শব্দভাণ্ডারের প্রয়োজনীয়তা
এবি ছিদ্দিক
সম্প্রতি ইংরেজি ‘পোস্ট/স্ট্যাটাস’ শব্দের পারিভাষিক শব্দ হিসেবে ‘যযাতি’ শব্দটি ব্যবহারের যথার্থতা নিয়ে শ্রদ্ধেয় স্যার, ড. মোহাম্মদ আমীনের ব্যুৎপত্তিগত বিশ্লেষণ-সহ একটি যযাতি প্রকাশের পর অনেকেই তাঁদের লেখায় ‘যযাতি’ শব্দটি প্রয়োগ করছেন। আবার, অনেকেই দৈনন্দিনের লেখায় এই ‘যযাতি’ শব্দটি প্রয়োগের ঘোর বিরোধী। তাঁদের ভাষ্য মোটামুটি নিম্নরূপ:
“যেখানে ‘পোস্ট’ শব্দটি প্রচলিত হয়েই গিয়েছে,
সেখানে এমন অপ্রচলিত শব্দ ব্যবহারের
যৌক্তিকতা আছে কি? ‘কোবিদ স্বপন দাদা, আপনার যযাতিটি চমৎকার হয়েছে’ কথাটি শুনে শ্রীমান স্বপন দাদা যে অতিশয় ক্ষুব্ধ হবেন না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
কেননা, ‘কোবিদ’ প্রশংসা, না কি গালি এবং ‘যযাতি’ জিনিসটা ঠিক কী, তা ৯৯.৯% মানুষই বুঝতে অক্ষম।”
সাধারণ দৃষ্টির নিরিখে তাঁরা যথার্থ কথাই বলেছেন। আসলে বাংলা ভাষায় এমন অনেক শব্দ ব্যবহৃত হয়, যেগুলোর অর্থ সাধারণের না-জানার সম্ভাবনাটাই বেশি। উদাহরণস্বরূপ ‘পামর’ শব্দটি উল্লেখ করা যায়। যদি কেউ বলেন যে, ‘আবুল কালাম অত্যন্ত পামর ব্যক্তি’, তাহলে যাঁদের বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডার মোটামুটি ভালো, তাঁদের পক্ষেও ‘পামর’ শব্দটির অর্থ অনুধাবন করা কষ্টকর হবে। খুব কম সংখ্যক লোক রয়েছেন, যাঁরা জানেন যে, ‘পামর’ হচ্ছে ‘নীচ’-এর একটি সমার্থক শব্দ। আর তাই, যেখানে ‘জ্ঞানী’ বা ‘পণ্ডিত’, ‘পোস্ট’ কিংবা ‘স্ট্যাটাস’, ‘নীচ’ অথবা ‘হীন’ প্রভৃতি শব্দের ব্যবহারে আরামসে কাজ সারা যাচ্ছে, সেখানে শুধুশুধু ‘কোবিদ’ বা ‘যযাতি’ কিংবা ‘পামর’-এর মতো অপরিচিত-দুর্বোধ্য শব্দ ব্যবহারের কী এমন দরকার?
দরকার অবশ্যই আছে।
আসলে সময়ের পরিক্রমায় সবকিছুরই পরিবর্তন ঘটে; ভাষার ক্ষেত্রে সেই পরিবর্তনের ছোঁয়া একটু বেশিই লাগে। যে ভাষা আপন গতিতে চলার সময় কোনো শব্দ মনঃপূত হলে ইউঁহি নিজের করে নিতে পারে এবং প্রয়োজনে গ্রহণ করা শব্দটি নিজের পুঁজির সঙ্গে মিশিয়ে নবরূপে তুলে ধরতে পারে, সে ভাষার আবেদন যে অন্য যে-কোনো ভাষার আবেদনকে ছাড়িয়ে যায়, তা বলাই বাহুল্য। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, কোনো ভাষায় যত বেশি বৈচিত্রময় শব্দ ব্যবহার করা হয়, ওই ভাষা তত বেশি সমৃদ্ধ হয়; বিশেষ করে ওই ভাষার সাহিত্য। অর্থাৎ, যে ভাষার শব্দভাণ্ডার যত সমৃদ্ধ, বিশ্বসাহিত্যের বিস্তৃত আঙিনায় সে ভাষা তত বেশি বিস্তার লাভ করতে পারে। বলা হয় যে, স্যার উইলিয়াম শেকসপিয়রদের সময়কার ইংরেজি সাহিত্যের তুলনায় আধুনিক ইংরেজি সাহিত্য অত্যন্ত দীন। বিশ্লেষকগণ এর অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন আধুনিক লেখকগণের বিচিত্র শব্দ চয়নের প্রতি অনীহা। যেখানে বেকন-শেকসপিয়র-অস্টিনদের এক একটি প্রবন্ধ, সনেট কিংবা ছোটোগল্প পড়ার জন্য শত বার অভিধান খুলতে হয়, সেখানে বলতে গেলে কোনো অভিধান