রহস্যময় শব্দসংসার (৭)

রহস্যময় শব্দসংসার (৭)

আবদুশ শাকুর

রহস্যময় শব্দসংসার (৭)
কদলি: কদলি বলতে গাছ ও ফল দুটোকেই বোঝায়। তবু অনেক সময় আলাদা করার জন্য বলা হয় কলাগাছ, কদলিবৃক্ষ – এমনকি রম্ভাতরুও। উচ্চারণে যত ওজস্বীই হোক, তরকারি হিসেবে সুপাচ্য এবং নির্দোষ। তবে ব্যঞ্জনটি সুস্বাদু নয় বলে এটিও ব্যবহৃত হয় মন্দার্থেই – কপালে আছে কদলিভক্ষণ। বৃক্ষ-তরু বলা হলেও কলার গাছটি সর্বাংশে পানসে এবং এতই নরম যে ঝড়ের প্রথম দমকাতেই ভেঙে পড়ে। কদলি শব্দটির মূল অর্থও তাই – যা বায়ু কর্তৃক দলিত হয়।
চাকরি: চাকর ফারসি শব্দ। ফারসি উচ্চারণ ‘চাকার’। শব্দটির অর্থ গোলাম, ভৃত্য, ফাইফরমাশ খাটে এমন ব্যক্তি। চাকরি শব্দটিও ফারসি, যার অর্থ চাকরের কাজ। শব্দটি বাংলাতে এসে চরিত্র হারায়নি, তবে এর অর্থের হয়েছে অভাবনীয় উন্নতি। শব্দের অর্থের যে কত বেশি উন্নতি হতে পারে বাংলায় চাকরি শব্দটা তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। চাকরি ফারসি ভাষায় চাকর বা গোলামের কাজ হলেও বাংলাদেশে কিন্তু জীবিকা হিসেবে সর্বোচ্চ সম্মানের। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ রসিকতা করে বলেছেন, ‘যাঁহারা চাকরি করেন, যদি তাঁহাদিগকে তাঁহাদের মনিবের চাকর বলা যায়, তবে হয়তো তাঁহারা মানহানির মোকদ্দমা রুজু করিবেন।’
অবশ: শরীর অবশ হয়, মনও। অবশ হলে শরীর নেতিয়ে পড়ে, হাত-পা চলতে চায় না। মন অবশ হলে কিছুই ভালো লাগে না। ব্যাধির কারণেও শরীর অবশ হতে পারে। পক্ষাঘাতে শরীরের একাংশ সম্পূর্ণ অবশ হয়ে যায়। কোনোরকম সাড় বা অনুভূতি থাকে না। অবশ শব্দের মূল অর্থ – যা নিজের বশে নেই অর্থাৎ যা নিজের বশীভূত নয়। অবশ বলতে তাই স্বাধীনও বোঝায়। মূল অর্থগত দিক থেকে অবশ কোনো ব্যক্তি বা প্রাণীর বিশেষণ হতে পারত। কিন্তু ভাষার বিচিত্র খেয়ালে তা হয়নি। অবশ এখন কেবল দেহের এবং মনের বিশেষণ, ব্যক্তির নয়।

খই ফোটা: কারো কারো মুখে কথার যেন খই ফোটে। মানুষ তাতে মুগ্ধ হয়ে যায়। খই ফোটা বিশিষ্টার্থক একটি বাগ্ধারা। এর অর্থ অনর্গলভাবে কথা বলা, চমকপ্রদ বক্তৃতার ভঙ্গিতে দ্রুত কথা বলা। কথাটির উৎপত্তি ধান্যজাত সুপরিচিত সুখাদ্য খই থেকে। নেই কাজ তো খই ভাজ বলে একটা প্রবচন চালু আছে। তবে তা নিতান্তই কথার কথা। মানুষ কাজ হিসেবেই খই ভাজে এবং সেটা বিশেষ প্রয়োজনেই। খই নির্দোষ সুপাচ্য খাদ্য বলেই রোগীর পথ্য।
খই ভাজার জন্য বিশেষ আয়োজনও করতে হয়। মুখ চওড়া হাঁড়িতে বালু পর্যাপ্ত পরিমাণ তপ্ত করে সেই তপ্ত বালুর ওপর নির্দিষ্ট কায়দায় ছেড়ে দেওয়া হয় খইয়ের বিশেষ ধান। তারপরই হাঁড়িতে খই ফুটতে থাকে সশব্দে, পপকর্নের মতো। সে এক দেখার মতো দৃশ্য বটে। চুলায় সশব্দ খই ফোটার এই দৃশ্যটিই ‘মুখের কথায় খই ফোটা’ বাগ্ধারায় পরিণত হওয়ার প্রেরণা জুগিয়েছে।
জের ইজা: পরের পাতায় হিসাবের জের টানা থেকে শুরু করে জীবনের অনেক কিছুরই জের টানতে হয় মানুষকে – তর্কের জের, ভুলের জের, ঝগড়ার জের, মারামারির জের ইত্যাদি। মনোমালিন্যের জের টানা তো বংশবিশেষে জেনারেশনের পর জেনারেশন ধরে চলতে থাকে। জের টানার এই ব্যাপারটি থেকে আলংকারিক অর্থ – ভুলের মাসুল দেওয়া অর্থাৎ পরিণাম ভোগ করা। হিসাবের খাতা থেকে উঠে আসা শব্দটির সাধারণ অর্থ হল আগের পাতার শেষ না হওয়া হিসাব পরের পাতায় ওঠানো। এই হল মূল জের টানা।
জের ফারসি ভাষার শব্দ। ফারসিতে শব্দটির অর্থ নিম্নে, বা নিচে। বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত জের শব্দের প্রতিশব্দ হলো ইজা। এই শব্দটিও ফারসি। তবে ফারসিতে ইজা বলতে বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত জের বোঝায় না, বোঝায় অধিকন্তু, আরও, এ ছাড়া, পূর্বে উল্লিখিত ইত্যাদি। ইজা শব্দের এসব অর্থের মধ্যে জের শব্দের অনেকটা অর্থ খুঁজে পাওয়া যায়। মূল ফারসি ভাষায় কিন্তু জের কিংবা ইজা কোনোটাই হিসাবের খাতার শব্দ নয়। এটাও আরেক তামাশা রহস্যময় শব্দসংসারের। (চলবে)

শুবাচে দিয়েছেন: প্রদীপ ভাদুড়ি

রহস্যময় শব্দসংসার: ওয়েবসাইট লিংক
শুবাচ গ্রুপের লিংক: www.draminbd.com
তিনে দুয়ে দশ: শেষ পর্ব ও সমগ্র শুবাচ লিংক

রহস্যময় শব্দসংসার: শুবাচ লিংক

 

Language
error: Content is protected !!