ড. মোহাম্মদ আমীন
এই পেজের সংযোগ: https://draminbd.com/লকডাউন-লকআউট-ধর্মঘট-কারফ/
লকডাউন লকআউট ধর্মঘট কারফিউ এবং ১৪৪ ধারা
লকডাউন: ভয়ংকর কোনো মহামারি বা দুর্যোগ প্রতিরোধে জনসাধারণের স্বাভাবিক চলাচল ও প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ডে সীমাবদ্ধতা আরোপ অনিবার্য হয়ে পড়লে, সরকার বিশেষ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে রাষ্ট্রীয় প্রশাসন যন্ত্রের মাধ্যমে জনসাধারণকে নির্ধারিত সময়ের জন্য গৃহে কিংবা নির্ধারিত এলাকার বাইরে চলাচল কিংবা নির্দিষ্ট কিছু কার্যক্রম ছাড়া অন্য কাজ হতে বিরত থাকার নির্দেশ প্রদান করতে পারে। এই নির্দেশকে বলা হয় লকডাউন। লকডাউন দুই প্রকার। যথা: আংশিক লকডাউন ও ফুল লকডাউন।
আংশিক লকডাউন চলাকালে মানুষ মৌলিক চাহিদাদি সংগ্রহের জন্য সীমিত সময়ের জন্য সীমিত পরিসরে ঘর থেকে বের হতে পারে। সরকার জনসাধারণের কল্যাণের জন্যই লকডাউন করে। এসময় অনিবার্য না হলে সর্বসাধারণের চলাফেরাকে নিরুৎসাহিত করা হয়।
আংশিক লকডাউনে সরকারের মূল উদ্দেশ্য থাকে, মানুষের চলাফেরা সীমিত করে দেওয়া; যাতে তারা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্বাভাবিক সময়ের মতো অবাধে বিচরণ না করতে পারে বা না করে। লকডাউনে সরকারের নির্দেশনার সঙ্গে জনগণের স্বতস্ফুর্ত সহায়তার সমন্বয় করা হয়।
ফুল লকডাউনের সময় মানুষ নিজের ঘর কিংবা নির্ধারিত এলাকা থেকে অনিবার্য চিকিৎসাগত প্রয়োজন বা অত্যন্ত দরকারি কিছু না হলে কোনমতেই ঘর থেকে বের হওয়া যায় না। যে-কারণেই হোক না, ফুল লকডাউনের সময় ঘর থেকে বের হতে হলে প্রশাসনের পূর্বানুমতি নিতে হয়। প্রধানত রোগজীবাণুর বিস্তার রোধের জন্য লকডাউন আদেশ জারি করা হয়। এতে জনগণের সায় থাকে। এসময় জনগণের স্বাভাবিক চলাচলকে কাঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
ধর্মঘট: সকলে ঐক্যবদ্ধভাবে কিছু করা বা করা হতে বিরত থাকার প্রতিজ্ঞার মাধ্যমে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত কাজ বন্ধ রাখা অর্থে ‘ধর্মঘট’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়। ‘ধর্মঘট’ অর্থ লৌকিক দেবতা ধর্ম ঠাকুরের উদ্দেশ্যে নিবেদিত ঘট। ধর্ম ঠাকুরকে সাক্ষী রেখে প্রতিবছর বৈশাখ মাসে গঙ্গাজল পূর্ণ করে এ ঘট স্থাপন করে কোনো বিষয়ে সিদ্ধিলাভের জন্য প্রতিজ্ঞা করা হতো। ধর্ম ঠাকুরের উপাসকদের বিশ্বাস ছিল, কোনো অধার্মিকের পক্ষে ধর্মঘট উত্তোলন বা ভঙ্গ করা সম্ভব নয়। ধর্মঘট স্পর্শ করে প্রতিজ্ঞা ও সিদ্ধিলাভের জন্যই ধর্মঘট শব্দটি ক্রমান্বয়ে ধর্ম ছেড়ে দাবি আদায়ের আন্দোলনে চলে আসে। মধ্যযুগের বাংলা কবিতায় ধার্মিক শব্দের প্রতিশব্দ হিসেবে ধর্মঘটি শব্দটি প্রচলিত ছিল।এখন ধর্মঘট বলতে ধার্মিক বুঝায় না, যারা ধর্মঘট করেন তাদের বোঝায়। যারা ধর্মঘট করে তারা নিজেদের দাবিদাওয়াকে ন্যায্য গণ্যে উদ্দেশ্য হাসিল না হওয়া পর্যন্ত চালিয়ে যাবার প্রতিজ্ঞা করে।
