংশকে আটলান্টিক মহাসাগর, উত্তর সাগর, ইংলিশ চ্যানেল এবং আইরিশ সাগর ঘিরে রেখেছে। গ্রেট ব্রিটেন দ্বীপটি চ্যানেল টানেলের মাধ্যমে ফ্রান্সের সাথে যুক্ত। এছাড়াও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকালীন সময়ে হস্তগত ১৪টি বহিঃস্থ এলাকা এখনও যুক্তরাজ্যের অধীনে রয়েছে।
ব্রিটেন একটি সাংবিধানিক প্রজাতন্ত্র। রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ রাষ্ট্রপ্রধান। এখানে একটি সংসদীয় গণতন্ত্র ব্যবস্থা বিদ্যমান। লন্ডন শহর যুক্তরাজ্যের রাজধানী; এটি ইংল্যান্ডের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত। সমগ্র যুক্তরাজ্যকে ব্রিটেন নামেও ডাকা হয়। তবে গ্রেট ব্রিটেন নামটি আর সমগ্র দেশটিকে বোঝাতে ব্যবহার করা হয় না; এটি কেবল গ্রেট ব্রিটেন দ্বীপকে বোঝাতে ব্যবহার করা হয়। ইংল্যান্ড দিয়েও সমগ্র যুক্তরাজ্যকে বোঝানো হয় না। ইংল্যান্ড,

স্কটল্যান্ড ও ওয়েলসের অধিবাসীরা সবাই ব্রিটিশ। আবার ইংল্যান্ডের অধিবাসীরা ইংরেজ, ওয়েলসের অধিবাসীরা ওয়েলশ এনং স্কটল্যান্ডের অধিবাসীরা স্কটিশ নামে পরিচিত।
ইংল্যান্ড শব্দের অর্থ ল্যান্ড অব এঙ্গেলস (Land of the Angles) বা কোণভূমি। প্রাচীন ইংরেজি ইঙলাল্যান্ড (Englaland) হতে ইংল্যান্ড শব্দের উৎপত্তি। জার্মানিক উপজাতির লোকেরা ৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম শব্দটি ব্যবহার শরু করে। ল্যাটিন এ্যাঞ্জিলি (Anglii) হতে অ্যাঞ্জেল শব্দের উদ্ভব। পরবর্তীকালে শব্দটির আরও বিবর্তন ঘটে। অনেকে মনে করেন, অ্যাঙ্গুয়াল (Angul) হতে ইংল্যান্ড নামের বিকাশ। পূর্ব জুটল্যান্ডের অ্যাংলেন উপদ্বীপকে অ্যাঙ্গুয়াল বলা হয়। এর অর্থ সংকীর্ণ (জল) এলাকার লোক (people of the Narrow [Water]”। প্রোটো ইন্দো-ইউরোপিয়ান ভাষায়, অ্যাং(ধহম-) অর্থ সংকীর্ণ, আঙহ( angh–) অর্থ আঁসাঁট। অনেকের মতে, প্রাচীন উচ্চ-জার্মান শব্দ এনগার (angar) শব্দ হতে ইঙওয়াজ (Ingwaz) শব্দের উদ্ভব। যার অর্থ দেবতা। প্রোটো জার্মানিক প্রবাদ হতে জানা যায়, ফ্রেইর (Freyr) এর আদি নাম ছিল ইংয়াভি বা ইঙ্গাভোনেস। ইঙ্গাভোনেস (ngaevones) প্রোটো জার্মানিকদের আদিপুরুষ। তাদের মতে এ ইঙ্গাভোনেস থেকে ইংল্যান্ড নামের উদ্ভব।
স্কট ও ল্যান্ড এ দুটো শব্দের সমন্বয়ে স্কটল্যান্ড শব্দের উৎপত্তি। এর অর্থ ল্যান্ড অব স্কটস বা স্কটদের দেশ। প্রাচীন ইংরেজি ভাষার শব্দ স্কটাস(Scottas) হতে স্কট শব্দের উৎপত্তি। ল্যাটিন স্কটি (Scoti) হতে শব্দটির উৎপত্তি।
ইংরেজি ভাষা যুক্তরাজ্যের সরকারী ভাষা। ওয়েল্স এবং স্কটল্যান্ডে যথাক্রমে ওয়েল্শ এবং স্কটিশ গেলিক ভাষাকে আঞ্চলিক সরকারি ভাষার মর্যাদা

দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জে আইল অভ ম্যান-এ মাংক্স ভাষা, এবং জার্সি ও গুয়ের্নজি-তে ফরাসি ভাষা প্রচলিত। উত্তর আয়ারল্যান্ডে সামান্য আইরিশ গেলিক ভাষা প্রচলিত। যুক্তরাজ্যের অভিবাসী সম্প্রদায়ে শতাধিক অভিবাসী ভাষা প্রচলিত। এদের মধ্যে আছে বাংলা, চীনা, গ্রিক, গুজরাটি, হিন্দি, ইতালীয়, পাঞ্জাবি, পোলীয়, পর্তুগিজ, স্পেনীয়, তুর্কি, ইউক্রেনীয়, উর্দু, ভিয়েতনামি, ইত্যাদি ভাষা। কিছু লোক জিপসি বা রোমানি ভাষায় কথা বলে।
যুক্তরাজ্যের আয়তন ২,৪২,৪৯৫ বর্গকিলোমিটার বা ৯৩,৬২৮ বর্গমাইল। তন্মধ্যে জলীয় ভাগ ১.৩৪%। ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের হিসাবমতে যুক্তরাজ্যের জনসংখ্যা ৬,৪৫,১১,০০০ এবং জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে ২৫৫.৬। আয়তন বিবেচনায় যুক্তরাজ্য ৮০-তম বৃহত্তম দেশ কিন্তু জনসংখ্যা বিবেচনায় ২২-তম বৃহত্তম দেশ। তবে জনসংখ্যার ঘনত্ব বিবেচনায় যুক্তরাজ্য পৃথিবীর ৫১-তম জনবহুল দেশ। যুক্তরাজ্যের নাগরিকদের ব্রিটিশ বা ব্রিটন বলা হয়।
২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের হিসাবমতে, যুক্তরাজ্যের জিডিপি (পিপিপি) ২.৬৬০ ট্রিলিয়ন ইউএস ডলার এবং সে হিসাবে মাথাপিছু আয় ৪০,৯৫৮ ইউএস ডলার। অন্যদিকে, জিডিপি (নমিনাল) ২.৮৬৫ ট্রিলিয়ন ইউএস ডলার এবং মাথাপিছু আয় ৪৪,১১৮ ইউএস ডলার। মুদ্রার নাম পাউন্ড স্টার্লিং। মাথাপিছু আয় বিবেচনায় যুক্তরাজ্য পৃথিবীর ১৯-তম ধনী দেশ।
যুক্তরাজ্যের পতাকাকে ইউনিয়ন জ্যাক বলা হয়। ১৮০১ খ্রিষ্টাব্দের ১ জানুয়ারি যুক্তরাজ্যের বর্তমান পতাকা প্রথম গ্রহণ করা হয়। অবিকৃতভাবে এটি এখনও নিরবচ্ছিন্নভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে তখন থেকে। একসময় বলতে গেলে পুরো পৃথিবীটাই ছিল যুক্তরাজ্যের অধীন। পৃথিবীর প্রথম শিল্পায়িত

(industrialized) দেশ হচ্ছে যুক্তরাজ্য। ব্রিটিশেরা প্রথম রেলগাড়ি আবিষ্কার করে। জন ওয়াকার (John Walker) নামের একজন ব্রিটিশ প্রথম ম্যাচ আবিষ্কার করেন।
পৃথিবীর প্রতি ৭ জনের মানুষের ১জন ইংরেজি ভাষায় কথা বলে। সে হিসাবে বিশ্বে ইংরেজিভাষীর সংখ্যা ১ বিলিয়ন। পৃথিবীতে কম্পিউটারে সংরক্ষিত তথ্যের ৮০ ভাগ রাখা হয় ইংরেজিতে। ইংরেজি শব্দ আই, উই, টু এবং থ্রি ভাষা সৃষ্টির সময় হতে এখন ও অবিকৃত রয়েছে। স্বরবর্ণ ছাড়া ইংরেজি শব্দের বৃহত্তম পদ হচ্ছে (rhythms)। প্রতি ৯৮ মিনিটে একটি নতুন শব্দ তৈরি হয়। ৮৯% সুইডিশ ইংরেজি ভাষায় কথা বলে। ১০০০ শব্দ জানা থাকলে দৈনন্দিন জীবনের ৯০% ঠিকভাবে ইংরেজি ভাষায় লেখা যায়। ইংরেজি ভাষায় সবচেয়ে ব্যবহৃত বিশেষ্যপদ Time। ইংরেজি ভাষায় সবচেয়ে বেশি শব্দ শুরু হয়েছে এস দিয়ে। নাইজেরিয়ায় ইংরেজিভাষীর সংখ্যা ইংল্যান্ডের চেয়ে বেশি। screeched ইংরেজি ভাষায় সবচেয়ে বড় এক অক্ষর (syllable) বিশিষ্ট শব্দ। ঊনবিংশ শতকের পূর্ব পর্যন্ত ইংরেজি শব্দের অভিনেতার প্রতিশব্দ ছিল হিপোক্র্যাটস। সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম পূর্ণ বাক্য গো (Go)।
