লেবানন (Lebanon) : ইতিহাস ও নামকরণ

কীভাবে হলো দেশের নাম (এশিয়া)

ড. মোহাম্মদ আমীন

লেবানন (Lebanon)

সেমিটিক উৎস এলবিএন ইংরেজি LBN হতে আরবি শব্দ লুবানান (Lubnan ) নামের উদ্ভব। এর আঞ্চলিক উচ্চারণ লেবনেন (Lebnan)। বিভিন্ন ভাষা বিশ্লেষণ করে গবেষকগণ দেখিয়েছেন, শব্দটির কয়েকটি অর্থ রয়েছে। যেমন : সাদা ও দুগ্ধ। সাদা ও দুগ্ধ উভয় শব্দের সঙ্গে তুষারবৃত পর্বত মাউন্ট লেবাননের ঘনিষ্ট সম্পর্ক রয়েছে। তুষারকে দূর হতে দুগ্ধের মতো সাদা দেখায়। এজন্য বলা দুগ্ধসাদা বরফ। দুগ্ধসাদা কিংবা শুধুই সাদা তুষারবৃত লেবানন মাউন্টকে বলা হয় ঈশ্বরের হৃদয়। খ্রিস্টপূর্ব ২৯০০ অব্দে লিখিত গিলগামেশ (Gilgamesh) মহাকাব্য, খ্রিস্টপূর্ব ২৪০০ অব্দে লিখিত ইবলা (Ebla) গ্রন্থ এবং বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টে লুবানন পর্বতের কথা অত্যন্ত গুরুত্ব সহকালে উল্লেখ রয়েছে। নামের অর্থ বিশ্লেষণে বিশেষজ্ঞগণ এ অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, লেবানন ভূখ-টি দুধের মতো শুভ্র বা দুধের মতো সাদা পর্বতের কোলঘেষে গড়ে উঠেছে। তাই এর নাম লেবানন বা দুধের মতো সাদা। যার অন্তর্নিহিত অর্থ ঈশ্বরের হৃদয়।

লেবাননের আয়তন ১০,৪৫২ বর্গ কিলোমিটার বা ৪,০৩৬ বর্গমাইল। তন্মধ্যে জলীয় অংশের পরিমাণ ১.৮%। ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের হিসাবমতে লেবাননের মোট জনসংখ্যা ৫৮,৫১,০০০ এবং প্রতি বর্গকিলোমিটারে জনসংখ্যা ৫৬০। আয়তন বিবেচনায় লেবানন পৃথিবীর ১৬৬-তম বৃহত্তম দেশ কিন্তু জনসংখ্যা অনুসারে ১১২-তম বৃহত্তম দেশ। অন্যদিকে জনসংখ্যার ঘনত্ব লেবানন পৃথিবীর ২১-তম জনবহুল দেশ। লেবাননের ৪০% লোক খ্রিষ্টান। আরব দেশসমূহে এটাই খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী নাগরিকের সর্বোচ্চ হার। ছোট আয়তনের এ দেশটিতে ১৮টি ধর্মীয়গোষ্ঠী আছে। লেবাননের ৭০ ভাগ শিক্ষার্থী বেসরকারি স্কুলে অধ্যয়ন করে। লেবাননকে বলা হয় ডাক্তারের দেশ। এ দেশে প্রতি দশজন লোকের জন্য একজন ডাক্তার। অথচ ইউরোপ ও আমেরিকায় ১০০ জনের জন্য একজন ডাক্তার।

২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের হিসাব অনুযায়ী লেবাননের জিডিপি (পিপিপি) ৮১.১২২ বিলিয়ন উইএস ডলার(৮৮-তম) এবং সে হিসাবে মাথাপিছু আয় ১৭,৯৮৬ ইউএস ডলার (৮০-তম)। অন্যদিকে, জিডিপি নমিনাল ৪৯.৯১৯ বিলিয়ন ইউএস ডলার (৮৬-তম) এবং সে হিসাবে মাথাপিছু আয় ১১,০৮৬ ইউএস ডলার (৭১-তম)। লেবাননের মুদ্রার নাম লেবানিজ পাউন্ড এবং রাজধানী বৈরুত। ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দের ২২ নভেম্বর লেবানন স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং ১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ অক্টোবর যৌথ জাতিসংঘ ও ফ্রেঞ্চ ম্যান্ডেট হতে স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দের ৭ ডিসেম্বর লেবাননের জাতীয় পতাকা আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়। পতাকার মাঝখানে রয়েছে সিদার গাছের প্রতিকৃতি। এটি লেবাননের পর্বত সিদ্রাস লিবানির (ঈবফৎঁং ষরনধহর) প্রতীক। এ পাহাড় তাদের পবিত্র, চিরন্তনতা ও শান্তির প্রতীক।

