রহস্যময় শব্দসংসার (১১)
আবদুশ শাকুর
রহস্যময় শব্দসংসার (১১)
গড্ডলিকা প্রবাহ: গড্ডলিকা হল গড্ডল বা ভেড়ার স্ত্রীলিঙ্গ, অর্থাৎ ভেড়ি। গড্ডলিকা প্রবাহের গড্ডলিকা হল মেষপালের সর্বাগ্রবর্তিনী ভেড়ি। বাগ্ধারাটির অর্থ হলো স্ত্রী ভেড়ার পিছু পিছু চলা ভেড়ার পাল। এভাবে চলাটা ভেড়াদের এক বিশিষ্ট স্বভাব। গাড়ল প্রকৃতির মানুষেরাও গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিতে বেশ স্বস্তি বোধ করে। বাংলাদেশে গৃহপালিত পশু হিসেবে ভেড়ার ভূমিকা তাৎপর্যহীন – বিরক্তিকর পশমের আধিক্যের কারণেই বোধ হয়। সম্ভবত একই কারণে গড্ডল বা ভেড়াজাত শব্দগুলো সবই মন্দ অর্থেই ব্যবহারের চল হয়েছে বাংলা ভাষায়। গড্ডল থেকে যেমন তৈরি হয়েছে গাড়ল, তেমনি ভেড়া থেকে তৈরি হয়েছে ভেড়ুয়া। দুটি শব্দই গালি হিসেবে ব্যবহৃত – পার্থক্য কেবল মাত্রার।
বাংলাভাষায় গড্ডলিকা প্রবাহ কথাটির ব্যুৎপত্তিগত প্রয়োগ আর নেই বললেই চলে। এখন চলছে কথাটির আলংকারিক প্রয়োগ। নিজে বিচারবিবেচনা না করে অন্ধ ও গাড়লের মতো অন্যকে অনুসরণ করাই হলো গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেওয়া।
জঘন্য: জঘন্য শব্দটি এসেছে জঘন থেকে। জঘন শরীর সম্পর্কীয় শব্দ। অর্থ হলো স্ত্রীলোকের কটিদেশ, তলপেট, নিতম্ব এবং নিতম্বের সম্মুখভাগ। স্ত্রীলোকের দেহের এই অংশটি অতিশয় প্রিয়দর্শন হলেও সমাজে প্রদর্শনীয় নয়। শুধু স্ত্রীলোক কেন, পুরুষের দেহেরও এই অংশটি সমাজে প্রদর্শনযোগ্য নয়। কারণ, বিধিনিষেধ শাসিত সভ্য সমাজে তা হবে অসভ্যতা। কিছু শারীরিক ব্যাপারস্যাপার ঢাকতে শিখেই মানুষ সভ্য হয়েছে।
যা একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার এবং যা প্রদর্শনীয় নয়, তা প্রদর্শন করা নিতান্তই গর্হিত ব্যাপার। এই গর্হিত ভাবটিই পরে জঘন্য শব্দের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। ফলে শব্দটির সাধারণ অর্থের ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে যায়। জঘন্য এবং জঘন দুটোই সংস্কৃত ভাষার শব্দ। সংস্কৃত ভাষায় জঘন্য শব্দের অর্থ নিতম্বস্থ, জঘনের মতো বা জঘনতুল্য। অথচ বাংলা ভাষায় শব্দটি ব্যবহৃত হয় ঘৃণিত, গর্হিত, নোংরা বা কদর্য ধরনের কাজ, কথা, চেহারা বা প্রকৃতি বোঝাতে। কিন্তু একটি অতি প্রিয় অর্থের অতি সুন্দর শব্দ কেন যে অতি অপ্রিয় অর্থবোধক শব্দস্বরূপ চালু হল – ভাষার সে রহস্য একান্তই অভেদ্য।
তুঘলকি: সৃষ্টিছাড়া, গোঁয়ার্তুমি, পরিকল্পনাহীন ইত্যাদি বোঝাতে ব্যবহৃত এই শব্দটি আমার চিত্তকে বরাবরই ব্যথিত করে। কারণ সাধারণ মানুষ দ্বারা একজন অসাধারণ মানুষের চরিত্রহনন এবং তাঁর নামের ওপর চিরস্থায়ী কলঙ্ক লেপনের এক অতি জঘন্য দৃষ্টান্ত এটি।
দিল্লির সুলতান মুহম্মদ বিন তুঘলকের নাম থেকে এই বাক্যভঙ্গির জন্ম। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন মুহম্মদ বিন তুঘলক। বিজ্ঞান, চিকিৎসাশাস্ত্র, গণিত, দর্শন ও সাহিত্যে তিনি ছিলেন সুপন্ডিত এবং কবি ও বক্তা হিসেবেও বেশ বিখ্যাত। ১৩২৫ থেকে ১৩৫১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ছিল তাঁর রাজত্বকাল।
তবে দিল্লির সাম্রাজ্য শাসকদের গতানুগতিকতার বাইরে গিয়ে কিছু সুদূরপ্রসারী ভবিষ্যৎমুখী সংস্কার প্রচেষ্টার জন্য তিনি মধ্যযুগের দিল্লির সম্রাটদের মধ্যে সর্বাধিক তিরস্কৃত হয়েছিলেন। সমকালীন ঐতিহাসিকরাও তাঁকে ভারতবর্ষের ইতিহাসের ‘পাগলা রাজা’ বলে আখ্যায়িত করেন। নিন্দাবাচক ‘তুঘলকি’ শব্দটির জন্ম হয় তাঁর বিপ্লবাত্মক কল্যাণকামী কিছু কর্মকান্ডকে ভুল বুঝে এবং পরবর্তীকালে সেই ভুলটিকে চিরস্মরণীয় করে তুলে।
দেশের শাসনকার্যে উলেমাদের হস্তক্ষেপ অবাঞ্ছিত জ্ঞানে বন্ধ করেন তিনি – যেটি সাধারণত আজও অবাঞ্ছিত বলেই বিবেচিত। দোয়াব অঞ্চলে করবৃদ্ধি, দিল্লি থেকে দেবগিরিতে রাজধানী স্থানান্তর, মুদ্রাসংস্কার ও তামার নোট প্রচলন ইত্যাদি ব্যাপারে তিনি সমকালের চিন্তাধারা থেকে অনেক অগ্রগামী ছিলেন বলে দেশবাসী তাঁকে গ্রহণ করতে পারেনি। অথচ সুদূরপ্রসারী ভবিষ্যৎমুখী বিবেচনায় এসব পদক্ষেপ খুবই কল্যাণকর প্রমাণিত হত। কিন্তু বাস্তবে প্রবাদে পরিণত ‘তুঘলকি’ পাগলামির প্রতীক হিসেবেই হয়ে গেল অপরিবর্তনীয় ইতিহাস। (চলবে)
শুবাচে দিয়েছেন: প্রদীপ ভাদুড়ি
রহস্যময় শব্দসংসার: শুবাচ লিংক