সপ্তম অধ্যায়
ক্রিয়াপদের সূচনায় উ এবং ও
ক্রিয়া পদের শুরুতে কখন ‘উ’ আর কখন ‘ও’ হবে- এ প্রশ্নে উত্তর দিতে অনেকে সংশয়ে পড়ে যায়। এটি মনে রাখার একটি নিমোনিক আলোচনা করা যেতে পারে।
সাধারণত বাক্যে অসমাপিকা ক্রিয়ার শুরুতে ‘উ’ (সংবৃত); এবং সমাপিকা ক্রিয়ার ক্ষেত্রে ‘ও’ (বিবৃত) হয়ে থাকে। যেমন :
আকাশে পাখি ওড়ে।
পাখিটা উড়ে গেল।
এখানে প্রথম বাক্যে ‘ওড়ে’ সমাপিকা ক্রিয়া, তাই ‘উড়ে’ বানানের প্রথম অক্ষর ‘ও’ হয়েছে। দ্বিতীয় বাক্যে ‘উড়ে’ অসমাপিকা ক্রিয়া, তাই ‘উ’ হয়েছে।
বিষয়টি কীভাবে মনে রাখা যায়?
‘অসমাপিকা’ এবং ‘সমাপিকা’ শব্দদুটির প্রথম বর্ণ যথাক্রমে ‘অ’ এবং ‘স’। অ-বর্ণটি স-বর্ণের আগে। এবার ‘উড়ে’ এবং ‘ওড়ে’ বানান দুটি দেখা যাক। বাংলা বর্ণমালা সজ্জায় ‘উ’ বর্ণটি ‘ও’ বর্ণের আগে। মনে রাখুন, অসমাপিকা ক্রিয়ার বানানের প্রথম অক্ষর অ বলে ওইরূপ বাক্যের সঙ্গে উ বসে।
যেমনটি পাখিটি উড়ে গেল।
অন্যদিকে, সমাপিকা ক্রিয়ার প্রথম বর্ণ দন্ত্য-স। এটি অ-বর্ণের পরে। তাই সমাপিকা বাক্যের ক্রিয়ার সঙ্গে ‘ও’ বর্ণ হয়। যেমন : পাখি ওড়ে।
ব্যাখ্যা : ‘উ’ ও ‘ও’ এর একটি প্রসঙ্গ : উঠে/ওঠে? উপরে/ওপরে, উঠা/ওঠা, বুঝে/বোঝে, শুনে/শোনে, ফুটে/ ফোটে; কোনটি হবে?
সাধারণ সূত্র হচ্ছে, বাংলায় সমাপিকা ক্রিয়ার ক্ষেত্রে ক্রিয়াপদের আদ্যস্বরের উচ্চারণ বিবৃত হবে। অসমাপিকা ক্রিয়ায় ক্ষেত্রে হবে সংবৃত। যেমন (ক) ছেলেটি টিভি দেখে। এ বাক্যে ‘দেখে’ সমাপিকা ক্রিয়া। অর্থাৎ ‘দেখে’ পদটি দিয়ে বাক্যের অর্থ সম্পূর্ণ হয়েছে। (খ) ছেলেটি টিভি দেখে ঘুমাবে। এ বাক্যে ‘ঘুমাবে’ সমাপিকা ক্রিয়া; ‘দেখে’ অসমাপিকা ক্রিয়া। কারণ, ‘ঘুমাবে’ পদটি দিয়ে অর্থ সম্পূর্ণ হয়েছে। (গ) ছেলেটি টিভি দেখে খাবার খেয়ে বই পড়ে ঘুমাবে। এ বাক্যে ক্রিয়াপদ ৪টি ‘দেখে’, ‘খেয়ে’, ‘পড়ে’, ‘ঘুমাবে’। কিন্তু সমাপিকা ক্রিয়া একটিই ‘ঘুমাবে’। অর্থাৎ ‘ঘুমাবে’ না বলা পর্যন্ত বাক্য সম্পূর্ণ হচ্ছিল না। বাকি ৩টি ক্রিয়াপদ অসমাপিকা ক্রিয়া।
প্রথম বাক্যে ‘দেখে’ যেহেতু সমাপিকা ক্রিয়া, তাই এর আদ্যস্বরের উচ্চারণ হবে বিবৃত। যেমন [দ্যাখে]। কিন্তু, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বাক্যে ‘দেখে’ যেহেতু অসমাপিকা ক্রিয়া, তাই এর আদ্যস্বরের উচ্চারণ হবে সংবৃত। যেমন [দেখে]।
অষ্টম অধ্যায়
ভুল সংশোধন
বিশেষ্যের দ্বিত্বজনিত ভুল
মূল শব্দ বিশেষ্য হলে তাতে পুনরায় বিশেষ্যবাচক প্রত্যয় যোগ করা ব্যাকরণসম্মত নয়। তবু অনেকে অজ্ঞতাবশত কিংবা প্রচলিত রীতি অনুসরণে শব্দের সঙ্গে পুনরায় বিশেষ্যবাচক ‘-তা/-ত্ব’ প্রত্যয় যুক্ত করে বিশেষ্যের দ্বিত্বজনিত ভুল করেন। ফলে শুদ্ধ শব্দটি অযথা ভুল হয়ে বাক্যে বসে যায়। যেমন: অপকর্ষতা, অপ্রতুলতা, আব্রুতা, মৌনতা, প্রসারতা, বাহুল্যতা ইত্যাদি অশুদ্ধ শব্দ। এ শব্দগুলোর শুদ্ধরূপ যথাক্রমে অপকর্ষ, অপ্রতুল, আব্রু, মৌন, প্রসার, বাহুল্য ইত্যাদি।
‘অন্তঃস্থ-য’-যোগে গঠিত বিশেষ্যপদের সঙ্গে বিশেষ্যবাচক ‘-তা/-ত্ব’ প্রত্যয় যুক্ত করা ব্যাকরণসম্মত নয়। কিন্তু অনেকে কিছু কিছু শব্দে অকারণে ‘তা/-ত্ব’ প্রত্যয় যুক্ত করে বিশেষ্য পদের দ্বিত্বজনিত ভুল করে বসেন। এরূপ কিছু শব্দের তালিকা নিচের শুদ্ধরূপটিসহ দেওয়া হলো। উল্লেখ্য প্রথমে অশুদ্ধ শব্দটি দেওয়া হয়েছে। তারপর দেওয়া হয়েছে শুদ্ধ শব্দটি। যেমন :