অনেকে মনে করেন বিগ বেন ঘড়ি, আসলে এটি ঘণ্টা। লন্ডনকে একসময় লন্ডনিয়াম, লুডেনউইক এবং লুডেনবার্গ বলা হতো। প্রায় ৩০০ বছর ফরাসি লন্ডনের দাপ্তরিক ভাষা ছিল। প্রথম টেলিফোন ডাইরেক্টরি প্রকাশিত হয় লন্ডন থেকে। ওই ডাইরেক্টরিতে ২৫জন গ্রাহকের নাম ছিল। লন্ডনে ৩০০ এর

অধিক ভাষায় কথা বলার লোক আছে। ইংরেজরা পৃথিবীর অন্যান্য জাতির চেয়ে অধিক চা পান করে। মধ্যযুগে ইংল্যান্ডে মানুষের মতো প্রাণীদেররও বিচার হতো, জেল ও মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হতো।
যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় সংগীত (The Star Spangled Banner) একজন ইংল্যান্ডবাসীর রচনা। বাকিংহাম প্যালেসের নিজস্ব পুলিশ স্টেশন রয়েছে। উইন্ডসর ক্যাসল পৃথিবীর বৃহত্তম রাজকীয় প্রসাদ। ১৯৭৬ খিস্টাব্দে রানী প্রথম ই-মেইল প্রেরণ করেন। যুক্তরাজ্যের ৩ মাইলের মধ্যে অবস্থিত স্টারগনস, তিমি ও ডলফিনের মালিক।
লন্ডন বিশ্বের বৃহত্তম বাণিজ্যিক কেন্দ্র। যুক্তরাজ্যে ৮টি বিশ্ব ঐতিহ্য সাইট রয়েছে। তন্মধ্যে লন্ডনে চারটি। এগুলো হচ্ছে: ওয়েস্টমিনিস্টার, টাওয়ার অব লন্ডন, ম্যারিটাইম গ্রিনইউচ এবং কিউ বোটানিক্যাল গার্ডেন। লন্ডনে বসবাসরত জনগণের ২৫% অন্যদেশে জন্মগ্রহণকারী। লন্ডন সাবওয়েতে ৪০৯টি সিড়ি (escalator) রয়েছে।
অ্যাঞ্জেল টিউব স্টেশনের এস্কেলটর পশ্চিম ইউরোপের দীর্ঘতম। যুক্তরাজ্যের ১৬% রেস্টুরেন্ট লন্ডনে অবস্থিত। পৃথিবীতে প্রথম লন্ডনে সাবওয়ে আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশন করা হয়। লন্ডনের টেমস নদীর উপর ২০০ সেতু ও টানেল রয়েছে। পৃথিবীর প্রথম থিয়েটার হল নির্মাণ করা হয় ইংল্যান্ডে। এর নাম ছিল থিয়েটার। জরুরি অবস্থা ছাড়া ব্রিটিশ পুলিশ বন্দুক বহন করে না।
সান ম্যারিনো (San Marino) : ইতিহাস ও নামকরণ
সার্বিয়া (Serbia) : ইতিহাস ও নামকরণ
স্লোভাকিয়া (Slovakia) : ইতিহাস ও নামকরণ
স্লোভেনিয়া (Slovenia) : ইতিহাস ও নামকরণ
স্পেন (Spain) : ইতিহাস ও নামকরণ
সুইডেন (Sweden) : ইতিহাস ও নামকরণ
সুইজারল্যান্ড (Switzerland) : ইতিহাস ও নামকরণ
তুরস্ক (Turkey) : ইতিহাস ও নামকরণ
ইউক্রেন (Ukraine) : ইতিহাস ও নামকরণ
সূত্র: কীভাবে হলো দেশের নাম, ড. মোহাম্মদ আমীন, পুথিনিলয়, বাংলাবাজার, ঢাকা।
বাংলাদেশ ও বাংলাদেশবিষয়ক সকল গুরুত্বপূর্ণ সাধারণজ্ঞান লিংক