কীভাবে হলো দেশের নাম (আফ্রিকা)
ড. মোহাম্মদ আমীন
লিবিয়িা (Libya)
প্রাচীন বার্বার (Berber) ) উপজাতীয় জনগোষ্ঠীকে গ্রিকরা লিবাইয়ানস (Libyans এবং মিশরিয়ারা লিবু (Rbw/Libue) বলত। ত্রিপোলিতানিয়ান নিম্নভূমি এবং পাজান মালভূমির (পশ্চিমাংশ) মধ্যবর্তী বিশাল মরুভূমি এবং মিশরের নিল নদীর উপত্যাকার পূর্বাংশকে লিবিয়া বলা হতো।
লিবিয়া নামের উদ্ভব সম্পর্কে একাধিক প্রবাদ, ব্যাখ্যা ও পৌরাণিক কাহিনি প্রচলিত আছে। তবে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য প্রবাদ হচ্ছে বার্বার-রেবু প্রবাদ। কারণ প্রায় সব ব্যাখ্যার সঙ্গে এটি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত। প্রাচীন বার্বার জনগোষ্ঠী মিশরীয়দের কাছে এটি রেবু (Rebu ) বা রিবু (Ribu ) নামে পরিচিত ছিল। আরবীয়সহ পাশ্ববর্তীদের কাছে যার উচ্চারণ ছিল লিবু। কথিত হয়, এ লিবু শব্দ হতে লিবিয়া নামের উদ্ভব। সাইরেনাইকার (Cyrenaica) প্রত্নতাত্ত্বিক সাইট কাসার লিবিয়ায় (Qaser Libia) ‘লিবিয়া’ নামটির উল্লেখ পাওয়া যায়। বলা হয়, প্রাচীন গ্রাম অলিবিয়া (Olbia) হতে নামটির উদ্ভব। অনেকে বলেন, (Lewwa) শব্দ হতে লিবিয়া (Libya) ও লুবডা (Lubda) নামের উদ্ভব। বার্বার জনগোষ্ঠীর এক বিখ্যাত পূর্বপুরুষ ইবনে খালাদুন এ নাম দেন।
বার্বার লিউ আফ্রিকানাস (1600, p.13) অনুসারে, গ্রিকগণ অঞ্চলটিকে লিবিয়া বলতেন। কারণ, প্রাচীনকালে মৌরিতানিয়ার রাজা লিবস (Libs) এটি দখল করে নিয়েছিলেন। লিবস এর সঙ্গে (ya) যুক্ত হয়ে নাম হয় লিবিয়ি। এর অর্থ লিবস এর অর্জিত দেশ। অ্যারাবিয়ানস, ইথিওপিয়ানস অ্যালকেবুলাম ও ভারতীয় বেসকাথ এর ‘Ethiopians Alkebulam’ ও ‘Indians Besecath’ পবিত্র গ্রন্থে এটাকে চ্যামেসিস (Chamesis) বলা হয়েছে। বাইবেলে লিবিয়াকে বলা হয়েছে লুবিম বা লেবাহিম (Lubim or Lebahim)। তিনি ছিলেন মিজরাইম(Mizraim) এর পুত্র। উত্তর আফ্রিকার বার্বার জাতিগণ গর্বের সঙ্গে মিজরাইমের নানা অলৌকিক ঘটনা বলে থাকেন।
লিবিয়া নামের উৎপত্তির সঙ্গে গ্রিক পুরাণের একটি কিংবদন্তিও জড়িত। কথিত হয়, গ্রিক দেবী লিবিয়ার (Libya) নাম হতে লিবিয়া নামের উদ্ভব। রোমান সা¤্রাজ্যের উত্থানের পূর্বে বর্তমান লিবিয়াসহ পুরো অঞ্চল বার্বার জনগোষ্ঠীর দেবী আফ্রির (Afri) নামানুসারে আফ্রিকা হিসাবে পরিচিত ছিল। পুরাণমতে, দেবী লিবিয়া ও তার স্বামী সমুদ্র-দেবতা পসিডোনের (Poseidon) বেলুস (Belus), অ্যাগেনর (Agenor) ও লেলাক্স (Lelex) নামের তিন সন্তান ছিল। রাজা বেলুস লিও আফ্রিকানাসের (Leo Africanus) চেমিস বা চেমেসিস রাজ্য শাসন করতেন। অ্যাগেনর কানান অঞ্চল, বর্তমান মধ্যপ্রাচ্যে অভিবাসী হন এবং লেলেক্স মেগারার (Megara) রাজা হন। বেলুস এর স্ত্রী অ্যাঞ্চিনু (Anchinoe) ছিলেন নিল-দেবতা নিলুসের (Nilus) কন্যা। তাদের অ্যাজিপ্টাস (Aegyptus), দানাউস (Danaus) ও চেফিউস(Cepheus) নামের তিন পুত্র এবং লামিয়া নামের এক কন্যা ছিল। লামিয়া ছিলেন লিবিয়ান সর্প-দেবী। দানাউস তার পঞ্চাশ কন্যাকে এবং অ্যাজিপ্টাস তার পঞ্চাশ পুত্রকে চাতুরিপূর্বক মিশর (Egypt) শাসনের জন্য প্রেরণ করেন।