অধৈর্যতা>অধৈর্য, ঐক্যতা>ঐক্য, মাধুর্যতা>মাধুর্য, দৈন্যতা>দৈন্য/দীনতা, সৌজন্যতা>সৌজন্য, ধৈর্যতা>ধৈর্য, দারিদ্রতা>দারিদ্র্য, কার্পণ্যতা>কার্পণ্য, সখ্যতা>সখ্য, সৌহৃদ্যতা>সৌহৃদ্য, মৈত্রতা>মৈত্র/মিত্রতা, কার্পণ্যতা>কার্পণ্য প্রভৃতি।
কেউ কেউ ‘য-ফলা’-যোগে গঠিত বিশেষ্য পদের অন্ত্য-বর্ণে অবস্থিত ‘য-প্রত্যয়-জ্ঞাপক’ য-ফলা বর্জন করে থাকেন। দারিদ্র্য, বৈচিত্র্য, বৈশিষ্ট্য শব্দগুলোকে যথাক্রমে দারিদ্র, বৈচিত্র’ প্রভৃতি লিখতে দেখা যায়। এটি ব্যাকরণসম্মত নয়, বিধায় অনুচিত।
বিশেষণের দ্বিত্বজনিত ভুল
বিশেষণ পদের সঙ্গে পুনরায় বিশেষণবাচক প্রত্যয় বা উপসর্গ যোগ করা ব্যাকরণসম্মত নয়। এমনটি অশোভনীয়। অনেকে বিশেষণ পদের সঙ্গে পুনরায় বিশেষণবাচক উপসর্গ বা প্রত্যয় যোগ করে শব্দে বিশেষণের দ্বিতজনিত ভুল করে বসেন। বিশেষণের দ্বিত্ব ব্যাকরণসম্মত নয়, এ বিষয়টা জানা থাকলে বিশেষণের দ্বিত্বজনিত ভুল হওয়ার কথা নয়।
কাতর, চিত্রিত, সানন্দ, বিনয়পূর্বক/ সবিনয়ে শব্দগুলোকে অনেকে যথাক্রমে সকাতর, সচিত্রিত, সানন্দিত, সবিনয়পূর্বক লিখে বিশেষণের দ্বিত্ব-প্রয়োগজনিত ভুল করে থাকেন।
বহুবচনের দ্বিত্বজনিত ভুল
বাক্যে একটি বিশেষ্য/সর্বনাম পদের জন্য একই পরিমণ্ডলে একবার বহুবচন প্রয়োগই যেখানে যথেষ্ট সেখানে অনেকে অহেতুক একাধিক বহুবচন প্রয়োগ করে থাকেন। বহুবচনের দ্বিত্ব বাক্যকে ভৌতিক করে তুলে। ‘উপস্থিত ছাত্ররা সবাই দাঁড়িয়ে গেল’- এ বাক্যটিতে ‘ছাত্ররা’ এবং ‘সবাই’ দুটো বহুবচন-বাচক পদের ব্যবহার আদৌ কাম্য নয়। উপস্থিত ছাত্ররা দাঁড়িয়ে গেল অথবা উপস্থিত সব ছাত্র দাঁড়িয়ে গেল’ লেখাই যথেষ্ট। বহুবচনের দ্বিত্ব বাক্যকে হাস্যকর করে তুলে। বিষয়টি সর্বদা মনে রাখা উচিত। রবীন্দ্রনাথের লেখাতেও এমন ভুল দেখা যায়। যেমন : আমরা সবাই রাজা আমাদের এ রাজার রাজত্বে।
সমার্থ শব্দের বাহুল্যজনিত ভুল
যেখানে একটি শব্দ যথেষ্ট সেখানে অযথা একাধিক সমার্থক শব্দের প্রয়োগ অনুচিত। এটি বাক্য ও শব্দকে অর্থহীন, মেদবহুল ও ভারাক্রান্ত করে তোলে। অবশ্য অনেক খ্যাতিমান কবি-সাহিত্যিকদেরকেও সমার্থ শব্দের বাহুল্যজনিত ভুল করতে দেখা যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অনেক কবিতা ও গানে অশ্রুজল লিখেছেন। রবিঠাকুর লিখুন, আমরা লিখব না; যতক্ষণ পর্যন্ত তাঁর মত সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত হই। এরূপ কিছু শব্দের উদাহরণ শুদ্ধরূপসহ নিচে দেওয়া হল। উল্লেখ্য > চিহ্নের প্রথমে ভুল-শব্দটি এবং অন্তে শুদ্ধ শব্দটি লেখা হয়েছে।
অশ্রুজল>অশ্রু/জল, সর্বপ্রথম>প্রথম, কদাপিও>কদাপি, আরক্তিম>আরক্ত/রক্তিম, অদ্যাপিও>অদ্যাপি, কেবলমাত্র>কেবল/মাত্র, সময়কাল>সময়/কাল, সুস্বাস্থ্য>স্বাস্থ্য, বিবিধপ্রকার>বিবিধ, সুস্বাগত>স্বাগত, আয়ত্তাধীন> আয়ত্ত/অধীন, যদ্যাপিও>যদ্যাপি, কেবলমাত্র>কেবল/মাত্র, শুধুমাত্র>শুধু/মাত্র, সমূলসহ>সমূল/মূলসহ প্রভৃতি। এরূপ আরও অনেক শব্দে অনেকের বাহুলজনিত ভুলপ্রবণতা লক্ষ করা যায়।
উৎকর্ষবাচক প্রত্যয় ‘-তর, -তম’ প্রয়োগজনিত ভুল
সর্বাধিক -উৎকর্ষ, নিকৃষ্ট প্রভৃতি বুঝাতে গুণবাচক শব্দের সঙ্গে ‘-ইষ্ঠ’ প্রত্যয় যুক্ত করে ‘কনিষ্ঠ, লঘিষ্ঠ, পাপিষ্ঠ, বলিষ্ঠ, শ্রেষ্ঠ’ ইত্যাদি শব্দ গঠন করা হয়। এরূপ শব্দে ‘-তর’ কিংবা ‘-তম’ প্রত্যয় যুক্ত করে ‘কনিষ্ঠতর/কনিষ্ঠতম, লঘিষ্ঠতর/লঘিষ্ঠতম, পাপিষ্ঠতর/পাপিষ্ঠতম, বলিষ্ঠতর/বলিষ্ঠতম, শ্রেষ্ঠতর/শ্রেষ্ঠতম’ ইত্যাদি শব্দ গঠন করা ভুল। প্রমিত বানানে উৎকর্ষবাচক প্রত্যয়ের দ্বিত্ব-যোগ সর্বদা বর্জনীয়।
