রবীন্দ্রসংগীত বনাম নজরুলগীতি

ড. মোহাম্মদ আমীন
রবীন্দ্রনাথের লেখা গানকে রবীন্দ্রসংগীত, কিন্তু নজরুলের লেখা গানকে নজরুলগীতি বলা হয় কেন? এর উত্তরে অধিকাংশ লোক  জোর দিয়ে যে তথ্যটি পেশ করেন তা হলো— “রবীন্দ্রনাথ নিজেই নিজের লেখা সব গানে সুর দিয়েছেন।  তাই তাঁর লেখা গান রবীন্দ্রসংগীত।  নজরুল নিজে তাঁর লেখা সব গানে সুর দেননি। এজন্য তাঁর লেখা গানকে নজরুলগীতি বলা হয়।” লালনের গানে লালন নিজেই সুর দিয়েছেন। সে হিসেবে এগুলো লালনসংগীত হওয়া উচিত। কিন্তু  লালনগীতি বলা হয় কেন? এছাড়া এমন অনেক গান আছে যেগুলোর গীতিকার ও সুরকার ভিন্ন। এমন অনেক গানকেও সংগীত বলা হচ্ছে। এমনকি নজরুলের লেখা একই গান স্থানবিশেষে নজরুলগীতি ও নজরুলসংগীত নামে প্রচারিত হচ্ছে। একদম প্রথমদিকে রবীন্দ্রনাথের গান রবিবাবুর গান নামে পরিচিত ছিল। তা কীভাবে রবীন্দ্রসংগীত হয়ে গেল? বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানমতে, সংস্কৃত সংগীত অর্থ  (বিশেষ্যে) গান (রবীন্দ্রসংগীত); গীত ও বাদ্য; সুর, ছন্দ ও লয়ের সমন্বয়ে উচ্চারিত বাক্য, গীত ও বাদ্য। সংস্কৃত গীতি অর্থ (বিশেষ্যে) গান, সংগীত। সুতরাং, অভিধানমতে, সংগীত ও গীতি সমার্থক। সুরারোপের সঙ্গে তাদের অর্থের কোনো ভিন্নতা পরিদৃষ্ট নয়। তারপরও এমন দাবি কেন?
অনেকে বলেন— গীত, বাদ্য এবং নৃত্য এই তিন কলার সমন্বিত পরিবেশনাই সংগীত। রবীন্দ্রনাথের গান তিন কলার সমন্বয়ে পরিবেশন করা হতো। তাই রবীন্দ্রসংগীত। কিন্তু এমন অনেক গান আছে যেগুলো কখনো এই তিন কলার সমন্বয়ে পরিবেশিত হয়নি। সেগুলোকেও রবীন্দ্রসংগীত বলা হয় কেন? আবার গীত-বাদ্য-নৃত্য সমন্বয়ে পরিবেশন করা হলেও নজরুলের লেখা গানকে নজরুলগীতি বলা হচ্ছে। অন্যদিকে, কোথাও কোথাও এসব ছাড়া পরিবেশিত হলেও একই গানকে বলা হচ্ছে নজরুলসংগীত। কেন? এর কি কোনো মানদণ্ড আছে না কি যথেচ্ছাচার? এখন দেখা যাক বর্ণিত তথ্যসমূহ কতটুকু তত্ত্বসম্মত।
বাংলা গানের জগৎকে যদি সপ্তর্ষিমণ্ডল ধরা হয় তাহলেও এই সপ্তর্ষিমণ্ডলের সপ্ত নক্ষত্র হলেন: লালন (১৭৭২ খ্রি.১৮৯০খ্রি.), হাসন রাজা (১৮৫৪খ্রি.১৯২২খ্রি.), রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১খ্রি.১৯৪১খ্রি.), দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (১৮৬৩খ্রি.১৯১৩খ্রি.), রজনীকান্ত সেন (১৮৬৫খ্রি.১৯১০খ্রি.), অতুলপ্রসাদ সেন (১৮৭১খ্রি.১৯৩৪খ্রি.) এবং কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯খ্রি.১৯৭৬খ্রি.)। লালনগীতি, হাসন রাজার গান, রবীন্দ্রসংগীত, দ্বিজেন্দ্রগীতি, রজনীকান্তের গান ও অতুলপ্রসাদের গান এই অভিন্ন নামে  পরিচিত। কিন্তু নজরুলের ক্ষেত্রে গীতি ও সংগীত দুটোই প্রচলিত। কেন?
রবীন্দ্রসংগীত বলতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত এবং রবীন্দ্রনাথ বা তাঁর নতুনদাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর সুরারোপিত গানগুলিকেই বোঝায়। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় অন্যের সুরারোপিত গানগুলিকে ‘রবীন্দ্রসংগীত’ বর্গভুক্ত করা হয় না। এজন্য  পঙ্কজকুমার মল্লিক সুরারোপিত ‘দিনের শেষে ঘুমের দেশে’ গানটি রবীন্দ্রসংগীত-ভুক্ত নয়। প্রসঙ্গত, পঙ্কজকুমার মল্লিক রবীন্দ্রনাথের অনুমতি নিয়ে কবির খেয়া কাব্যগ্রন্থের ‘শেষ খেয়া’ কবিতায় সুরারোপ করেন এবং নিউ থিয়েটার্স প্রাইভেট লিমিটেড প্রযোজিত ও প্রমথেশ বড়ুয়া পরিচালিত মুক্তি (১৯৩৭) চলচ্চিত্রে  প্রয়োগ করেন। অতএব, একটা বিষয় নিশ্চিত হওয়া গেল— রবীন্দ্রনাথ তাঁর লেখা সব গানের সুরকার নন। মূলত রবীন্দ্রনাথ লিখিত এবং রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর নতুনদাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ সুরারোপিত গানগুলিই কেবল রবীন্দ্রসংগীত।যা রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবদ্দশায় স্থির-নিশ্চিত করে গিয়েছেন।
জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে ছিল সংগীতচর্চার অভিজাত কেন্দ্র। সেখানে গীত, বাদ্য ও নৃত্যসহকারে সংগীত পরিবেশন ও সংগীতচর্চা চলত। রবীন্দ্রনাথের বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও রবীন্দ্রনাথের অন্যান্য দাদারা নিয়মিত সংগীতচর্চা করতেন। ঠাকুরবাড়িতে গান বা গীতি বলা হতো না, বলা হতো সংগীত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত মোট গানের সংখ্যা ২২৩২। এগারো বছর বয়সে লেখাগগনের থালে রবি চন্দ্র দীপক জ্বলেগানটি  রবীন্দ্রনাথ রচিত প্রথম গান। এটি গুরু নানক রচিত ‘গগন মে থাল রবি চন্দ্র দীপক বনে’ ভজনটির প্রথমাংশের প্রায় আক্ষরিক অনুবাদ। গানটি (গীত) জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে বাদ্য ও নৃত্যসহকারে পরিবেশিত হয়েছিল। তাই রবীন্দ্রনাথের লেখা প্রথম গানটি সংগীত হিসেবে পরিচিতি পায়। রবীন্দ্রনাথ নিজেই তাঁর লেখা গানকে সংগীত আখ্যায়িত করেছেন। ‘সঙ্গীতের মুক্তি’ প্রবন্ধ রবীন্দ্রনাথের সংগীত চেতনার মূর্ত পরিবেশন।
রবীন্দ্রনাথের লেখা শেষ গান ‘হে নূতন দেখা দিক আর বার’। গানটি ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দে রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় তাঁর শেষ জন্মদিনে  বাদ্য ও নৃত্যসহকারে পরিবেশিত হয়েছিল। প্রথমদিকে রবীন্দ্রনাথের গান রবিবাবুর গান নামে পরিচিত হলেও তা ছিল সীমিত পরিসরে। রবীন্দ্রনাথের লেখা গানের প্রথম প্রকাশিত রেকর্ড এবং পরবর্তীকালে প্রকাশিত সব রেকর্ড ও চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রসংগীত কথাটি উল্লেখ করা হতো। জোসাঁকো ঠাকুরবাড়ির সংগীত ঐতিহ্যের সূত্রে  রবীন্দ্রনাথ নিজেও বলতেন সংগীত। তাই রবীন্দ্রনাথের লেখা গান রবীন্দ্রসংগীত নামে পরিচিতি পায়।
নজরুলগীতি কী? নজরুলগীতি কাজী নজরুল ইসলাম লিখিত গান। তাহলে নজরুলসংগীত কী? তাও কাজী নজরুল ইসলাম লিখিত গান। অর্থাৎ নজরুলগীতি ও নজরুলসংগীত সমার্থক। একই গান কোথাও নজরুলগীতি আবার কোথাও নজরুলসংগীত। বাংলাদেশে যা নজরুলসংগীত, পশ্চিমবঙ্গে তা নজরুলগীতি। তবে এটি ঠিক যে, নজরুলের গান প্রথম থেকে নজরুলগীতি নামে পরিচিত ছিল।  কিন্তু হঠাৎ করে নজরুলের গান নজরুলগীতি হযে গেল কেন এবং কীভাবে? 
প্রথম থেকেই নজরুলের গান নজরুলগীতি নামে পরিচিত ছিল। নজরুলগীতিকে নজরুলসংগীত করার চেষ্টা পাকিস্তান পরবর্তী বাংলাদেশের কয়েকজন ব্যক্তির মানসিক দ্বন্দ্বজড়িত পণ্ডিতম্মন্যতার ফল।দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেল নজরুল। নজরুলগীতি এবং নজরুল সংগীতের এই বিভাজন রেখাটি সুনির্দিষ্টভাবে মেনে চলার মানদণ্ড আছে কী?  অনেকে যুক্তি দিলেন: যে-গানের বাণী ও সুর দুটোই নজরুলের তাকে নজরুলসংগীত বলা হবে, বাকিগুলো নজরুলগীতি।কিন্তু কোন গানে নজরুল সুরারোপ করেছেন এবং কোনটায় করেননি তা নির্ধারণ কোনো সুযোগ এখন নেই। তাহলে? এটি এখনও নির্ধারণ করা যায়নি। তারপরও নজরুলের সব গানকে পশ্চিমবঙ্গে নজরুলগীতি এবং বাংলাদেশে নজরুলসংগীত বলা হচ্ছে।  