ছাড়াই বর্তমান লেখকের অনেক বড়ো বড়ো ইংরেজি উপন্যাস পড়া ও অর্থ অনুধান করা যাচ্ছে। বাংলা সাহিত্যের বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য। যেখানে মধুসূদন-বঙ্কিমদের লেখা একটি বাক্যের পাঠোদ্ধার করতে পাঠকের ঘাম ছুটে যায়, সেখানে বিনা ক্লেশে বর্তমান লেখকগণের অনেক বড়ো বড়ো উপন্যাসের অর্থ অনুধাবন করা যাচ্ছে। ফলস্বরূপ পাঠকের পরিশ্রমের লাঘব ঘটলেও ভাষা তার গভীরতা হারিয়ে ফেলছে, যা মোটেও কাম্য নয়। তাই মাঝেমধ্যে অপরিচিত শব্দ ব্যবহার করার প্রয়োজনীয়তা খুব বেশি না-থাকলেও একেবারে এড়িয়া যাওয়া মতোও নয়। কেননা, এই অপরিচিত শব্দগুলোর অর্থ খুঁজতে গিয়ে শব্দগুলোর অর্থ শেখার পাশাপাশি ওই শব্দগুলোর ব্যুৎপত্তি, বিকাশ, ব্যবহার, উচ্চারণ প্রভৃতিও শেখা হয়ে যায়; জানা যায় অনেক অজানা ও মজার বিষয়। তাছাড়া অপরিচিত শব্দগুলোর অর্থ অভিধান ঘেঁটে বের করার চেষ্টা করলে আরও অনেক বিচিত্র শব্দ চোখে পড়ে, যা ওই ব্যক্তিকে নতুন শব্দ শেখার প্রতি আরও কৌতূহলী করে তোলে। এছাড়া ক্ষেত্রভেদে প্রাসঙ্গিক বিচিত্র শব্দ চয়ন করতে পারাটা একপ্রকার দক্ষতাও বটে। যেখানে দশজনে ‘বন্ধুত্ব’ শব্দটি ব্যবহার করবে, সেখানে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যানুরাগী হিসেবে আপনিও ‘বন্ধুত্ব’ শব্দটি ব্যবহার করলে, আপনার আর অন্য দশজনের মধ্যে পার্থক্য কোথায়?
যে কথাটি বলতে চাইছি, ক্ষেত্রভেদে শব্দের অভিনব প্রয়োগ করতে পারাতেই লেখকের দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায়। যেখানে সাধারণে ‘সব সময়’ ব্যবহার করবেন, সেখানে সাহিত্যের শিষ্য ‘অনিশ’, ‘সতত’-এর মতো শব্দগুলো ব্যবহার করতে চাইবেন। যেখানে সাধারণ লেখক ‘মসৃণ’ পথের বর্ণনা দেবেন, সেখানে ভাষাজ্ঞানে ঋদ্ধ লেখকের লেখায় ‘চৌরস’ রাস্তার চিত্র অঙ্কিত হবে। যেখানে হালের কবি ‘যুদ্ধ’ লিখেই কাজ চালিয়ে নেবেন, সেখানে ক্লাসিকের পূরাজি ‘আহব’ ব্যবহার করতে দুই বার ভাববেন না। সাধারণ প্রেমিকের লেখায় নারীর রূপ বর্ণিত হয়, কিন্তু ঋদ্ধ প্রেমিকের বর্ণনায় ‘নারী’ হয়ে যায় ‘বামা’। যেখানে দশজনে (বিচ্ছিন্নভাবে হবে না) বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেবেন, সেখানে শব্দের খেলোয়াড় বাড়াবেন বন্ধুতার হাত। যা সাধারণের দৃষ্টিতে ‘শুদ্ধ নয়’, তা বৈয়াকরণের দৃষ্টিতে ‘সমীচীন নয়’। যেখানে সাধারণ লেখক ‘ণ’ লিখেই সামনে এগিয়ে যাবেন, সেখানে ভাষাবিজ্ঞানের যাত্রী ‘মূর্ধন্য-ণ’ লিখে আগাতে চাইবেন। অন্যরা সূর্য লিখে তুষ্ট হয়ে যাবেন, তাই বলে সাহিত্যের শিক্ষার্থী তো আর ‘পূষন’ লেখা থেকে বিরত থাকবেন না। গণিত-রসায়ন-ইতিহাস-ফিন্যান্স-মার্কেটিং-অর্থনীতির শিক্ষার্থী হিসেবে অন্যরা পোস্ট কিংবা স্ট্যাটাস দিয়ে দাপিয়ে বেড়াতে পারেন, কিন্তু ভাষাবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে ‘যযাতি’ প্রকাশ না-করলে আমার চলে না। সাধারণ ছাত্র ‘ভালোবাসা’-র কথা ব্যক্ত করেই