সমাসজনিত ভুল
পাপী, জ্ঞানী, গুণী, মানী, দামী ইত্যাদি শব্দ ইন্-ভাগান্ত শব্দের প্রথমার এক বচনের রূপ হিসেবে গঠিত বহুল প্রচলিত শব্দ। অতএব ‘নিঃ’ উপসর্গে সমাসবদ্ধ হলে শব্দের শেষে ‘ঈ-কার’ যুক্ত হওয়া ব্যাকরণসম্মত নয়। সংগত কারণে পাপী, জ্ঞানী, গুণী, মানী, দামী ইত্যাদি শব্দের সঙ্গে কোনও সমাস হতে পারে না। মূল শব্দ পাপ, জ্ঞান, গুণ, মান, দাম ইত্যাদি শব্দের সঙ্গে সমাস হতে পারে। যেমন : নেই পাপ= নি®পাপ, নেই জ্ঞান= নির্জ্ঞান, নেই গুণ= নির্গুণ ইত্যাদি। ব্যাকরণের এ নিয়ম অনুসারে নি®পাপী, নির্জ্ঞানী, নির্গুণী, নিরভিমানী, নির্দোষী, নীরোগী, নিরপারাধী, নির্বোরোধী, নির্ধণী ইত্যাদি শব্দ লেখা সমীচীন নয়।
যেমন: প্রতিযোগী কিন্তু প্রতিযোগিতা, সহযোগী কিন্তু সহযোগিতা, অপকারী কিন্তু অপকারিতা, উপকারী কিন্তু উপকারিতা, পারদর্শী কিন্তু পারদর্শিতা, প্রতিদ্বন্দ্বী কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বিতা, বিরোধী কিন্তু বিরোধিতা, সত্যবাদী কিন্তু সত্যবাদিতা, সহকারী কিন্তু সহকারিতা এবং একাকী কিন্তু একাকিত্ব, দায়ী কিন্তু দায়িত্ব, সখী কিন্তু সখিত্ব, স্থায়ী কিন্তু স্থায়িত্ব, মন্ত্রী কিন্তু মন্ত্রিত্ব, কৃতী কিন্তু কৃতিত্ব ইত্যাদি। অনেকে এ নিয়মটি জানেন না বলে বানানে ভুল করে থাকেন।
সন্ধিজনিত ভুল
সন্ধিজনিত ভুল বাংলা বানানের একটি ব্যাপক বিস্তৃত সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত। শুধু সন্ধিজনিত অজ্ঞতার কারণে এ ভুলগুলো হয়। সন্ধির নিয়মগুলো জানা থাকলে সহজে সন্ধিজনিত ভুলসমূহ পরিহার করা যায়। যেমন :
বিসর্গযুক্ত অ-কারের পর বর্গের প্রথম/ দ্বিতীয় বর্ণ কিংবা শিষ-বর্ণ (শ ষ স) থাকলে সন্ধির ফলে ‘অ-কার’ অপরিবর্তিত থাকে।
বিসর্গযুক্ত অ-কারের পর বর্গের তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম বর্ণ কিংবা অন্তঃস্থ বর্ণ (য র ল) কিংবা ‘হ’ থাকলে সন্ধির ফলে ‘অঃ’ স্থলে ‘ও’ হয়। যেমন: অধঃপাত, অধঃস্থ, ইতঃপূর্বে, বক্ষঃস্থল, বয়ঃক্রম, মনঃপূত, মনঃপ্রাণ, মনঃস্থ কিন্তু অধোগতি, অধোভাগ, ততোধিক, বয়োগুণ, মনোরম, মনোলোভা, মনোগত ইত্যাদি।
বিসর্গযুক্ত ‘ই-কার’ কিংবা ‘উ-কার’ এর পর ‘র’ থাকলে সন্ধির ফলে বিসর্গের পূর্বস্থ স্বরধ্বনি বৃদ্ধি পায় এবং ‘ই-কার’ ঈ-কারে এবং ‘উ-কার’ ‘ঊ-কারে পরিবর্তিত হয়। এ নিয়মটি জানা না থাকলে বানানে ই-কার/ ঊ-কার-এ পরিণত হয়। এ নিয়মটি জানা না-থাকলে বানানে ই-কার/উ-কার সংক্রান্ত ভুল হওয়া স্বাভাবিক। যেমন : নিঃ+রব= নীরব, চক্ষু+ রোগ= চক্ষূরোগ।
সন্ধির নিয়মানুসারে ‘য র ল ব শ ষ স’ এর পূর্বস্থ ‘ম’- এর স্থলে অনুস্বার হয়, কিন্তু অনেকে ‘ম্ব’ লিখে বসেন। এটি ভুল, কখনও এরূপ করা উচিত নয়। অবশ্য ‘ক খ গ ঘ’ পরে থাকলে ‘ঙ’ স্থানে বিকল্পে অনুস্বার হয়।
যেমন : সম্+কট= সংকট,
সম্+গীত= সংগীত।
‘ই-কার’ এর পর ‘অ-কার’ থাকলে সন্ধির ফলে উভয়ে যুক্ত হয়ে ‘য-ফলা’ হয়। অনেকে অজ্ঞতাবশত ‘য-ফলা আকার’ (্যা) বসিয়ে দেন। যেমন : অতি+ অন্ত = অত্যন্ত, অতি+ অল্প = অত্যল্প ইত্যাদি। তেমনি গত্যন্তর, যদ্যপি, প্রত্যর্পণ, ব্যত্যয়, ব্যক্ত, ব্যক্তি, ব্যবস্থা, ব্যস্ত, ব্যর্থ। ‘দুরাবস্থা’ শব্দের ‘আ-কার’ নিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাবুর বহুল প্রচলিত কৌতুকটি মনে রাখলে আ-কার সংক্রন্ত ভুল অনেক কমে যাবে।
