এবি ছিদ্দিক
‘যৌগিক ব্যঞ্জন’ ভাষার সূক্ষ্ম বিষয়সমূহের একটি, যেটি নিয়ে খুব একটা আলোচনা করা হয় না বললেই চলে। দৈনন্দিনের

ভাষাচর্চায় এটির খুব একটা দরকার না-পড়ায় মূলত এই চর্চাবিমুখতা। তবে খুশির ব্যাপার হচ্ছে, ইদানীং কয়েকজন শুবাচি ‘যৌগিক ব্যঞ্জন’ চর্চায় আগ্রহ দেখাচ্ছেন। আর, আমার এই লেখাটি তাঁদের প্রতি নিবেদিত, যাঁরা ভাষার এসব ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয়ের চর্চায় বরাবরই উৎসাহী।
‘যৌগিক ব্যঞ্জন’ বিষয়টি ভালোভাবে বুঝতে হলে আগে স্বরধ্বনি, ব্যঞ্জনধ্বনি ও অক্ষর সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকা উচিত। তাই, আমার মূল আলোচনায় যাওয়ার পূর্বে উল্লেখ-করা বিষয় তিনটি সংক্ষেপে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।
স্বরধ্বনি: যেসকল ধ্বনির উচ্চারণে ফুসফুসতাড়িত বাতাস বাগযন্ত্রের কোথাও বাধা প্রাপ্ত হয় না; অর্থাৎ, যেসকল ধ্বনি আমরা যতক্ষণ ইচ্ছে টেনে পড়তে পারি, সেসকল ধ্বনিকে স্বরধ্বনি বলে। যেমন: অ, আ, ই, এ, ও প্রভৃতি। আমরা চাইলে /অ/, /আ/, /ই/ প্রভৃতি ধ্বনি যতক্ষণ ইচ্ছে টেনে ধরে /অঅঅঅঅঅঅ…/, /আআআআ…/, /ইইইইই…/ প্রভৃতিরূপে পড়তে পারি। তাই এগুলো স্বরধ্বনি।
ব্যঞ্জনধ্বনি: যেসকল ধ্বনির উচ্চারণে ফুসফুস-নিসৃত বাতাস বাগযন্ত্রের কোথাও না কোথাও বাধা প্রাপ্ত হয়; অর্থাৎ, যেসকল ধ্বনি পড়ার সময় আমরা ইচ্ছে মতো টেনে পড়তে পারি না, সেগুলোই হচ্ছে ব্যঞ্জনধ্বনি। যেমন: ক্, গ্, চ্, ট্, ফ্, ধ্, ম্, র্ প্রভৃতি। আমরা চাইলেই এক নিশ্বাসে /ক্ক্ক্…/ রূপে উচ্চারণ করতে পারি না। এই ব্যঞ্জনধ্বনির শেষে স্বরধ্বনি যুক্ত হলেই কেবল অনেকক্ষণ ধরে টেনে উচ্চারণ করা যায়। যেমন: ক্+অ = ক /কঅঅঅঅঅঅ…/।
অক্ষর: শ্বাসের এক ধাক্কায় কোনো শব্দের যেটুকু অংশ উচ্চারণ করা যায়, তাই (তা-ই) হচ্ছে অক্ষর। অর্থাৎ, কোনো শব্দের যেটুকু অংশ উচ্চারণ করার পর শ্বাসের ধাক্কা পড়ে, জিহ্বা অবস্থান বদল করে, ঠোঁটের আকৃতির পরিবর্তন হয়, তাই (তা-ই) হচ্ছে অক্ষর। যেমন: পরিবার /পোরিবার্/ = পো-রি-বার্। এখানে /পো/ বলা শেষ করে /রি/ বলার পূর্বে শ্বাসের ধাক্কা পড়ে, জিহ্বার অবস্থানের পরিবর্তন ঘটে, ঠোঁটের আকৃতির পরিবর্তন ঘটে। /রি/-এর পর /বার্/ উচ্চারণ করার সময়ও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। তাই, ‘পরিবার’ শব্দটিতে তিনটি অক্ষর রয়েছে।
এরকম—
ব্যাখ্যা /ব্যাক্খা/ = ব্যাক্-খা— দুই অক্ষর।
বিদ্যালয় /বিদ্দালয়্/ = বিদ্-দা-লয়্— তিন অক্ষর।
একদেশদর্শিতা /একোদেশোদোর্শিতা/ = এ-কো-দে+শো-দোর্-শি-তা— সাত অক্ষর।