সন্তুষ্ট হতে পারেন, কিন্তু সাহিত্যের ছাত্রের কি আর ‘অনুরাগ’ ছাড়া চলে? আনন্দিত তো বাচ্চারাও হয়, কিন্তু পুলকিত কজনেই বা হন? একই বিষয়ের ওপর দশ জন প্রতিযোগী প্রবন্ধ লেখেন, কিন্তু কেবল এক জনই প্রথম হন। কেন? নিশ্চয়ই তাঁর শব্দচয়ন এবং চয়িত শব্দের যথাযথ প্রয়োগই তাঁকে অনন্য হিসেবে প্রমাণ করে। শব্দ নিয়ে খেলতে পারাটাই যদি দক্ষতার পরিচায়ক হয়, তাহলে নিজের লেখা, নিজের ভাষা এবং নিজের ভাষার শব্দভাণ্ডার সমৃদ্ধ করতে ‘যযাতি’-র মতো সময়োপযোগী শব্দের ব্যবহারে এত আপত্তি কেন? আপনি নিশ্চয়ই ‘রচনার শিল্পগুণ’-এর কথা বলবেন। আরে! আপনি শিল্পগুণের অজুহাত দিয়ে যেসকল শব্দের প্রয়োগ থেকে বিরত থাকছেন, সেসকল শব্দে ভরপুর সাহিত্যকর্মগুলোর পাঠই প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনায় আবশ্যক!
তারপরও যদি ‘যযাতি’-র প্রতি আপনার বিদ্বেষ না-কমে, তাহলে নিচের প্রশ্নগুলোর জবাব দিয়ে যাবেন:
আমার পূর্বপুরুষ স্মার্টফোন ব্যবহার করেননি, তাই বলে কি আমিও স্মার্টফোন ব্যবহার করব না? আমাদের পূর্বপুরুষ ফেসবুক ব্যবহার করেননি, তাই বলে আমরাও কি ফেসবুক ব্যবহার করব না? ওয়ানডে ক্রিকেটে শচীন টেন্ডুলকারের আগে কেউ দ্বিশতক করেননি, তা বলে কি খেলোয়াড়েরা দ্বিশতক করা থেকে বিরত থেকেছেন? আমাদের পূর্বপুরুষ আদুল গায়ে চলতেন, তাই বলে কি আমরা কাপড় পরছি না? আমার পূর্বসূরি ‘কর্ণ’ ব্যবহার করেছেন, তাহলে আমি কি ‘কান’ ব্যবহার করতে পারব না? আমার পূর্বসূরি ‘স্বাগতম্’ জানাতে স্বচ্ছন্দবোধ করতেন, তাই বলে আমি কি ‘স্বাগত’ জানাতে পারব না? আমার বন্ধুমহল ভার্সিটিতে যেতে পছন্দ করেন, তাই বলে আমি কি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করতে পারব না? তাহিয়ানরা রোজ কলেজে যায়, তাই বলে ইশমাম কি মহাবিদ্যালয়ে যেতে পারবে না? গ্যালিলিওর পূর্বে সকলে পৃথিবীকে সৌরজগতের কেন্দ্র বলতেন, তাই বলে কি আমরাও পৃথিবীকে সৌরজগতের কেন্দ্র বলি? আগে ভর, দৈর্ঘ্য ও সময়কে অপরিবর্তনীয় বিবেচনা করা হতো। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার সূত্রের পরও কি আমরা পূর্বের ধারণা আঁকড়ে রেখেছি?
যদি আপনাদের রায় দ্বিতীয় রূপগুলোর পক্ষে থাকে, তাহলে ‘যযাতি’-র বেলায় কেন ‘না’ করছেন? নতুন মতবাদের জন্য বিশ্ব, আইনস্টাইনকে নোবেলে ভূষিত করল। আর, আমরা কিনা …
পরিশেষে যে কথাটি বলতে চাইছি, সকলে দিনে অন্তত দু-তিনটি করে বিচিত্র কিংবা অপরিচিত শব্দ শেখার এবং শব্দগুলো নিজেদের লেখায় প্রয়োগের চেষ্টা করি। যদি আপনার শিখতে ইচ্ছে না-হয়, তাহলে কেউ উদ্যমী হলে তাঁকে খোশ আমদেদ না-ই জানান, অন্তত তাঁর প্রয়াসের বামহাত খোঁজা থেকে বিরত থাকুন। কেননা, আমি শিখতে চাই, আমার মতো নবীন পাঠকেরা শিখতে চায়। আমরা নিত্যনতুন শব্দ শিখে আমাদের শব্দভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করতে চাই, ভাষাকেও গভীর করতে চাই। সেসঙ্গে নিজেদের শেখা শব্দগুলো অন্যদেরও শেখাতে চাই।