য-ফলা : আবার ‘ই-কার’ এর পর ‘আ-কার’ থাকলে উভয়ে মিলে ‘য-ফলা-আকার’ হয়। যেমন: অতি+ আচার= অত্যাচার, অতি + আবশ্যক = অত্যাবশ্যক ইত্যাদি। তেমন অত্যাশ্চর্য, অত্যাসক্ত, ত্যাগ, ত্যাজ্য, প্রত্যাঘাত, প্রত্যাদেশ, প্রত্যাহার, সত্যাগ্রহ, ব্যাকরণ, ব্যাপ্ত, ব্যায়াম ইত্যাদি।
নবম অধ্যায়
কী লিখবেন এবং কী লিখবেন না
অত্র অর্থ (ক্রিবিণ) এখানে; এ স্থানে। (বিণ) এ স্থানের ;এখানকার;এই দেশের। যত্র-যেখানে, তত্র- সেখানে। যত্রতত্র অর্থ যেখানে-সেখানে। সর্বত্র- সবখানে। অন্যত্র- অন্যখানে। যত্রতত্র শব্দের সাথে অত্র শব্দের সাদৃশ্য থাকায় আমরা অনেকেই ‘অত্র’ বলতে ‘এই’ বুঝে থাকি এবং ভুল অর্থে প্রয়োগ করি। ‘এই’ আর ‘এখানে’- এ দুয়ের মধ্যে অর্থের বিস্তর পার্থক্য থাকলেও বিভিন্ন দাপ্তরিককাজে প্রতিনিয়তই অত্র শব্দের ভুল প্রয়োগ হচ্ছে। ‘অত্র কার্যালয়ে’ কথাটার অর্থ দাঁড়ায় ‘এখানে কার্যালয়ে’- যার কোনো অর্থই হয় না। সুতরাং ‘অত্র’ শব্দের অপপ্রয়োগরোধে সতর্ক থাকতেই হবে।
যেসব ক্ষেত্রে ক্রিয়াপদে ও-কার বর্জনীয়
ক্রিয়াপদের শেষে ও-কার বর্জন করতে হবে। যেমন : ছিলো, করলো, বলতো, করছো, শোবো, উঠবো, নেবো, লিখবো, ইত্যাদি না লিখে লিখতে হবে— ছিল, করল, বলত, করছ, শোব, উঠব, নেব ইত্যাদি লিখব।
ক্রিয়াপদের আদিতে ও-কার হবে না। যেমন কোরছ, হোতে, ইত্যাদি না লিখে লিখতে হবে Ñকরছ, হতে, ইত্যাদি।
বিশেষণ পদের শেষে ও-কার হবে না। যেমন : যেনো, যতো. এতো না লিখে লিখতে হবে যেন, যত, এত ইত্যাদি।
অব্যয় পদের শেষে ও-কার বর্জন করতে হবে। যেমন : কেনো, কতো, ততো না লিখে লিখতে হবে কেন, কত, তত ইত্যাদি।
যেসব ক্ষেত্রে ও-কার দেওয়া বিধেয় : বহুল প্রচলিত শব্দের উচ্চারণ, উৎপত্তি বা অর্থের ভেদ বোঝাতে অতিরিক্ত ও-কার যথাসম্ভব বর্জনীয়। তবে অর্থগ্রহণে ভুল হওয়ার আশংকা থাকলে কয়েকটি শব্দের শেষ বর্ণে ও-কার দেওযা যায়। যেমন : মতÑ মতো; হলÑ হলো; ভাল (মড়ড়ফ)—ভালো; কাল(নষধপশ), কালো; কেন— কেনো; কোন, কোনো।
ক্রিয়াপদে ও-কার দেওয়ার কারণ
ও-কার দেওয়ার পেছনে প্রতিটি ক্ষেত্রেই কিছু সুনির্দিষ্ট কারণ রয়েছে।
১. অনুজ্ঞাবাচক ক্রিয়াপদ হিসেবে আদেশ, নিষেধ, উপদেশ, অনুরোধ ইত্যাদি বোঝাতে আকার দেওয়া হয়। যেমন :
ক. বর্তমান অনুজ্ঞা : করো, দেখো, শেখো, আনো, এসো, বসো, লিখো, ইত্যাদি। উদাহরণ : কাজটি করো। তবে তুচ্ছার্থে ব্যবহৃত হলে ও-কার বসবে না। যেমন : কর, দেখ, শেখ, আন, বস, লিখ, ইত্যাদি। বর্ণনা অর্থে ব্যবহৃত হলেও ও-কার বসবে না। যেমন : কর, শেখ, ইত্যাদি। উদাহরণ: কী কর? লেখাপড়া শেখনি?
খ. ভবিষ্যত অনুজ্ঞা : ভবিষৎ অনুজ্ঞা বাক্যে ক্রিয়াপদে ও-কার হতে পারে। যেমন : কোরো, বোলো। উদাহারণ : কাজটি কোরো।
২. আনো প্রত্যয়ান্ত শব্দ : আনো প্রত্যয়ান্ত শব্দের শেষে ও-কার যুক্ত হবে। ক্রিয়া-বিশেষ্য অর্থাৎ কিছু কিছু ক্রিয়াকে যখন ‘আনো’ প্রত্যয় যোগে বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয় তখন ও-কার যুক্ত হয়। যেমন : করানো, বলানো, খাওয়ানো, পাঠানো, নামানো, শোয়ানো, ঘুম তাড়ানো, ছেলে ভোলানো ইত্যাদি।
‘দিই’ না ‘দেই’
আধুনিক বাংলা অভিধান ‘দেই’ শব্দটি প্রমিত হিসেবে ভুক্ত করা হয়েছে। ওখাে ন ‘দিই’ শব্দটি ‘দেই’-এর কথ্যরূপ হিসেবে উল্লেখ করেছে।
দেশি’ না দেশী’
যেহেতু ‘দেশি’ তৎসম শব্দ নয় সেহেতু ‘ঈ’-কার হবে না। দেশি হবে।
অধীন না অধীনস্থ
‘অধীন’ শব্দের অর্থ হচ্ছে কারণে তত্ত্বাবধানে থাক। যেখানে অধীন দ্বারা উদ্দেশ্য জ্ঞাপন করা যায়, সেখানে অযথা ‘স্থ’ যোগ করে ‘অধীন’ শব্দটিকে বড়ো করা অনাবশ্যক। বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানে ‘অধীনস্থ’ শব্দটি রাখা হয়নি।