লেবানন রয়েছে ভিন্ন প্রকৃতির একটি সংসদীয় গণতন্ত্র, যেখানে সরকারের সর্বোচ্চ পদগুলো আনুপাতিক হারে কিছু নির্দিষ্ট ধর্মীয় গোষ্ঠীর লোকদের প্রতিনিধির জন্য নির্ধারিত। সংবিধান অনুসারে প্রতি ৪ বছর অন্তর সংসদীয় নির্বাচন হয়। আইনসভা আবার ৬ বছর মেয়াদের জন্য রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করে। রাষ্ট্রপতি ও আইনসভা একত্রে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করেন।

লেবানন ধর্ম ও গোষ্ঠীগতভাবে বিভক্ত একটি উদ্ভট রাষ্ট্র। এখানে খ্রিষ্টান, সুন্নি মুসলমান ও শিয়া মুসলমানেরা একত্রে বাস করেন, তবে পরস্পরের অবিশ্বাস প্রবল। গোষ্ঠীগুলো লেবাননের ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে নিজেদের মধ্যে রাজনীতিক ক্ষমতার ব্যাপারে চুক্তি করেছে। চুক্তি অনুযায়ী লেবাননের রাষ্ট্রপতি হবে একজন ম্যারোনীয় খ্রিস্টান, প্রধানমন্ত্রী হবে সুন্নি মুসলমান এবং স্পিকার হবেন শিয়া মুসলমান। সংসদের আসনসমূহের অর্ধেক খ্রিস্টান ও অর্ধেক মুসলমানদের জন্য সংরক্ষিত। লেবাননের বেশির ভাগ রাজনীতিক দল গোষ্ঠী বা গোত্রভিত্তিক। লিবানজরা পৃথিবীর একমাত্র ত্রিভাষিক জাতি। সিংহভাগ লেবানিজ আরবি, ফ্রেঞ্চ ও ইংরেজি ভাষায় কথা বলতে পারে।
আরবি ভাষা লেবাননের সরকারী ভাষা। দেশটির ৯০%-এরও বেশি লোক আরবি ভাষায় কথা বলে। এছাড়াও এখানে আর্মেনীয়, কুর্দি ও আরামীয় ভাষা প্রচলিত। আন্তর্জাতিক যোগাযোগের জন্য ফরাসি ভাষা ব্যবহার করা হয়।

ওল্ড টেস্টামেন্টে ৭৫ বার লেবাননের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। অধিকন্তু সিডর (CEDAR) নামটিও (Lebanon’s tree) ওল্ড টেস্টামেন্টে ৭৫ বার উল্লেখ করা হয়েছে। কথিত হয়, সিডারস নামের এ দারুবৃক্ষটি ঈশ্বর নিজ হাতে রোপন করেছেন। এজন্য সিডারসকে ঈশ্বরের দারুবৃক্ষ বলা হয় এবং একই কারণে লেবাননকে পৃথিবীতে ঈশ্বরের দেশ (God’s Country on Earth) বলা হয়। বাদশা সোলোমানের প্রসাদ লেবানিজ সিডরস, মার্বেল ও টিম্বার দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছিল।এটি পৃথিবীর একমাত্র শহর যার নাম বিগত ৪ হাজার বছর যাবত অভিন্ন রয়ে গেছে। লেবানন হচ্ছে একমাত্র আরব ও এশিয়ান দেশ প্রকৃতপক্ষে যেখানে কোনো মরুভূমি নেই। লেবাননে ১৫টি নদী আছে, অথচ সৌদি আরবে একটি নদীও নেই। এ নদীগুলোর উৎপত্তি লেবাননের নিজস্ব পর্বত থেকে। প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন বিবেচনায় লেবানন পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় দেশ। বাইবলস লেবাননের একটি প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী শহর। লেবানন শহর বা বাইবলস পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীনত নিরবচ্ছিন্ন শহর। বাইবলস (Byblos) বা সিটি ইন লেবাননে প্রথম বর্ণমালা সৃষ্টি হয়। বাইবলস নামটি এসেছে বাইবেল থেকে। লেবানন পৃথিবীর একমাত্র দেশ, যে দেশ সম্পর্কে এ পর্যন্ত সর্বাধিক বই রচিত হয়েছে। জনপ্রিয় ধর্মগ্রন্থসমূহে যতবার লেবাননের নাম রয়েছে তা আর কোনো দেশের নেই। খ্রিষ্টান ধর্ম অনুসারে যিশুখ্রিস্ট তার প্রথম অলৌকিক কর্ম সম্পাদন করেন লেবাননের সিডনে। এখানেই তিনি অলৌকিক ক্ষমতাবলে জলকে মদে পরিণত করেছিলেন। জুপিটারের একমাত্র অক্ষত মন্দিরটি লেবাননের বালবেক (সিটি অব সান) নামক স্থানে অবস্থিত।

