ড. মোহাম্মদ আমীন
চণ্ডালিকা রবীন্দ্রনাথের একটি ভিন্নধর্মী নৃত্যনাট্য। এখানে তিনি শ্রেণী গোত্র এবং লিঙ্গ পরিচয় অতিক্রান্ত মানুষের সর্বাঙ্গীন মুক্তির এক অনুপম চিত্র অঙ্কন করেছেন অনুপম ছন্দে নিপুণ কথার মোহনীয় মালায়। ‘চণ্ডালিকা’ মূলত প্রকৃতি নামের এক অচ্ছুত নারীর দেহ-মনের চেতন লাভের ব্যতিক্রম এক কাহিনি। প্রকৃতি নামের এই অচ্ছুত চণ্ডালিনী নারীর কাছে এক বৌদ্ধ শিষ্য আনন্দ জলপান করার আগ্রহ প্রকাশ করে। এই আগ্রহের কারণে প্রকৃতির সব অবগুণ্ঠন উন্মোচিত হয়ে যায়। তার মধ্যে জাগ্রত হয় নতুন বোধ। প্রকৃতি নিজেকে অচ্ছুত চণ্ডাল নারী থেকে একজন মানুষ হিসেবে আবিষ্কার করার উপাদান খুঁজে পেয়ে পরম লাস্যে নতুন বোধে আবির্ভূত হয়। প্রকৃতি নিজের অভ্যন্তরে দেখতে পায় ভগবানকে।জন্মান্তরের সব হীনম্মন্যতা থেকে মুক্তি পেতে শুরু করে তার চেতনা।সূর্যালোর মতো আপন সত্তার স্বরূপ তার কাছে বিকশিত হয়ে ওঠে।
দেহকেন্দ্রিক আধ্যাত্মিক দর্শন এই নাটকের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ প্রবল করে তোলেন, যা প্রাচ্য দর্শনের মূল ভিত হিসেবে বিবেচ্য। শেষ দৃশ্যে মন্দিরে নৃত্যরত প্রকৃতি আর মন্ত্র উচ্চারণে নিমগ্ন তার মা মায়া। দেহ আর মনের সাংঘর্ষিকতার মাঝেও যৌক্তিক বিবেচনার মধ্য দিয়ে পরমে পৌঁছবার প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায় ‘চণ্ডালিকা’য়। অবশেষে প্রকৃতি নিজের দেহের মধ্যিই আবিষ্কার করে ব্রহ্মাণ্ড। আনন্দ নৃত্যে উদ্বেলিত হয়ে ওঠে প্রকৃতির চাওয়া-পাওয়া আর ইচ্ছা-অনিচ্ছার সমুদয় আকুতি। সময়কে অতিক্রম করে সে হয়ে ওঠে মহাজাগতিকের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এতদিন পরিবার, সমাজ, রাজনীতির যেসব নিয়মনীতির মাধ্যমে তাকে অবরুদ্ধ করে রেখেছিল, যা ছিল তার অবগুণ্ঠনের মূল কারণ- প্রকৃতি সে অবগুণ্ঠন খুলে পরম-আনন্দের সাক্ষাৎ পায়। ইন্দ্রনাথ চৌধুরীর মতে ‘বর্তমানকে বন্ধনমুক্ত করে একে চিরায়ত সময়ের অংশ করে নেওয়াই হচ্ছে এই গীতিনাট্যের মূলভাব।