সব ও সারা
সব ও সারা দুটো শব্দের অর্থ সমগ্র, সমস্ত, সর্বত্র ইত্যাদি। এটি সংখ্যা বা পরিমাণ বোঝায়। তাই সম্পর্কযুক্ত শব্দের সঙ্গে সেঁটে বসে না, ফাঁক রেখে বসে। যেমন সারা বছর, সব কথা, সব অশান্তি, সব ঘটনা, সব মানুষ, সব দেশ, সব সময়, সব সমস্যা, সব দুঃখ ইত্যাদি; সারা জীবন, সারা দিন, সারা বছর, সারা রাত, সারা দুনিয়া, সারা বাড়ি, সারা পৃথিবী ইত্যাদি।
সমেত/সহ
‘সমেত’ ও ‘সহ’ সবসময় সম্পর্কযুক্ত শব্দের সঙ্গে সেঁটে বসবে। যেমন গোষ্ঠীসমেত, পরিবারসমেত, দলবলসমেত, পিতা-মাতাসমেত, সুদসমেত ইত্যাদি; জাতিসহ, বাবাসহ, ফলসহ, বাড়িভাড়াসহ, বাজারখরচসহ ইত্যাদি।
হাত ধরা, হাত ধর
হাত ধরা বাক্্ভঙ্গির অর্থ হাত ধারণ করা, নির্ভর করা। যেতন তিনি আমার হাত ধরে আছেন। হাতধরা শব্দের অর্থ বশীভূত, অধীন। যেমন : ছেলেটি তার মনিবের হাতধরা হয়ে আছে। হাতে ধরা শব্দের অর্থ বিশেষভাবে অনুরোধ করা। সাহেবের হাতে ধরেও চাকরিটা পেলাম না।
নানাভাবে/ নানা ভাবে
নানাভাবে শব্দের অর্থ কত করে, বহু অনুনয় বিনয় করে। কিন্তু নানা ভাবে শব্দের অর্থ নানা চিন্তা করে।
ক্রিয়াপদে ‘না’ অব্যয়
ক্রিয়াপদের পূর্বে ব্যবহৃত হলে ‘না’ অব্যয়ের পর হাইফেন দেওয়া যায়। যেমন না-দেখা, না-খাওয়া, না-যাওয়া। তবে ক্রিয়া ছাড়া অন্য কোনো শব্দের আদিতে ব্যবহৃত ‘না’ অব্যয়ের পর হাইফেন দেওয়া বিধেয় নয়। যেমন নাবালক, নাহক, নাজায়েজ, নাপাক, নাখোশ ইত্যাদি।
‘বিশেষ’, ‘বহুল’
‘বিশেষ’ ও ‘বহুল’ শব্দ দুটো সম্পর্কযুক্ত শব্দের পরে বসলে একত্রে সেঁটে বসে। যেমন অবস্থাবিশেষ, দর্শনবিশেষ, পুষ্পবিশেষ, ইতরবিশেষ, ঘটনাবহুল, ব্যয়বহুল, কষ্টবহুল ইত্যাদি। কিন্তু ‘বিশেষ’ ও ‘বহুল’ শব্দ দুটো সম্পর্কযুক্ত শব্দের পূর্বে বসলে পরস্পরের ফাঁক রেখে বসে। যেমন বিশেষ সভা, বিশেষ আলাপ, বিশেষ বিবেচনা, বহুল প্রচলিত, বহুল প্রয়োগ, বহুল প্রচার, বহুল আলোচিত ইত্যাদি।
বিনা
বিনা শব্দের অর্থ ব্যতিরেকে বা ব্যতীত, ছাড়া। শব্দটি সংশ্লিষ্ট বা সম্পর্কযুক্ত শব্দের সঙ্গে সেঁটে বসে না। অর্থের মতো সে নিজেও একা, সম্পর্কযুক্ত শব্দ থেকে পৃথক বসে। যেমন বিনা মূল্য, বিনা যুদ্ধ, বিনা ব্যয়, বিনা চেষ্টা, বিনা শ্রম ইত্যাদি।
ব্যাপী
ব্যাপী শব্দ বিশেষণ পদ কিন্তু সমাসবদ্ধ পদ হিসাবে এর ব্যবহার। তাই ব্যাপী শব্দ সম্পর্কযুক্ত পদের সঙ্গে সেঁটে বসে। যেমন দেশব্যাপী, জীবনব্যাপী, বিশ্বব্যাপী, বছরব্যাপী, যুগব্যাপী, হাজার বছরব্যাপী, দশ দিন-ব্যাপী ইত্যাদি।
ঠান্ডা বানান ঠা+ন্্+ডা
ঠান্ডা, ডান্ডা আন্ডা প্রভৃতি শব্দের বানানে মূর্ধন্য দেবেন না। শব্দগুলোর বানান হবে যথাক্রক্রমে ঠা+ন্্+ডা, ডা+ন্্+ডা, আা+ন্্+ডা। ঠান্ডা হিন্দি শব্দ। অতৎসম শব্দের বানানে সাধারণ মূর্ধন্য-ণ হয় না। তাই ‘ঠান্ডা’ বানান হবে ‘ঠা+ন্্+ডা’। ডান্ডা, আন্ডা, পান্ডা প্রভৃতি শব্দও অতৎসম।
এমন কিছু শব্দ যেখানে ‘ঙ’ প্রয়োগ করা যায় না, শুধু অনুস্বার (ং) হয়:
অংশ, অংশু, এবংবিধ, কিংবদন্তী, কিংবা, কিংশুক, পাংশু, প্রিয়ংবদা, বংশ, বশংবদ, বারংবার, সংক্রমণ,সংক্রান্ত, সংক্ষিপ্ত, সংজ্ঞা, সংবৎসর, সংবরণ, সংবর্ধনা, সংবিধান, সংরোগ, সংলাপ, সংশয়, সংশোধন, সংসার, সংহত সংহিতা, স্বয়ংবর, হিংসা ইত্যাদি।
বর্ণালী এবং বর্ণালি বানানে লক্ষ করুন সমস্যা ই-কার(ি), ঈ-কার(ী) নিয়ে। বাংলা বানানে সংস্কার এখান থেকেই শুরু করতে হবে।
“এবং” – এর গুরুত্ব।