বৈরুত এ পর্যন্ত সাত বার ধ্বংস হয়েছে এবং সাত বারই পুননির্মাণ করা হয়েছে। এজন্য এটাকে ফোনেক্স (Phoenix) এর সঙ্গে তুলনা করা যায়। আশ্চর্য শোনালেও সত্য যে, ৪.৫ মিলিয়ন লেবানিজ লেবাননে বসবাস করে এবং ১০ মিলিয়ন লেবানিজ বাস করে লেবাননের বাইরে। লেবাননের স্কাই বার ভোটে পৃথিবীর এক নম্বর নাইট ক্লাব হিসাবে নির্বাচিত হয়েছে। শপিং এর জন্য বৈরুত হচ্ছে পৃথিবীর দশম জনপ্রিয় শহর। ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে বৈরুতকে বিশ্ব ব্যাংকের রাজধানী হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়। লেবানন এমন একটি দেশ, যা ইতোমধ্যে ১৬টি দেশ দ্বারা অধিকৃত হয়েছে।

লেবাননের প্রকৃত অধিবাসীকে ফেনিচনস (Phoenicians)  বলা হয়। এরাই প্রথম নৌকা তৈরি করে এবং তাদের তৈরি নৌকাই পাল তুলে প্রথম সমুদ্র যাত্রা করে। তারা ক্রিস্টোফার কলম্বাসের বহু পূর্বে আমেরিকা পৌঁছেছিল।

বৈরুতের ডাউন টাউনে বিশ্বের প্রথম আইনস্কুল প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। লেবাননের আয়তন আরব উপদ্বীপের মাত্র এক চল্লিশাংশ হলেও আরব বিশ্বের ৭০% গ্রন্থ লেবানন থেকে প্রকাশিত হয়। আরব দেশগুলোর মধ্যে লেবাননেই প্রথম সংবিধান প্রণীত হয়। আরব বিশ্ব সামান্য পরিমাণ যে সভ্যতা পেয়েছে, তার জন্য তারা বহুলাংশে লেবাননের কাছে ঋণী। টম এন্ড জেরির প্রতিষ্ঠাতা জোসেফ বারবারা ও উইলিয়াম হান্না লেবানিজ। আইপডের প্রতিষ্ঠাতা ও উৎপাদন ব্যবস্থাপক টনি প্যাডেল (Tony Fadel প্রকৃতপক্ষে লেবাননের অধিবাসী ছিলেন। Ask not what your country can do for you, ask what you can do for your country  সর্বজন খ্যাত এ বাণীটি লেবানিজ লেখক ও আর্টিস্ট খলিল জিবরানের গ্রন্থ হতে নেওয়া।


জাপান (Japan) : ইতিহাস ও নামকরণ

জর্ডান (Jordan) : ইতিহাস ও নামকরণ

কাজাখস্তান (Kazakhstan) : ইতিহাস ও নামকরণ

কুয়েত (Kuwait): ইতিহাস ও নামকরণ

লাও (Laos) : ইতিহাস ও নামকরণ

লেবানন (Lebanon) : ইতিহাস ও নামকরণ

সূত্র:  কীভাবে হলো দেশের নাম, ড. মোহাম্মদ আমীন, পুথিনিলয়, বাংলাবাজার, ঢাকা।

Language
error: Content is protected !!