রহস্যময় শব্দসংসার (১৮)
আবদুশ শাকুর
রহস্যময় শব্দসংসার (১৮)
আটঘাট: ‘আটঘাট’ বেঁধে কাজে নামতে হয় কেবল তবলচিকে। তবলার কাড়ির চতুর্দিকে মোট আটটি কাঠের গুটির ওপর চারটি করে চামড়ার ফিতা থাকে। গুটিগুলির মধ্যেকার আটটি ফাঁককে বলে ‘আট ঘাট’। আটটি গুটির ওপর হাতুড়ি ঠুকে ঠুকে ফিতেগুলিকে লুজ-টাইট করে সুষমভাবে স্বরের স্কেল মেলাতে হয়। তবেই তবলা কাঙ্ক্ষিত সুরে বাজে। অথচ শব্দবন্ধটির এমনি দাপট যে আপনি শত শত কাজের ‘হাজার ঘাট’ বেঁধে আপনার ষড়তল ভবনটির নির্মাণে লাগলেও সবাই বলবে লোকটি ‘আটঘাট’ বেঁধে লেগেছে।
খোল নলচে বদলে যাওয়া ও কলকে পাওয়া : শব্দসংসারের রহস্যময় সদস্য একবার হয়ে গেলে প্রবাদটি তার পদ সাধারণত হারায় না। যেমন হুঁকো খাওয়া পরিত্যক্ত এবং সিগ্রেট খাওয়া নিষিদ্ধ হওয়ার অনেক পরেও আমরা অনেক কিছুরই ‘খোল নলচে’ বদলে চলেছি অদ্যাবধি। এমনকি কোনো আসরে ‘কলকে পাওয়া’ যাচ্ছে না বলে আক্ষেপও করে বেড়াচ্ছি। বাংলাদেশে একসময়ে ব্যাপক সামাজিক প্রথা ছিলো সমাজে বা সভায় উপস্থিত বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে তামাক খেতে দিয়ে আদর-অভ্যর্থনা করা। তামাকের হুঁকো কিংবা নলের মুখ ঘুরতো এ-হাত থেকে ও-হাতে। এই ব্যাপারটির অংশীদার হওয়া ছিলো সামাজিক মর্যাদার লক্ষণ। এই মর্যাদাই কালে কালে বাংলা বাক্যভঙ্গিতে হয়ে গেছে কলকে পাওয়া।
আষাঢ়ে গল্প : প্রবাদ তার পদ না হারানোর আরেক জাজ্বল্যমান উদাহরণ এটি। বীজ-সার-পানি-প্রযুক্তির কল্যাণে সাংবৎসরিক ক্রপ-রোটেশনের ব্যবস্থা হয়ে যাওয়ায় ‘আষাঢ় মাসে’ও আজকাল চাষবাসের চাপে সকলেরই নাভিশ্বাস ওঠে। তবু বাংলাসাহিত্যে আজো ‘আষাঢ়ে গল্পে’র আসর বসে।
খয়ের খাঁ: তবে কোনো কোনো সদস্য তার পদটি হারায়ও, যেমন ‘খয়ের খাঁ’। তবে এ শব্দবন্ধটি অর্থের ডিগবাজির উদাহরণও বটে। আরবি ‘খায়ের’ মানে শুভ আর ফারসি ‘খাহ্’ মানে চাওয়া – এ-দুয়ে মিলে বাগ্ধারাটি শুদ্ধার্থে বোঝাচ্ছিল ‘শুভার্থী’। তবে বঙ্গদেশে নকল শুভার্থী বেড়ে গেলে ‘খায়ের খাহ্’ হয়ে গেল ‘খয়ের খাঁ’ এবং বোঝাতে লাগলো চাটুকার। বাংলাদেশে এসব স্তাবকের মোসাহেবি আরো বেড়ে গেলে তুচ্ছার্থে ‘খয়ের খাঁ’ হয়ে গেল ‘চামচা’ – বেলচার থেকে ক্ষুদ্র বলেই হয়তো।
ধুরন্ধর: ধুরন্ধর শব্দের মূল অর্থ হলো ভারবাহী বা ভারবাহক। ধুরন্ধর শব্দের আদিযুগে গাধা এবং ঘোড়াই ছিলো প্রকৃত ধুরন্ধর। আলংকারিক প্রয়োগে শব্দটির অর্থ দাঁড়ালো : যিনি অসাধারণ দক্ষতার সঙ্গে যে কোনো কার্যভার অনায়াসে বহন করতে পারেন, তিনিই ধুরন্ধর। ফরহাদ খান বলেন – ‘আমাদের চোখের সামনে দিয়েই ধুরন্ধর শব্দটা উচ্ছন্নে চলে গেলো। শয়তান, ধড়িবাজ লোককে আমরা এখন বলি মহাধুরন্ধর কিংবা ধুরন্ধর শয়তান। অথচ বছর পঞ্চাশেক আগেও ধুরন্ধর শব্দটির এমন দুর্গতি ছিলো না। তখন গর্দভ থেকে শুরু করে যে কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রধানকে ধুরন্ধর বলা যেতো।’
অনেক গুণ না থাকলে ধুরন্ধর হওয়া যায় না। তাই বহু গুণে গুণান্বিত ব্যক্তিকেই ধুরন্ধর বলা হতো। দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, উপাচার্য, অধ্যক্ষ, মহাপরিচালক – সকলেই তখন ধুরন্ধর ছিলেন। এখন এঁদের ধুরন্ধর মহাধুরন্ধর সম্বোধন করার মানে হবে গালি খাওয়া মার খাওয়া থেকে জেলে যাওয়া, এমনকি প্রাণ যাওয়াও। একবার বলে দেখুন : এতক্ষণ আপনারা ধুরন্ধরগণের বক্তৃতা শুনছিলেন, এবার সভাপতির ভাষণ দেবেন মহাধুরন্ধর প্রধানমন্ত্রী…
ভাষার কী বিচিত্র গতি! ধুরন্ধর শব্দের সেই গৌরবের দিনের কিছুই আর বাকি নেই। চতুর, ধড়িবাজ, ঘড়েল লোকেরাই এখন ধুরন্ধর। পন্ডিতগণ এবং সম্মানিতজনদের আর ধুরন্ধর বলা যাবে না। বললে গণপিটুনির শিকার হতে হবে এবং এই গণপিটুনিতে নেতৃত্ব দেবেন একালের ধুরন্ধরগণ। কেমন করে এমন হল – ভাববার মতো বিষয় বটে। (শেষ)
শুবাচে দিয়েছেন: প্রদীপ ভাদুড়ি
রহস্যময় শব্দসংসার: শুবাচ লিংক