রহস্যময় শব্দসংসার (৬)
আবদুশ শাকুর
রহস্যময় শব্দসংসার (৬)
অভিমান: বাংলা ভাষার অতি বিশিষ্ট এবং গদ্যে-পদ্যে সমান ব্যবহৃত একটি শব্দ অভিমান। শব্দটির প্রচলিত অর্থ হলো প্রিয়জনের অপ্রিয় আচরণ ও অগোপন অনাদরের কারণে সৃষ্ট মনোযাতনা বা চাপা ক্ষোভ। আরেকটি অর্থ হল প্রিয়জনের প্রতি কৃত্রিম বিরূপতা প্রকাশ, যেমন – প্রেমিক-প্রেমিকার অভিমান। অভিমান কথাটা সহজ নয়। অভিমান ভাঙানো আরো কঠিন। শব্দটির মূল অর্থ কিন্তু বর্তমান প্রচলিত অর্থের সম্পূর্ণ বিপরীত। অভিমান শব্দের মূল অর্থ হল নিজের প্রতি মান, ‘আমার সমান নেই’ এই রকম ভাব। আর এই ভাব থেকে সৃষ্ট অভিমান শব্দের আরো আরো অর্থ হলো আত্মসম্মান, গৌরব, মান, অহংকার এবং এ জাতীয় আরো অনেক কিছু।
অভিমান হিন্দি ভাষায়ও আছে। সেখানে শব্দটি আদি অর্থ বহন করে এবং গীত-গজলে বহুলব্যবহৃত সেই শ্লাঘা অর্থেই। তবে লক্ষণীয় যে বাংলার স্নিগ্ধ কোমল শ্যামল প্রকৃতিতে অভিমান শব্দটি যে অম্লমধুর অর্থ বহন করে হিন্দিভাষী উত্তর বা পশ্চিমভারতের শুষ্ক কঠোর প্রকৃতির পরিবেশে অভিমানের মধ্যে সেই পেলবতা, আর্দ্রতা বা লাবণ্যের ভাবটি নেই। অভিমান লাবণ্যের মতোই অধরা মাধুর্যমন্ডিত একটি শব্দ।
মুহূর্ত পলক নিমেষ ও ক্ষণ: ‘মুহূর্তেই শেষ’ বললে মনে হবে নিমেষেই শেষ অথবা চোখের পলকেই শেষ। আসলে কোনোটাই ঠিক নয়। এগুলো হল সময়ের হিসাব না করে অত্যন্ত অল্প সময় বোঝানোর জন্য ব্যবহৃত বাগ্ধারা, বা ইডিয়ম বা ‘টার্ন অব স্পিচ’। সময়ের মাপে এক মুহূর্ত হল ৪৮ মিনিট। নিমেষ হলো পলক, চোখের পাতা ফেলার মধ্যবর্তী সময়। নির্নিমেষ নয়নে চেয়ে থাকার অর্থ পলকহীন দৃষ্টিতে চেয়ে থাকা। তবে সময়ের হিসাবে এক নিমেষ হয় ষোলো মিনিটে।
পলক শব্দটি ফারসি। পলক ও নিমেষে অর্থগত কোনো পার্থক্য নেই। তবে কিছুটা আছে প্রয়োগের বেলায়। চোখের নিমেষে আর চোখের পলকে দুটোই চলে। কিন্তু চোখের নিমেষ পড়ছে না বলে না। বলে চোখের পলক পড়ছে না। ক্ষণও অতি অল্প সময় বোঝায়। তবে কতটা অল্প, তা হিসেব করার প্রয়োজন আমাদের হয় না। সময়ের মাপে ক্ষণেরও নির্দিষ্ট হিসাব আছে। ক্ষণ হলো নিমেষের এক-চতুর্থাংশ সময় অর্থাৎ চার মিনিট। তবে জ্যোতিষ শাস্ত্রে ক্ষণের কালসীমা হলো মুহূর্তের সমান, অর্থাৎ ৪৮ মিনিট।
কদলি: কদলি বা কলা বাংলাদেশের অতি প্রাচীন অতি স্বাদু অতি উপকারী একটি ফল। পুষ্টিকর এই ফলটির ফসল এবং ফলনসহ প্রায় সবকিছুই ‘অতি’। এটি পাওয়া সহজ, ছিলা সহজ, গিলা সহজ এবং হজমও সহজ। পটাশিয়ামসহ বহু ভেষজগুণ সংবলিত কদলি নানাবিধ খনিজ পদার্থে ভরা। বিশাল কদলিপত্র তো গণভোজনের পাত্র হিসেবে একান্তই অবিকল্প। কলার গাছটিও সহজ সরল এবং একেবারেই ঝামেলামুক্ত।
সর্বপ্রকার সহজের সমাহার বলেই সহজ সরল প্রাণী গোরু-গাধার মতো ফল ও গাছসহ কদলি নানাবিধ গালির একটি উৎকৃষ্ট উপকরণ। যেমন কারও প্রতি ‘তুমি আমার কলাটা করবে’ কিংবা ‘কাঁচকলা খাও বা কলাপোড়া খাও’ – এমন ধরনের বাক্য প্রয়োগ। কাউকে কলা দেখানোর চর্চা তো এই ভোগানো আর ঠকানোর দেশে ব্যাপকতম হারেই চলে। ভেতরে-বাহিরে সমান মসৃণ এই বোকা ফল কলার সংস্কৃত নাম রম্ভা দিয়ে তৈরি শব্দবন্ধ ‘কাজের বেলায় অষ্টরম্ভা’ তো জবর বকা। রহস্যমায় শব্দসংসার(৬), শুদ্ধ বানান চর্চা (শুবাচ) লিংক। (চলবে)
শুবাচে দিয়েছেন: প্রদীপ ভাদুড়ি
রহস্যময় শব্দসংসার: শুবাচ লিংক