প্রসঙ্গত, বাংলা ভাষায় একটি অক্ষরে কেবল একটি স্বরধ্বনি থাকতে পারে।
এবার মূল আলোচনায় আসছি।
যৌগিক ব্যঞ্জন: দুই বা তার চেয়ে বেশি ব্যঞ্জনধ্বনির মধ্যে কোনো স্বরধ্বনি না-থাকলে সে ব্যঞ্জনধ্বনি দুটি বা কটি একত্রে উচ্চারিত হয়। এরূপ যুক্তব্যঞ্জনধ্বনির দ্যোতনার জন্যে দুই বা তারও অধিক ব্যঞ্জনবর্ণ একত্রিত হয়ে যে ব্যঞ্জন গঠিত হয়, তাকে সংযুক্ত ব্যঞ্জন বা যুক্তব্যঞ্জন বলে। আর, যেসকল যুক্তব্যঞ্জনের প্রতিটি ধ্বনি সমভাবে ও স্পষ্টভাবে উচ্চারিত হয় এবং সম্পূর্ণ যুক্তব্যঞ্জনটির উচ্চারণ একটি দল বা অক্ষরে (syllable) সম্পন্ন হয়, সেসকল যুক্তব্যঞ্জনকে যৌগিক ব্যঞ্জন বলে।
এই সংজ্ঞার্থ থেকে যৌগিক ব্যঞ্জন হওয়ার তিনটি মৌলিক শর্ত নিরূপণ করা যায়:—
১. অবশ্যই যুক্তব্যঞ্জন হতে হবে।
২. যুক্তব্যঞ্জনের প্রতিটি ধ্বনি (বর্ণ) সমভাবে ও স্পষ্টভাবে উচ্চারিত হবে।
৩. ওই যুক্তব্যঞ্জনটির উচ্চারণ কেবল একটি দল বা অক্ষরের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। অর্থাৎ, ওই যুক্তব্যঞ্জনের প্রতিটি ধ্বনি একই দল বা অক্ষরের অন্তর্গত হবে।
এই শর্ত তিনটির যে-কোনো একটি পূরণ না-হলে তাকে যৌগিক ব্যঞ্জন বলা যাবে না। এগুলোর মধ্যে দুই নম্বর শর্তটি ভালোভাবে অনুধাবন করা খুবই জরুরি। ওই শর্তে
‘সমভাবে’ বলতে ‘যতগুলো বর্ণ আছে,
ততগুলো ধ্বনি’ এবং ‘স্পষ্টভাবে’ বলতে ‘যে
বর্ণগুলো আছে, সে ধ্বনিগুলোই থাকবে’
বোঝানো হয়েছে। যেমন: ‘আপ্রাণ’ শব্দের
উচ্চারণ হচ্ছে /আপ্প্রান/। যেহেতু এখানে
‘প্র’-এর উচ্চারণে একটি /প্/ বেশি এসেছে,
সেহেতু এখানে ‘প্র’ সমভাবে উচ্চারিত
হয়নি। ‘স্পষ্টভাবে’-র জন্যে সূত্রটা একটু
ভিন্নভাবে দিচ্ছি— ‘আসা’ শব্দের উচ্চারণ
হচ্ছে /আশা/। যেহেতু এখানে /স্/-এর
জায়গায় /শ্/ উচ্চারিত হচ্ছে, সেহেতু
এখানে ‘স্’ স্পষ্টভাবে উচ্চারিত হয়নি।
এবার কয়েকটি শব্দের মধ্য থেকে যৌগিক ব্যঞ্জন নির্ণয় করা যাক:
ক. প্রথম:
ধাপ-০১: প্রথম = প্+র্+অ+থ্+অ+ম্।
যেহেতু এখানে ‘প্’ আর ‘র্’-এর মধ্যখানে কোনো স্বরধ্বনি নেই, সেহেতু ‘প্র’ একটি যুক্তব্যঞ্জন। অর্থাৎ, এক নম্বর শর্ত পূরণ হয়েছে।
ধাপ-০২: প্রথম = /প্রোথোম্/।
এখানে যুক্তব্যঞ্জনের প্রতিটি ধ্বনিই (বর্ণই) সমভাবে ও স্পষ্টভাবে (প্ আর র্) উচ্চারিত হয়েছে। অর্থাৎ, দুই নম্বর শর্তও পূরণ হয়েছে।
ধাপ-০৩: প্রথম = /প্রোথোম্/ = প্রো-থোম্। এখানে যুক্তব্যঞ্জন ‘প্র’ কেবল একটি অক্ষরে (আদ্যক্ষরে) উচ্চারিত হয়েছে। অর্থাৎ, তিন নম্বর শর্তও পূরণ করেছে।
অতএব, ‘প্রথম’ শব্দে ‘প্র’ একটি যৌগিক ব্যঞ্জন।
খ. বন্ধ:
ধাপ-০১: বন্ধ = ব্+অ+ন্+ধ্+অ।
