রহস্যময় শব্দসংসার (৫)
আবদুশ শাকুর
রহস্যময় শব্দসংসার (৫)
কালি: কালি এখন নানা রঙের হয় – লাল কালি, নীল কালি, সবুজ কালি ইত্যাদি। বিভিন্ন দফতরে লেখার ভুল মোছার জন্য সাদা রঙের যে ঘন তরল ব্যবহৃত হয় তাকেও বলা হয় ‘সাদা কালি’। মানে সাদা-কালোর পার্থক্যটাও আর রইল না। অথচ কালো বলেই নামটা ছিল কালি। কালি শব্দের মূল অর্থ – লেখার জন্য ব্যবহৃত কৃষ্ণবর্ণ তরল পদার্থবিশেষ। কালির আলংকারিক প্রয়োগও রয়েছে এবং তা কালির মৌলিক কালো রঙের সুবাদেই, যেমন – কুলে কালি দেওয়া, মুখে চুনকালি দেওয়া। এখানে কালি বলতে কালির আসল কালো রঙের কথাই বলা হয়েছে।
তেল: তেল শব্দটি তৈরি হয়েছে তিল থেকে। ঘানিতে পিষে বের করা হয় বলে কী? সর্ষের তেলও তো ঘানিতে পিষেই বের করা হয়। তো শব্দটা সর্ষে থেকে তৈরি হল না কী কারণে? উত্তর হল ভাষার স্বেচ্ছাচারিতার কারণে। সে যাক। তেল রান্নায় লাগে। গায়ে মাখা হয়। মাথায় দেওয়া হয়। এমনকি নাকে দিয়ে ঘুমাতেও বলা হয়। তেল মাখার ফলে মাথার চুল ও দেহ মসৃণ এবং উজ্জ্বল হয়। কখনো কখনো এই উজ্জ্বলতা ও মসৃণতা সঞ্চারিত হয় মনে। তখন সৃষ্টি হয় দর্প, তেজ ও অহংকারের। এসব বিশেষণের ব্যক্তিবিশেষকে দেখে লোকে বলে, মানুষটার বড় তেল হয়েছে। দেহে তেল হয়তো না দিলেও চলে, যন্ত্রে না দিলে তো যন্ত্র চলেই না – যেজন্যে বলে, নিজের চরকায় তেল দাও। তেলের আলংকারিক ব্যবহার এবং তজ্জনিত তিরস্কার ব্যাপক। ক্ষমতাবানকে তেল মেরে কার্য উদ্ধারকারী তিরস্কৃত ধান্দাবাজদের কথা ভাবুন।
প্রফুল্ল: ফুলের সঙ্গেই প্রফুল্ল শব্দের আসল সম্পর্ক। শব্দটির মূল অর্থ প্রস্ফুটিত; বিকশিত। উদাহরণ – প্রফুল্ল গোলাপ, প্রফুল্ল রজনীগন্ধা, প্রফুল্ল কদম। রবীন্দ্রনাথের গানে আছে – ‘প্রজাপতির দল যেখানে জুটি/ রঙ ছড়াল প্রফুল্ল রঙ্গনে’। প্রফুল্ল শব্দের এই জাতীয় প্রয়োগ এখন আর নেই। কবে যেন শব্দটি বাগান ছেড়ে ঘরে ঢুকে পড়েছে, সম্পর্ক তৈরি করেছে মানুষের সঙ্গে – অর্থও ফেলেছে পালটে। প্রফুল্ল শব্দের বর্তমান অর্থ – প্রসন্ন, সহাস্য, হৃষ্ট, পুলকিত। প্রফুল্ল চিত্ত, প্রফুল্ল মন, প্রফুল্ল বদন। প্রফুল্ল শব্দের নিবিড় সম্পর্ক ইদানীং দৃশ্য বদনের সঙ্গে আর অদৃশ্য হৃদয়ের সঙ্গে। সংস্কৃতে বদন শব্দের অর্থ মুখমন্ডল – যেমন মলিন বদন, প্রফুল্ল বদন। আর ফারসিতে বদন হলো দেহ – যেমন গুলবদন অর্থাৎ ফুলের মতো কোমল দেহধারিণী। উদাহরণত একটি লোকসংগীত স্মরণ করুণ – ‘সোহাগ চাঁদবদনী ধনি নাচো তো দেখি’। (চলবে)
শুবাচে দিয়েছেন: প্রদীপ ভাদুড়ি
রহস্যময় শব্দসংসার: শুবাচ লিংক