জি,জি, মারকোয়েজ একটি গল্প একদিক থেকে বিশষভাবে উল্লেখযোগ্য।গল্পটি বলা হয়েছে মাত্র একটি বাক্যে- যা ছাপাতে লেগেছে ৬ পৃষ্ঠা,
১৯৩টি ছত্র, “এবং”এতে আছে ৫৯টি-ধহফ, ১৭টি নঁঃ ( নঁঃ এবং এর কাজ করে) ও ১৭৮ টি কমা (কমা দিয়েও এবং এর কাজ করিয়ে নেওয়া যায়।) । এতগুলি বাক্যযোজক, পদযোজক (ধহফ) ও কমা ছাড়া এ গল্প বলা সম্ভব হনো না। এই গল্প থেকে “এবং” এর গুরুত্ব অনুধাবন করা যায়।
‘এবং’ কোথায় হবে না
কোনো দুটি শব্দ ‘এবং’ দিয়ে যুক্ত করা যাবে যদি শব্দ দুটি স্বতন্ত্র হয়। যদি শব্দ দুটির মধ্যে একটি প্রজাতি অন্যটি তার জাতি বোঝায় তাহলে শব্দ দুটির মধ্যে ‘এবং’ প্রয়োগ চলবে না। বিধান না মানলে কী হয় দেখুন:
১.মানুষ এবং প্রাণী মরণশীল
২. আপেল ও ফল পুষ্টিকর
৩.পায়রা ও পাখি আকাশে উড়ছে।
এক্ষণ, এক্ষণে এবং এক্ষুনি
এক্ষণ শব্দের অর্থ এই সময়, এই মুহূর্ত। এক্ষণে শব্দের অর্থ এই সময়ে, এই মুহূর্তে এবং এক্ষুনি এখনই। এখনই প্রয়োজন বলে হয়তো এ বানানে দন্ত্য ন, মনে রাখার কৌশল।
বেশি ও বেশী:
‘বেশি’ ও ‘বেশী’ দুটি ভিন্ন অর্থদ্যোতক শব্দ। উচ্চারণ অভিন্ন হলেও বানান ও অর্থ ভিন্ন। ‘বেশি’ শব্দের অর্থ অনেক বা খুব। অন্যদিকে ‘বেশী’ শব্দের অর্থ বেশধারী। সুতরাং খুব বা অনেক প্রকাশে ‘বেশি’ লিখুন।
প্রয়োগ: (১) বেশি সম্পদ মানুষকে অবিবেচক করে দেয়।
(২) পাগল-বেশী লোকটা আসলে একজন গোয়েন্দা।
দশম অধ্যায়
বানানে ‘দন্ত্য-ন’ ও ‘মূর্ধন্য-ণ’ ব্যবহারের নিয়মকে ‘ণত্ববিধান’ বলে। সংস্কৃত শব্দ হতে আগত শব্দের ক্ষেত্রে ‘ণত্ব’ বিধান প্রযোজ্য। অ-তৎসম অর্থাৎ দেশি, বিদেশি, তদ্ভব ও মিশ্র শব্দের ক্ষেত্রে ‘ণত্ব বিধান’ প্রযোজ্য নয়। তৎসম শব্দের বানানে ‘মূর্ধন্য-ণ’ থাকলে তা অবিকৃতভাবে রক্ষিত হয়। অ-তৎসম শব্দের বানানে সাধারণত ‘দন্ত্য-ন’ বসে । বাংলা ভাষায় সমোচ্চারিত বর্ণ-জটিলতার মধ্যে ‘ন’ এবং ’ণ’ জটিলতা সবেচেয়ে বিব্রতকর। ‘ণ’ এর উচ্চারণ বাংলাভাষাভাষীদের অজ্ঞাত। ভাষাবিজ্ঞানীদের অনেকে ‘মূর্ধন্য-ণ’-কে বর্জনের পক্ষে। তাই অ-তৎসম শব্দে ‘মূর্ধণ্য-ণ’ এর ব্যবহার নেই। নিম্নে ণত্ববিধানের নিয়মগুলো উল্লেখ করা হল।
১. তৎসম শব্দে ট-বর্গের (ট ঠ ড ঢ) সঙ্গে যুক্ত ‘দন্ত্য-ন’ পরিবর্তিত হয়ে ‘মূর্ধণ্য-ণ’ হয়ে যায়। যথা: কণ্টক, ঘণ্টা, অবগুণ্ঠন, মণ্ড, ব্রহ্মাণ্ড, তাণ্ডব, দণ্ড, বণ্টন, ঊৎকণ্ঠা, লণ্ঠন, লুণ্ঠন, খণ্ড, পণ্ডিত, ভণ্ড, কাণ্ড, বিষণ্ন, মণ্ডলী, ঠাণ্ডা, ঘণ্টা। এ নিয়মের দুটি ব্যতিক্রম রয়েছে। যথা:
(ক) সমাসবদ্ধ হয়ে একপদ হলে এই নিয়মটি প্রযোজ্য হবে না।
যথা: মৃগনাভি, সর্বনাম, বৃষবাহন, দুর্নাম, ত্রিনয়ন ইত্যাদি।
(খ) বিদেশাগত শব্দের বাংলা বানানে ট-বর্গের পূর্বে ‘দন্ত্য-ন’ হবে, না ‘মূর্ধন্য-ণ’ হবে এ নিয়ে বাংলা একাডেমী প্রমিত বানান কমিটি একমত হতে পারেনি। যেহেতু বিদেশি শব্দে মূর্ধন্য-ণ ব্যবহৃত হয় না, সেহেতু বিদেশাগত শব্দের এ নিয়ম মেনে চলা হবে না। যথা: ঘন্টা, এজেন্ট, ওয়ারেন্ট, কমান্ডো।
২. ‘উত্তর, পর, পার, চান্দ্র, রাম, নার, নারা, রবীন্দ্র’ শব্দের পরে ‘অয়ন’ প্রত্যয় যুক্ত হলে ‘অয়ন’ এর ‘দন্ত্য-ন’ পরিবর্তিত হয়ে ‘মূর্ধন্য-ণ’ হয়। অর্থাৎ ‘র’ কিংবা ‘র-ফলা’ পরবর্তী পদে ‘অয়ন’ শব্দ থাকলে ‘দন্ত্য-ন’ পরিবর্তিত হয়ে মূর্ধন্য-ণ হয়।
যথা: উত্তরায়ণ, দক্ষিণায়ণ, চান্দ্রায়ণ (ব্রত), পরায়ণ, নারায়ণ, রামায়ণ, রবীন্দ্রায়ণ।
৩. তৎসম শব্দে ‘অপর, পরা, পূর্ব, প্রা’ ইত্যাদি উপসর্গের সঙ্গে ‘অহ্ন’ প্রত্যয় যুক্ত হলে ‘অহ্ন’ শব্দের ‘দন্ত্য-ন’ পরিবর্তিত হয়ে ‘মূর্ধন্য-ণ’ হয়।