লকআউট: ইংরেজি (lockout) লকআউট অর্থ শ্রমিক অসন্তোষ, আর্থিক, রাজনীতিক বা অন্য কোনো কারণে মালিক পক্ষের কারখানা বন্ধ রাখার ঘোষণা। অর্থাৎ, মালিক বা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের কোনো কারণে কোনো শিল্প-কারখানা বন্ধ ঘোষণা করাকে লকআউট বলা হয়। লকআউট সাময়িক না কি স্থায়ীভাবে হবে তা ঘোষণার মধ্যেই বলা থাকে, অথবা পরে জানানোর ইঙ্গিত থাকে।লকআউট ও ধর্মঘটের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। ধর্মঘটে নির্দিষ্ট সুবিধা পাওয়ার কিংবা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে শ্রমিক-কর্মচারী নিজেরাই কাজ করতে অস্বীকৃতি জানায়, কিন্তু লকআউটে মালিকপক্ষ কর্মচারীদের কর্মসংস্থানে যোগ দেওয়ার সুযোগ বন্ধ করে দেয়।
কারফিউ : রাজনীতিক, প্রশাসনিক বা অন্য কোনো কারণে কোনো একটা নির্দিষ্ট সময়ে চারজনের অধিক মানুষকে একত্রে সর্বসাধারণের অধিকারভুক্ত স্থানে বা প্রকাশ্যস্থানে জমায়েত বা মিলিত হওয়া থেকে বিরত রাখার জন্য কারফিউ জারি করা হয়। সাধারণত দাঙ্গা বা জনরোষ ভয়ংকর রূপে দেখা দিলে এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সাধারণ আইন দ্বারা তা প্রতিরোধ কিংবা জনতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে অসমর্থ হলে তা প্রতিহত কিংবা অনুরূপ আশঙ্কা প্রতিরোধ করার জন্য কারফিউ জারি করা হয়। পরিস্থিতির ওপর কাউফিউর মাত্রা ও সময় নির্ভর করে। সাধারণত সরকার বিরোধী আন্দোলন দমনে কারফিউ জারি করা হয়।
১৪৪ ধারা: ফৌজদারি কার্যবিধির ১৪৪ ধারামতে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় বলে এটাকে ১৪৪ ধারা বলা হয়।১৪৪ ধারা হল বাংলাদেশের ফৌজদারী কার্যবিধি, ১৮৯৮-এর একটি ধারা। এই আইনে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে জেলাম্যাজিস্ট্রেট বা জেলাম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতিসাপেক্ষে কোনো নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কোনো এলাকায় একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সভা-সমাবেশ করা, আগ্নেয়াস্ত্র বহন-সহ যে-কোনো কাজ নিষিদ্ধ করতে পারে।তবে মেট্রোপলিটন এলাকায় এই আদেশ জারি করার ক্ষমতা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের পরিবর্তে পুলিশ কমিশনারের ওপর ন্যস্ত। যেমন: ঢাকা মহানগর পুলিশ অধ্যাদেশের ২৮ ধারা প্রদত্ত ক্ষমতাবলে পুলিশ কমিশনার অস্ত্র বহন, স্লোগান প্রদান ইত্যাদি নিষিদ্ধ করে আদেশ দিতে পারেন।
এই ধারায় সরকারকে উপদ্রবের আশঙ্কায় নির্দেশ জারি করবার ক্ষমতা দেওয়া রয়েছে। ১৪৪ ধারা জারি করে পাঁচ বা তার বেশি সংখ্যক ব্যক্তির জমায়েতের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। মোবাইল ফোন সংস্থাগুলিকে একটি বা একাধিক ছোট বা বড় জায়গা জুড়ে ভয়েসকল, এসএমএস বা ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দেবার নির্দেশ দেয়। ১৪৪ ধারা জারি হলে কোনো অসামরিক ব্যক্তি লাঠি, ধারালো অস্ত্র বা আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে জনবহুল স্খানে যেতে পারে না।
——————————————————–