নজরুলের লেখা গানের সংখ্যা প্রায় ৪০০০।  নজরুল সবগুলি গানে নিজে সুরারোপ করেননি। কোনগুলো নজরুলের সুরারোপিত এবং কোনগুলো নয় তাও চিহ্নিত করা হয়নি।  মানদণ্ড না থাকায় সেগুলো এখন চিহ্নিত করার কোনো সুযোগ নেই। নজরুল ছাড়া তাঁর গানে অন্যান্য যেসব সুরকার সুরসংযোগ করেছেন তাদের একটি অসম্পূর্ণ তালিকা পাওয়া যায়: কমল দাশগুপ্ত (১৬৪টি মতান্তরে ৪০০), চিত্ত রায় (৪০টি ), নিতাই ঘটক (৫১টি), সুবল দাশগুপ্ত (৩৪টি), কাশেম মল্লিক ওরফে কে মল্লিক (১০টি), গিরীন চক্রবর্তী

ড. মোহাম্মদ আমীন

(২৪টি) গোপাল সেন (২টি ), সত্যেন চক্রবর্তী (১০টি), আব্বাসউদ্দীন আহমদ (১১টি ), অনিল বাগচি (২টি), অনিল ভট্টাচার্য (২টি), আবদুল করিম (১টি),  কালিদাস বন্দ্যোপাধ্যায় (১টি), কৃষ্ণচন্দ্র দে (২টি),  গোপেন মলি্লক (৪টি ), গোলাম হায়দার (২টি), জ্ঞান দত্ত (৬টি),  জগন্ময় মিত্র (১টি), জমীরুদ্দীন খাঁ (২টি), তুলসী লাহিড়ী (৪টি), দুর্গা সেন (৪টি), ধীরেন দাস (৮টি), নরেন মুখোপাধ্যায় (১টি), নীলমণি সিংহ (১টি), পঙ্কজকুমার মল্লিক (২টি ), পাঁচুবাবু (১টি ), পিয়ারু কাওয়াল (২টি ), বিজনবালা ঘোষদস্তিদার (৫টি ), বিমল দাশসুপ্ত (৪টি), ভীষ্মদেব চট্টোপধ্যায় (১টি), মনোরঞ্জন সেন (৮টি), মৃণালকান্তি ঘোষ (৩টি ), মোহিনী সেনগুপ্ত (৪টি), রতন মাঝি (১টি ), রত্নেশ্বর মুখোপাধ্যায় (২টি), রাইচাঁদ বড়াল (২টি), রণজিৎ রায় (২৮টি), শচীন চক্রবর্তী (২টি), শেখ লুৎফর রহমান (২টি) শৈলেন দত্তগুপ্ত (২১টি), সুখময় গঙ্গোপাধ্যায় (৬টি), সত্য চৌধুরী (২টি),  সিদ্ধেশ্বর মুখোপাধ্যায় (২টি), সুবোধ দাশগুপ্ত (১টি), সুরেশ চক্রবর্তী (৪টি), সুরেশ চৌধুরী (২টি), এবং সুরসাগর হিমাংশু দত্ত (৪টি)। এছাড়াও আরও অনেকে নজরুলের গানের ‍সুরারোপ করেছেন। যাদের তথ্য পাওয়া যায়নি। মনে করে হয়, নজরুল প্রায় তিন হাজারের অধিক গানে নিজেই সুরারোপ করেছেন।

প্রথম থেকে বিভিন্ন এলাকায় পরিবেশিত নজরুলের লেখা গান নজরুলগীতি নামে পরিচিতি পেয়ে যায়।১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে  নজরুলের গান নজরুলগীতি নামে সর্বপ্রথম রেকর্ডবদ্ধ (শিল্পী: হরেন্দ্রনাথ দত্ত, গীত: ‘জাতের নামে বজ্জাতি সব’) হয়।    এরপর কে মল্লিক, আঙ্গুরবালা, ইন্দুবালা, হরিমতি, রাধারাণী প্রমুখ শিল্পীর কণ্ঠে নজরুলের গান রেকর্ড হয়। প্রতিটি রেকর্ডে লেখা থাকত নজরুলগীতি। নজরুলের গান রচনার  শেষ পর্যায় ছিল রাগভিত্তিক গানসৃজন। এসময় নজরুলের লেখা গান  কলকাতা বেতারের হারামণি, নবরাগ মালিকা, মেল-মিলন, যাম যোজনার কড়ি মাধ্যম, প্রহর পরিচায়িকা প্রভৃতি শিরোনামের অনুষ্ঠানসমূহে নজরুলগীতি নামে পরিবেশিত হতো। তাই  নজরুলের গান  সাধারণ্যে নজরুলগীতি নামে পরিচিতি পেয়ে যায়।
Language
error: Content is protected !!