যেহেতু এখানে ‘ন্’ আর ‘ধ্’-এর মধ্যখানে কোনো স্বরধ্বনি নেই, সেহেতু ‘ন্ধ’ একটি যুক্তব্যঞ্জন। অর্থাৎ, এক নম্বর শর্ত পূরণ হয়েছে।
ধাপ-০২: বন্ধ = /বন্ধো/। এখানে যুক্তব্যঞ্জনের প্রতিটি ধ্বনিই (বর্ণই) সমভাবে স্পষ্টভাবে (ন্ আর ধ্) উচ্চারিত হয়েছে। অর্থাৎ, দুই নম্বর শর্তও পূরণ হয়েছে।
ধাপ-০৩: বন্ধ = /বন্ধো/ = বন্-ধো। এখানে যুক্তব্যঞ্জন ‘ন্ধ’ একটি অক্ষরে উচ্চারিত না-হয়ে দুটি অক্ষরে ভাগ হয়ে গিয়েছে (প্রথম অক্ষরে ন্ এবং দ্বিতীয় অক্ষরে ধ্)। অর্থাৎ, তিন নম্বর শর্ত পূরণ হয়নি।
অতএব, ‘বন্ধ’ শব্দে ‘ন্ধ’ যুক্তব্যঞ্জন হলেও যৌগিক ব্যঞ্জন নয়।
গ. পরীক্ষা:
ধাপ-০১: পরীক্ষা = প্+অ+র্+ঈ+ক্+ষ্+আ।
যেহেতু এখানে ‘ক্’ আর ‘ষ্’-এর মধ্যখানে কোনো স্বরধ্বনি নেই, সেহেতু ‘ক্ষ’ একটি যুক্তব্যঞ্জন। অর্থাৎ, এক নম্বর শর্ত পূরণ হয়েছে।
ধাপ-০২: পরীক্ষা = /পোরিক্খা/।
এখানে যুক্তব্যঞ্জনের প্রতিটি ধ্বনি (বর্ণ) সমভাবে (ক্ আর ষ্) উচ্চারিত হয়নি। অর্থাৎ, দুই নম্বর শর্ত পূরণ হয়নি।
অতএব, ‘পরীক্ষা’ শব্দে ‘ক্ষ’ একটি যুক্তব্যঞ্জন হলেও যৌগিক ব্যঞ্জন নয়।
বাংলা শব্দে সাধারণত কেবল আদ্যক্ষরে (প্রথম অক্ষরে) যৌগিক ব্যঞ্জন পাওয়া যায়। তবে বিদেশি ভাষা থেকে আগত কিছু শব্দের ক্ষেত্রে শেষ অক্ষরেও যৌগিক ব্যঞ্জন পাওয়া যায়। উদাহরণ—
i. আদিতে: ক্লান্ত /ক্লান্-তো/ শব্দের ‘ক্লা’।
ii. অন্ত্যে: পাউন্ড /পা-উন্ড্/ শব্দের ‘ন্ড’।
এবার ‘স্নাতক’, ‘শ্রেণি’ আর ‘ছত্রাক’ শব্দত্রয়ে কোনো যৌগিক ব্যঞ্জন আছে কি না, তা আপনারাই নির্ণয় করবার চেষ্টা করুন-না।
তথ্য ও পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করেছেন: শ্রীময় রাহুল রায় দাদা, মাস্টার্স দ্বিতীয় পর্ব, বাংলা বিভাগ, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, ভারত।
সূত্র: যৌগিক ব্যঞ্জন, এবি ছিদ্দিক, শুদ্ধ বানান চর্চা (শুবাচ)।
অনুসজ্জা: Rashida Akter Mishu
বিসিএস প্রিলি থেকে ভাইভা কৃতকার্য কৌশল
ড. মোহাম্মদ আমীনের লেখা বইয়ের তালিকা
বাংলাদেশ ও বাংলাদেশবিষয়ক সকল গুরুত্বপূর্ণ সাধারণজ্ঞান লিংক
বাংলা বানান কোথায় কী লিখবেন এবং কেন লিখবেন/১
বাংলা বানান কোথায় কী লিখবেন এবং কেন লিখবেন/২
বাংলা বানান কোথায় কী লিখবেন এবং কেন লিখবেন /৩
ইউরোপ মহাদেশ : ইতিহাস ও নামকরণ লিংক
কি না বনাম কিনা এবং না কি বনাম নাকি
মত বনাম মতো : কোথায় কোনটি এবং কেন লিখবেন
ভূ ভূমি ভূগোল ভূতল ভূলোক কিন্তু ত্রিভুবন : ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ
মত বনাম মতো : কোথায় কোনটি এবং কেন লিখবেন
প্রশাসনিক প্রাশাসনিক ও সমসাময়িক ও সামসময়িক
লক্ষ বনাম লক্ষ্য : বাংলা বানান কোথায় কী লিখবেন