যথা: ‘অপরাহ্ণ, পরাহ্ণ, পূর্বাহ্ণ’, প্রাহ্ণ’।
(ক) সাধিত শব্দ হওয়া স্বত্ত্বেও কিছু কিছু শব্দে ‘র’ এর প্রভাবে ‘দন্ত্য-ন’ পরিবর্তিত হয়ে ‘মূর্ধন্য-ণ’ হয়।
যেমন: গ্রামীণ, গ্রামণী, অগ্রণী।
ব্যতিক্রম: অগ্রনেতা, অগ্রনায়ক, অগ্রনাম।
৪. তৎসম শব্দে ‘প্র, পরি, নির’্ প্রভৃতি উপসর্গের পর কতগুলো শব্দের ‘দন্ত্য-ন’ পরিবর্তিত হয়ে মূর্ধণ্য-ণ হয়। যথা:
প্র- প্রণব, প্রণয়, প্রণীত, প্রমাণ, প্রণাম, প্রণাশ, প্রয়াণ, প্রাণ, প্রণোদন, প্রণোদিত’।
পরি-পরিমাণ, পরিণাম, পরিণয়, পরিণীত, পরিধাণ, পরিণত’।
নির- নির্ণয়, নির্বাণ, নির্মাণ, নির্ণীত।
৫. সাধিত শব্দ তথা সন্ধি, সমাস ও উপসর্গ সমন্বয়ে গঠিত শব্দে ‘ঋ র ষ ক্ষ’ বর্ণের পর ‘দন্ত্য-ন’ থাকলে তা ‘মূর্ধন্য-ণ’ হয়।
যেমন: প্রণত, প্রণাম, প্রয়াণ, প্রণিধান, পরিণতি, প্রমাণ, প্রবণ, প্রবীণ, পরিণাম, পরিণয়, নির্ণীত, নির্ণয়, পরিবহণ ইত্যাদি।
ব্যতিক্রম: পরিনির্বাণ, নির্নিমেষ, প্রনষ্ট।
স্মর্তব্য, ‘দুর’ উপসর্গের পর ‘ণত্ববিধি’ প্রযোজ্য নয়।
যেমন: দুনীতি, দুর্নিবার, দুর্নাম, দুরপনেয়।
৭. তৎসম শব্দে ‘ঋ/ র/ র-ফলা/ রেফ/ ষ/ ক্ষ’ এর পর ‘দন্ত্য-ন’ থাকলে তা পরিবর্তিত হয়ে ‘মূর্ধন্য-ণ’ হয়। যথা: ঋণ, তৃণ, বর্ণ, উষ্ণ (ষ্ণ=ষ+ণ), ঘৃণা, মরণ, রণ, কৃষ্ণ, বিষ্ণু, মসৃণ, ভূষণ।
ব্যতিক্রম: ত্রিনয়ন, হরিনাম, দুর্নাম, সর্বনাম, দুর্নীতি ইত্যাদি।
(ক) ঋ বা ঋ-কারের পর ণ : ঋণ, তৃণ, ঘৃণা, মৃণাল, মসৃণ, ঋণী।
(খ) র এর পর ণ : অরণি, আহরণ, অরণ্য, অরুণ, অলংকরণ, আবরণ, আচরণ, উচ্চারণ, উদাহরণ, করণ, করুণ, কারণ, কিরণ, ক্ষরণ, চরণ, জাগরণ, জারণ, তরণী, তরুণ, ত্বরণ, দারুণ, ধরণী, ধারণ, পূরণ, পূর্ণ, প্রেরণ, পুরাণ, প্রেরণা, বরণ, ব্যাকরণ, ভরণ, রণ, মরণ, স্মরণ, কারণ, হরণ, ধরণ, ধারণা, সমীরণ, শিহরণ, হরিণ, শরণ ইত্যাদি।
(গ) র-ফলার পর মূর্ধন্য-ণ : আমন্ত্রণ, ঘ্রাণ, চিত্রণ, স্ত্রৈণ, শ্রেণি, যন্ত্রণা, মুদ্রণ, ভ্রƒণ, মিশ্রণ, প্রাণ, প্রাণি, ব্রণ, পরিত্রাণ, প্রণতি, প্রণীত, ত্রাণ, নিমন্ত্রণ, নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি।
(ঘ) রেফ-এর পর মূর্ধন্য-ণ : অর্ণব, আকীর্ণ, উদ্গীরণ, কর্ণ, বর্ণ, স্বর্ণ, ঘূর্ণন, বর্ণনা, দীর্ণ, চূর্ণ, জীর্ণ, নির্ণয়, পর্ণ, পূর্ণ, পূর্ণিমা, বিকীর্ণ, বিদীর্ণ, বিস্তীর্ণ, শীর্ণ ইত্যাদি।
(ঙ) ষ-এর পর ণ : অন্বেষণ, চূষণ, তোষণ, বিদষণ, দূষণ, নি®েপষণ, পেষণ, পোষণ, ভাষণ, বিশেষণ, বিশ্লেষণ, বিভীষণ, ভূষণ, শোষণ, কৃষাণ, পাষাণ, বিষাণ, আকর্ষণ, কর্ষণ, ঘর্ষণ, বর্ষণ, বিকর্ষণ, এষণা, গবেষণা, ঘোষণা, বিষণ্ন, ভীষণ।
(চ) ক্ষ এর পর ণ : ক্ষণ, ভক্ষণ, রক্ষণ, শিক্ষণ, প্রশিক্ষণ, নিরীক্ষণ, লক্ষণ, সংরক্ষণ, ক্ষীণ, দক্ষিণ, দূরবীক্ষণ, বীক্ষণ, ঈক্ষণ, ক্ষুণ্ন, ক্ষীণ, সমীক্ষণ, পরীক্ষণ ইত্যাদি।
(ছ) ষ-এর পর ণ : ঈষদষ্ণু, কৃষ্ণ, উষ্ণ, তৃষ্ণা, নাতিশীতোষ্ণ, ক্ষয়িষ্ণু, চলিষ্ণু, জিষ্ণু, সহিষ্ণু, বৈষ্ণব, উষ্ণীব।
৮.একই তৎসম শব্দে ‘ঋ/ রেফ/ র/ র-ফলা/ ষ /ক্ষ’ এর পর স্বরবর্ণ, ক-বর্গের ৫টি (ক খ গ ঘ ঙ), প-বর্গের ৫টি (প ফ ব ভ ম) এবং ‘য ব হ য় ং’ বর্ণের যে কোন এক বা একাধিক বর্ণ থাকলে পরবর্তী ‘দন্ত্য-ন’ পরিবর্তিত হয়ে মূর্ধন্য-ণ হয়। যেমন: অকর্মণ্য, আক্রমণ, আরোহণ, উৎক্ষেপণ, উপক্রমণিকা, কৃপণ, ক্ষেপণাস্ত্র, চর্বণ, তর্পণ, দর্পণ, দ্রবণ, নিরূপণ, বৃংহণ, পার্বণ, নি®ক্রমণ, নির্বাণ, সর্বাঙ্গীণ, সমর্পণ, শ্রাবণ, সংক্রমণ, সন্তর্পণ, ভ্রমণ, ভ্রাম্যমাণ, ম্রিয়মাণ, রমণী, কার্বণ, রাবণ, গ্রহণ, রামায়ণ, ব্রাহ্মণ, রু´িণী, অরণি, অরণ্য, আচরণ, আহরণ, উচ্চারণ, তৃষ্ণা (ষ্ণ=ষ+ণ), তরুণ, কৃপণ, চরণ, ক্ষরণ, কারণ, উষ্ণ, ধরণী, ধারণ, পূরণ, প্রেরণ, প্রাঙ্গণ, ব্যাকরণ, বর্ণ, বরণ, হরিণ, রোপণ, সারণি, সাধারণ।