লিবিয়া উত্তর আফ্রিকাতে ভূমধ্যসাগরের দক্ষিণ তীরে অবস্থিত একটি রাষ্ট্র। এর উত্তরে ভূমধ্যসাগর, পূর্বে মিশর, দক্ষিণ-পূর্বে সুদান, দক্ষিণে চাদ ও নাইজার, এবং পশ্চিমে আলজেরিয়া ও তিউনিসিয়া অবস্থিত। ভূমধ্যসাগরের তীরে অবস্থিত ত্রিপোলি শহর লিবিয়ার বৃহত্তম শহর ও রাজধানী। আকারে বিশাল হলেও দেশের বেশিরভাগ অংশ জুড়ে রয়েছে সাহারা মরুভূমি। লিবিয়র প্রায় সব লোক উপকূলবর্তী অঞ্চলে বাস করে। লিবিয়ার তিনটি প্রধান অঞ্চল হল ত্রিপোলিতানিয়া, ফেজ, ও সিরেনাইকা।
বার্বার জাতির লোকেরা লিবিয়ার আদিবাসী। খ্রিস্টীয় ৭ম শতকে এখানে আরবদের আগমন ঘটে। বর্তমান লিবিয়ার অধিবাসীরা এই দুই জাতের মিশ্রণ। স্বল্পসংখ্যক বার্বার এখনও দেশের দক্ষিণ প্রান্তসীমায় বাস করে। লিবিয়ার অধিকাংশ অধিবাসী ইসলাম ধর্মাবলম্বী।
লিবিয়ার মোট আয়তন ১৭,৫৯,৫৪১ বর্গকিলোমিটার বা ৬,৭৯,৩৫৯ বর্গমাইল। ২০১৪ খ্রিস্টাব্দের হিসাবমতে, লিবিয়ার জনসংখ্যা ৬২,৪৪,১৭৪ জন এবং প্রতি বর্গকিলোমিটার লোকসংখ্যা ৩.৫৫ জন। আয়তন বিবেচনায় লিবিয়া পৃথিবীর ১৭-তম বৃহত্তম দেশ এবং জনসংখ্যা বিবেচনায় ১০৮-তম। কিন্তু জনসংখ্যার ঘনত্ব বিবেচনায় পৃথিবীর ২১৮-তম জনবহুল দেশ।
২০১৩ খ্রিস্টাব্দের হিসাবমতে, লিবিয়ার জিডিপি (পিপিপি) ৭০.৩৮৬ বিলিয়ন ইউএস ডলার এবং মাথাপিছু আয় ১১,৪৯৭ ইউএস ডলার। অন্যদিকে, জিডিপি (নমিনাল) ৬৭.৬২২ বিলিয়ন ইউএস ডলার এবং মাথাপিছু আয় ১১,০৪৬ ইউএস ডলার (৬২-তম)। মুদ্রার নাম লিবিয়ান দিনার। রাজধানী ত্রিপলি। সরকারিভাবে লিবিয়ার অধিবাসীদের লিবিয়ান বলা হয়। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১০ ফেব্রুয়ারি ইতালি হতে স্বাধীনতা লাভ করে এবং ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দের ২৪ ডিসেম্বর ব্রিট্রেন-ফ্রান্স যৌথ তদারকি হতে অবমুক্ত হয়। সরকারি ভাষা আরবি, তবে আরও কয়েকটি ভাষা ও ইংরেজি প্রচলিত আছে। ইসলাম এখানকার রাষ্ট্রধর্ম এবং ৯৭% লিবিয়িান মুসলিম।
১৯৫০-এর দশকে খনিজ তেল আবিষ্কারের আগে লিবিয়া একটি দরিদ্র রাষ্ট্র ছিল। পেট্রোলিয়ামের বিরাট মজুদ আবিষ্কারের পর থেকে লিবিয়া আফ্রিকার সবচেয়ে ধনী রাষ্ট্রে পরিণত হয়। তবে এখনও অনেক লোক খামার ও পশুচারণের কাজে নিয়োজিত, যদিও ভাল খামারভূমির পরিমাণ খুব কম।
লিবিয়ায় প্রাচীনকালে ফিনিসীয়, রোমান ও আরবেরা বসতি স্থাপন করেছিল। প্রথমে রোম, কার্থেজ এবং ভ্যান্ডালসদের দ্বারা পরপর শাসিত হয়। মধ্য যুগে আরব, মরক্কো এবং মিশর আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করে। ১৬শ শতকে স্পেন এবং মাল্টার নাইটগণ কিছুদিন এ ভূমির ওপর কর্তৃত্ব করে। ১৫৫১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯১১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত লিবিয়া তুর্কিদের অধীনে ছিল। এরপর এটি ইতালির অধীন হয়। ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দের ২৪ ডিসেম্বর লিবিয়া স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দ হতে ২০১১ খ্রিস্টাব্দে গাদ্দাফির পতন পর্যন্ত লিবিয়ার জাতীয় পতাকা ছিল নিঁখুত সবুজ রঙের। বিশ্বে এটিই ছিল একমাত্র একরঙা মানচিত্র। লিবিয়ার ইতিহাসে মাত্র একজন রাজা ছিলেন। তার নাম ইদ্রিস। তিনি ১৯৫১ হতে ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে গাদ্দাফির নেতৃত্বাধীন বিদ্রোহী বাহিনীর কাছে পরাজিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত লিবিয়ার রাজা ছিলেন।
