রহস্যময় শব্দসংসার (১২)
আবদুশ শাকুর
রহস্যময় শব্দসংসার (১২)
থ: কোনো কারণে আমরা যখন থ মেরে যাই কিংবা থ হয়ে পড়ি, তখন আমরা অনেক কিছুই হই যেমন, অভিভূত, কিংকর্তব্যবিমূঢ়, হতভম্ব, স্তম্ভিত, নির্বাক, অবাক ইত্যাদি। প্রচুর অর্থ বহন করলেও আমরা জানি থ একটি বর্ণমাত্র – ব্যঞ্জন বর্ণমালার সপ্তদশ এবং ত বর্গের দ্বিতীয় বর্ণ। কিন্তু আমরা যখন থ হই, তখন বর্ণমালার অক্ষরবৎ থ হই না – হই শব্দভান্ডারের একটি শব্দস্বরূপ থ এবং সেই থ শব্দটির অর্থ হলো পর্বত।
পর্বত অর্থে থ শব্দের ব্যবহার অন্ত্যমধ্যযুগের বাংলা কবিতায় শেষবারের মতো দেখতে পাওয়া যায়। তারপর থেকে শুরু হয় থ শব্দের আলংকারিক বা উপমাঘটিত প্রয়োগ। ঘটনাচক্রে পড়ে আমরা অতি সংক্ষেপে থ হওয়া শিখি। এই শিক্ষাটা আমরা পাই থ অর্থাৎ পর্বতের নিকট থেকে। থ যেমন নিশ্চল-নিশ্চুপ হয়ে থাকে, তার এই ভাবটিই আমরা গ্রহণ করি বিশেষ পরিস্থিতিতে – যখন আমাদের মুখে আর কথা সরে না, আমরা হয়ে থাকি পর্বতবৎ মৌন ও নিশ্চল।
ন্যাকা: জেনেও না জানার এবং অসৎ হয়েও সততার ভান করাকে বাংলা বাগ্ধারায় ন্যাকামি করা বা ন্যাকা সাজা বলা হয়। একটি ফারসি শব্দের রহস্যজনক অর্থ পরিবর্তনের ফলে বাংলা ন্যাকা শব্দটির উৎপত্তি। এর মধ্যে রস ও রহস্য দুটোই রয়েছে। ন্যাকা একটি শ্লেষাত্মক শব্দ।
ফারসি ‘নেক’ থেকে তৈরি হয়েছে বাংলা ন্যাকা। ফারসিতে নেক শব্দের অর্থ হলো পুণ্য, মঙ্গল, ভালো ইত্যাদি। নেক শব্দটির প্রচলন রয়েছে বাংলায়ও। ধর্মাত্মা ব্যক্তিকে বাঙালি মুসলমানগণ নেক বান্দা বলে থাকেন। নেক বান্দা সদা সর্বদা নেক কাজ বা পুণ্যকর্ম করে থাকেন। ধর্মভীরু মুসলমান জানেন, মৃত্যুর পর অবশ্যই তাঁর নেকি-বদির অর্থাৎ নেক কাজ ও বদ কাজের হিসাব নেবেন আল্লাহতালা। নেকি শব্দটিও নেক থেকে তৈরি।
সমাজে পুণ্যাত্মাগণের পাশাপাশি দুরাত্মারাও বাস করে। এই দুই শ্রেণির মাঝখানে থাকে ভন্ডরা। তারা দুরাত্মার চেয়েও ভয়ংকর। দুরাত্মার দৌরাত্ম্য মানুষ হাড়ে হাড়ে টের পায়। কিন্তু ভন্ডরা কাজ করে গোপনে গোপনে। নেক কাজের আড়ালে তারা বদ কাজ করে। অর্থাৎ ভন্ডের নেক কাজ হলো তার ভান।
ভন্ডদের নেক কাজের এই রহস্যজনক ভানই বাঙালিকে ন্যাকা শব্দ নির্মাণে প্রণোদনা জুগিয়েছে। ন্যাকা শব্দটি পরবর্তীকালে পাপ-পুণ্যের বাইরে নানা ব্যাপারে হালকা চালে ব্যবহৃত হতে শুরু করে। জেনেও না জানার ভান করে যে ব্যক্তি, তার আচরণকে বাঙালি ভন্ডামি অর্থে ন্যাকামি করা বা ন্যাকা সাজা বলে থাকে। ন্যাকাকে কার্যকরভাবে বকা হয় শব্দটাকে স্রেফ বিশেষ স্বরভঙ্গিতে উচ্চারণ করে – ন্যাকা!