ব্যতিক্রম : রচনা, নতুন, কীর্তন, প্রবর্তন, গর্জন, রটনা, নির্ধন, নতুন, নির্ধন, আয়ুষ্মান, গরীয়ান, চক্ষুষ্মান, নির্গমন, পূষন, বহির্গমন, বর্ষীয়ান, শ্রীমান ।
(ক) ঋ/ রেফ/ র/ র-ফলা, ষ / ক্ষ- এর পর ক-বর্গ, প-বর্গ এবং ‘য য় হ ং’ ছাড়া অন্য কোন বর্ণ থাকলে ‘দন্ত্য-ন’ বসবে। যেমন : অর্চনা, দর্শন, প্রার্থনা, রচনা, রটনা। শব্দের শেষে হসন্তযুক্ত ‘দন্ত্য-ন’ থাকলে তা মূর্ধন্য-ণ হয় না। যেমন: ব্রাহ্মন, শ্রীমান ইত্যাদি।
ব্যতিক্রম : ধরন এবং দরুন (শব্দদ্বয় তৎসম নয় তাই দন্ত্য-ন বসে)। সাধিত শব্দে ব্যতিক্রম দেখা যায়। যথা-দুর্নাম, দুর্নিবার, দুর্নীতি, অহর্নিশ। ‘র-ফলার’ পর ‘ত-বর্গের’ পূর্বে সাধারণত মূর্ধন্য-ণ হয় না। যেমন-আক্রান্ত, ক্রান্তি, গ্রন্থ, ভ্রান্থি, শ্রান্তি ইত্যাদি।
৯. ‘অগ্র’ শব্দের পরবর্তী ‘নী’ শব্দের ‘দন্ত্য-ন’ মূর্ধন্য-ণ হয়। উদাহরণ: অগ্রণী। কোন কিছুর নাম বোঝাতে, এক শব্দ হলে সাধিত শব্দে ‘দন্ত্য-ন’ এর স্থলে ‘মূর্ধন্য-ণ’ হয়। যথা : অগ্রহায়ণ, শূর্পণখা, ধরণী ইত্যাদি।
১০. গণনা অর্থে ‘গণ’ সহযোগে গঠিত শব্দে ‘মূর্ধন্য-ণ’ হয়।
(ক) ‘গণ’ ধাতু যোগে গঠিত শব্দে ‘মূর্ধন্য-ণ’ হবে। যথা- গণনা, গণক, গণিত, গণৎকার, গণ্য, গণনীয়।
(গ) ‘সমূহ’ বা ‘সমষ্টি’ অর্থে ‘গণ’ ধাতুযোগে গঠিত শব্দে মূর্ধন্য-ণ বসে। যথা- গণতন্ত্র, গণসংযোগ, গণশক্তি, গণরোষ, গণনায়ক, গণসঙ্গীত, গণিকা, জনগণ।
১১. ‘মান্’ (সংস্কৃত শানচ) প্রত্যয়যোগে গঠিত ক্রিয়ামূলজাত বিশেষণ পদের ‘দন্ত্য-ন’ ‘মূর্ধন্য-ণ’ হয়। যথা : অপেক্ষমাণ, ম্রিয়মাণ, ভ্রাম্যমাণ, বক্ষ্যমাণ।
১২. যে সকল শব্দে সাধারণত ‘দন্ত্য-ন’ এবং ‘মূর্ধন্য-ণ’ উভয়ের ব্যবহার প্রচলিত, প্রমিত নিয়মে আদর্শ বানান রীতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সেখানে ‘দন্ত্য-ন’ ব্যবহৃত হবে। রানী-রাণী, পরন-পরণ, সোনা-সোণা, ঠাকুরানী-ঠাকুরাণী, কান-কাণ, ঠাকুরুন-ঠাকুরুণ।
কোনরূপ নিয়ম ব্যতিরেকে ‘মূর্ধন্য-ণ’ ব্যবহৃত হয় এমন কয়েকটি শব্দ
চাণক্য, মাণিক্য, গণ/বাণিজ্য, লবণ, মণ/ বেণু, বীণা, কঙ্কণ, কণিকা/ কল্যাণ, শোণিত, মণি/ স্থাণু, গুণ, পুণ্য, বেণী/পণ, ফণী, অণু, বিপণী, গণিকা/ আপণ, লাবণ্য, বাণী/নিপুণ, ভণিতা, পাণি/গৌণ, কোণ, ভাণ,পণ, শাণ/ চিক্কণ, নিক্কণ, আণবিক,তৃণ/কপোণী, বণিক, গুণ/গণনা, পিণাক, পণ্য, বাণ/ ফণা, ঘুণ, চিক্কণ/ শোণ, শণ, জীবাণু, উৎকুণ।
স্মর্তব্যঃ হীরণ¥য় শব্দে মূর্ধন্য-ণ কিন্তু শ্রীমান ও মৃন্ময় শব্দে দন্ত্য-ন ব্যবহৃ হয়।
নত্ববিধি: দন্ত্য-ন ব্যবহারের নিয়ম
তৎসম শব্দের বানানে ণত্ববিধি অনুযায়ী দন্ত্য-ন পরিবর্তন হয়ে সাধারণত মূর্ধন্য-ণ হয়ে যায়। অ-তৎসম শব্দের বানানে সাধারণত দন্ত্য -ন বসে। উদাহরণ: কান, কোরান, ইরান, চিরুনি, সোনা, ঘরনি, পরান, জার্মান, ক্যাপ্টেন, সেকেন্ড, নন্দন, ভিন্ন, গন্ধ, ওয়ারেন্ট, প্রান্ত, বারান্দা, চন্দন, পান্থ, কর্নেল, কর্তন, বানান, রঞ্জন ইত্যাদি।
৭. পূর্বপদে ‘র ঋ ষ ক্ষ’ থাকলে মান, বান ইত্যাদি প্রত্যয়ান্ত শব্দের ‘দন্ত্য-ন’ অপরিবর্তিত থাকে। যেমন: আয়ুষ্মান, জ্যোতিষ্মান, রূপবান, শ্রীমান।