১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে তরুণ সামরিক অফিসার মুয়াম্মার আল-গাদ্দাফি ক্ষমতা দখল করেন। ২০১১ খ্রিস্টাব্দর ১৭ ফেব্রুয়ারি গাদ্দাফির বিরুদ্ধে জনগণ বিদ্রোহ ঘোষণা করে। ২০১১ খ্রিস্টাব্দের ২৭ ফেব্রুয়ারি বিদ্রোহী বাহিনি অন্তর্বতীকালীন সরকার ঘটন করে। ২০১১ খ্রিস্টাব্দের ২০ অক্টোবর গাদ্দাফির সরকার মার্কিন ও ন্যাটোর সাহায্যে পরিচালিত বিদ্রোহী বাহিনীর কাছে চূড়ান্তভাবে পরাজিত এবং গাদ্দাফি নিহত হয়।
লিবিয়ার প্রায় সমস্ত বৈদেশিক মুদ্রা পেট্রোলিয়াম রপ্তানি করে অর্জন করা হয়। পেট্রোলিয়াম রপ্তানি করে প্রাপ্ত অর্থ জিডিপির অর্ধেকের যোগান দেয়। লিবিয়ার জনসংখ্যা অল্প বলে দেশটির মাথাপিছু জিডিপির পরিমাণ আফ্রিকার সর্বোচ্চ কয়েকটি দেশের অন্যতম।
লিবিয়ার মেয়েদের ঘরদোর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা, রান্নাবান্না ও সন্তান জন্মদান ছাড়া প্রকৃতপক্ষে আর কোনো অধিকার নেই। সরকার প্রত্যেক নাগরিকের লেখাপড়া চিকিৎসার যাবতীয় ব্যয় বহন করে থাকে। এ দেশে অ্যালকোহল পান নিষিদ্ধ। লিবিয়ার নাগরিকদের সরকার বিনাসুদে ঋণ দিয়ে থাকে। এ দেশে কোনো ভিক্ষুক নেই, এমনকি ন্যাটোর বিমান হামলার পরও কেউ গৃহহীন হয়নি। নববিবাহিতদের বসবাসের জন্য সরকার বিনা খরচায় অ্যাপার্টমেন্ট বা ঘর দিয়ে থাকে। তারপরও এক তৃতীয়াংশ লোক নিরাপদ পানি পানের সুযোগ হতে বঞ্চিত। এখানকার সব আদালত সরকার নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। তাই উন্মুক্ত ও স্বাধীন বিচারের সুযোগ নেই।
চাকরি না পাওয়া পর্যন্ত লিবিয়ানদের সরকার এ পরিমাণ অর্থ দিয়ে থাকে, যেন যেন সে চাকরিতে নিয়োজিত। ছাত্র-ছাত্রীরা যে পেশায় চাকরির জন্য অধ্যয়ন করছে, ছাত্রত্ব শেষ না হওয়া পর্যন্ত সে পেশার গড় বেতন পরিশোধ করা হয়। পৃথিবীর যে দেশে লিবিয়ার নাগরিক অধ্যয়ন করুক না কেন, সরকার তার আবাসন ব্যবস্থা করে থাকে, অধিকন্তু প্রত্যেককে প্রতিমাসে ২,৫০০ ইউরো প্রদান করা হয়। যাতে বিদেশে সচ্ছলতার সঙ্গে অধ্যয়ন অব্যাহত রাখতে পারে। লিবিয়ায় উৎপাদন খরচে গাড়ি বিক্রয় করা হয়।
অনেক মনে করেন, গাদ্দাফি আমেরিকার স্বার্থের বদলে নিজ দেশের ও দেশের মানুষের স্বার্থকে সবচেয়ে প্রাধান্য দিতেন এবং জ্বালানি তেলের মূল্য ডলার বা ইউরো বা মুদ্রার পরিবর্তে স্বর্ণে পরিশোধ করার দাবি তুলেছিলেন। তাই তাকে রাজনীতিক কৌশলের আশ্রয়ে হত্যা করা হয়েছে।
লিংকসমূহ:
কেনিয়া (Kenya) : ইতিহাস ও নামকরণ
লেসোথো (Lesotho): ইতিহাস ও নামকরণ
লাইবেরিয়া (Liberia) : ইতিহাস ও নামকরণ
সূত্র: কীভাবে হলো দেশের নাম, ড. মোহাম্মদ আমীন, পুথিনিলয়, বাংলাবাজার, ঢাকা।