বরখাস্ত: শব্দটি বাংলা ভাষায় এসেছে ফারসি ভাষা থেকে। মূল ভাষায় বরখাস্ত অর্থ হল জেগে ওঠা, ওপরে ওঠা, অদৃশ্য হওয়া ইত্যাদি। অর্থাৎ এটি একটি নিরুদ্বিগ্ন শব্দ। বাংলা ভাষায় শব্দটির অর্থ হল – কর্মচ্যুত হওয়া, ছাঁটাই হওয়া। ফলে এটি একটি সীমাহীন উদ্বেগ সৃষ্টিকারী শব্দ। বড়োসাহেব বরখাস্ত হয়েছেন শুনে বাংলাভাষীরা ভাববেন বড়ো সাহেবের চাকরিটা গেল। আর ফারসিভাষীরা বুঝবেন বড়ো সাহেব দিবানিদ্রা থেকে এই বুঝি জেগে উঠলেন কিংবা এতোক্ষণ তিনি বসেছিলেন, এইবার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন অথবা ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। বাংলা বরখাস্তের ফারসি প্রতিশব্দ হলো ‘বারকেনার’। বারকেনার করা মানে ছেঁটে ফেলা, এক্ষেত্রে অর্থ হল কর্মচ্যুত করা।
বিনীত বিনত বিনয়াবনত: বস্ত্তত, বিনীত শব্দটি বিনয় থেকে জাত। বিনয় শব্দের মূল অর্থ বিশেষ নয়ন। এই নয়ন যাঁর থাকে তিনি নিরন্তর জ্ঞানার্জনে নিয়োজিত থাকেন। ভাষায়, চিন্তায়, কর্মে, আচরণে শৃঙ্খলাবোধ জন্ম নেয় তাঁর। এই পরিপ্রেক্ষিতে, বিনীত শব্দের মূল অর্থ সুশিক্ষিত, সংযত, নিয়ন্ত্রিত, অনাড়ম্বর, মার্জিতরুচি, সংস্কৃতিবান ইত্যাদি। কিন্তু এইসব গুণের অধিকারী কোনো ব্যক্তি তো অন্যের কাছে নিজেকে বিনীত বলে বিশেষিত করতে বা নিজের ঢাক নিজেই পেটাতে পারেন না। তাই বিনীত লিখলে পত্রপ্রাপক ভাবতে পারেন পত্রলেখক বুঝি তাঁর সঙ্গে ইয়ার্কি করছেন। দাপ্তরিক পত্র হলে, ঊর্ধ্বতন তার অধস্তনের কাছে নিঃসন্দেহে কৈফিয়ত তলব করতেন এবং সাবধান করে দিয়ে বলতেন, আপনার যে পদগত অবস্থান, সেটা বুঝে তবে বিশেষণ লাগাবেন – অর্থাৎ বিনীত না লিখে, বিনত লিখবেন।
ধনী, শিক্ষিত, সম্ভ্রান্ত, ভদ্র ইত্যাদি বিশেষণ যেমন নিজের নামের আগে নিজের হাতে বসানো চলে না, নীতিগতভাবে বিনীত বিশেষণও তেমনি চলে না। কিন্তু তারপরও চলে, অজান্তেই চলতে থাকে। এটাই হলো ভাষার জগতে শব্দের রহস্য। এবং এই রহস্যের কারণেই বিনীত শব্দের বর্তমান অর্থ বিনম্র, বিনীত, বিনয়ী, শান্ত ইত্যাদি। চিঠিপত্রে নাম স্বাক্ষরের আগে বিনীত বলে বিশেষণ প্রয়োগের অলঙ্ঘনীয় রেওয়াজই দাঁড়িয়ে গেছে। দাপ্তরিক চিঠিপত্রেও বিনীত শব্দের ব্যবহার প্রায় বাধ্যতামূলক। তাই ঊর্ধ্বতনদের উদ্দেশে লেখা চিঠিতে অধস্তনগণ বিনীত হতে বাধ্য হন। চিঠিপত্রে বিনীত শব্দটি থাকলে পত্রপ্রাপক প্রীত হন। বিনীত স্বভাবের লোকদের সকলেই পছন্দ করে। তবু আমি বলবো বিনীত না লিখে বিনত বা বিনয়াবনত লেখা ভালো, রবীন্দ্রনাথের মতো। (চলবে)
শুবাচে দিয়েছেন: প্রদীপ ভাদুড়ি
রহস্যময় শব্দসংসার: শুবাচ লিংক