৪৫. স স্ব, সার্থ স্বার্থ, সাক্ষর স্বাক্ষর
শব্দের আদ্যাক্ষর দন্ত্য-স হলে, তা নিচে বর্ণিত যে-কোনো একটি অর্থ বোঝাতে পারে:
(১) ‘সাথে’, ‘সঙ্গে’, যেমন : সপুত্র = পুত্রের সঙ্গে, সস্ত্রীক = স্ত্রীর সঙ্গে
(২) ‘একই’ বা ‘অভিন্ন’। যেমন সজাতি= একই বা অভিন্ন জাতি; সবংশ : একই বংশ।
(৩) হ্যাঁ-বাচক কোনো বিষয়, বিদ্যমানতা, ক্রিয়াশীল প্রভৃতি। যেমন সক্রিয় = ক্রিয়াশীল (না-বাচক কিছুর বিপরীতে)। যেমন সক্রিয় শব্দের বিপরীত শব্দ হচ্ছে: নিষ্ক্রিয়=কর্মহীন।
অন্য দিকে শব্দের আদ্যাক্ষর ‘স্ব’ হলে, তা দিয়ে নিচের যেকোনো একটি অর্থ প্রকাশ করতে পারে। যেমন :
(১) স্বয়ং বা নিজ। যেমন স্বকৃত= নিজ দ্বারা কৃত, স্বনির্ধারিত, স্বঘোষণা, স্বঘোষিত প্রভৃতি।
(২) আত্মীয়, নিকটজন। যেমন স্বজন= আপনজন, স্বংবংশ = নিজের বংশ, স্বজাতি = নিজের জাতি।
(৩) নিজের। যেমন স্বগৃহ= নিজের গৃহ। স্বদেশ, স্বনাম প্রভৃতি।
উপরের আলোচনা হতে আমরা সার্থ, স্বার্থ, সাক্ষর ও স্বাক্ষর শব্দের অর্থ এবং প্রয়োগ দেখতে পারি :
সার্থ= স+অর্থ= অর্থসহ= অর্থপূর্ণ;
স্বার্থ = স্ব+অর্থ= নিজের অর্থ =নিজ প্রয়োজনের বিবেচনা; নিজের মঙ্গল বা হিত;
সার্থক=স+অর্থ+কপ্=সফল; অর্থযুক্ত;
সাক্ষর= স+অক্ষর= অক্ষর সহ = অক্ষরজ্ঞান আছে এমন; অক্ষরযুক্ত; এবং
স্বাক্ষর = স্ব+অক্ষর= নিজের অক্ষর’=সই, দস্তখত।
৪৬. চলিত ভাষায় কোমলরূপ
সাধু থেকে চলিতরূপে পরিবর্তন করা হলে কিছু কিছু শব্দ কোমলরূপ ধারণ করে। যেমন: আঙ্গিনা> আঙিনা, আঙ্গুল> আঙুল, ভাঙ্গা> ভাঙা, রাঙ্গা> রাঙা, রঙ্গিন > রঙিন, বাঙ্গালি > বাঙালি, লাঙ্গল > লাঙল প্রভৃতি। অতএব, চলিত ভাষায় কোমল রূপটি লিখুন।
৪৭. তৃচ প্রত্যয়ান্ত তা-তৃ
তৃচ প্রত্যয়ান্ত শব্দ একবচনে ‘তা’-রূপ লাভ করে। যেমন নেতৃ হতে নেতা, ভ্রাতৃ হতে ভ্রাতা, শ্রোতৃ হতে শ্রোতা প্রভৃতি। তবে বহুবচনে শব্দগুলোর ‘তৃ-রূপ বহাল থাকবে। যেমন: নেতা> নেতৃবৃন্দ, কর্মকর্তা> কর্মকতৃবৃন্দ, শ্রোতা> শ্রোতৃবৃন্দ, মাতা> মাতৃবৃন্দ, দাতা> দাতৃবৃন্দ, ভ্রাতা> ভ্রাতৃবৃন্দ প্রভৃতি।
৪৮. শব্দের শেষে বিসর্গ বিধেয় নয়
শব্দের শেষের বিসর্গ উচ্চারিত হয় না, বরং উচ্চারণে বিঘ্ন ঘটায়। তাই আধুনিক বাংলা বানানে বিস্ময়সূচক শব্দ ছাড়া (আঃ উঃ) অন্ত্য-বিসর্গ বর্জিত। বাংলা ভাষায় মূলত বিস্ময়, আকস্মিকতা, তীব্র অনুভূতি প্রভৃতি প্রকাশে বিসর্গ (ঃ)-এর উচ্চারণ প্রকাশ পায়। যেমন: আঃ (আহ্), উঃ (উহ্্), ওঃ (ওহ্্), ছিঃ (ছিহ্্), বাঃ (বাহ্্) প্রভৃতি। তাই প্রমিত বানানে পদের বানানের অন্তে বিসর্গ (ঃ) ব্যবহার হবে না। যেমন: প্রথমত, অন্তত, অংশত, ইতস্তত, ক্রমশ, তৃতীয়ত, প্রায়শ, নভ, পয়, প্রধানত, বক্ষ, বস্তুত, গৌণত, তপ, বিশেষত, মুখ্যত, যশ, সাধারণত, প্রকাশ্যত, স্বত, স্বভাবত ইত্যাদি; ধর্মত, কার্যত, আইনত, ন্যায়ত, দৃশ্যত, করত, বস্তুত, ক্রমশ, প্রায়শ, মূলত প্রভৃতি। তবে, বাংলা ব্যাকরণের রীতি অনুসারে পদমধ্যস্থ বিসর্গ অবিকৃত থাকবে। যেমন: প্রাতঃকৃত, প্রাতঃক্রিয়া, প্রাতঃস্নান, প্রাতঃস্মরণীয়, বয়ঃক্রম, বয়ঃসন্ধি, বহিঃপ্রকাশ, বহিঃশুল্ক, বহিঃসমুদ্র, মনঃকষ্ট, মনঃক্ষুণ্ন, মনঃপীড়া, মনঃপূত, মনঃপ্রাণ, মনঃসংযোগ, মনঃসমীক্ষা, শিরঃপীড়া, স্বতঃপ্রবৃত্ত, স্বতঃপ্রণোদিত, স্বতঃসিদ্ধ, স্বতঃস্ফূর্ত, অতঃপর, অধঃপতন, অন্তঃকরণ, অন্তঃকোণ, অন্তঃক্রীড়া, অন্তঃপুর, অন্তঃরাষ্ট্রিক, অন্তঃসার, দুঃশাসন, দুঃসংবাদ, দুঃসময়, দুঃসহ, দুঃসাহস, দুঃস্বপ্ন, নিঃশঙ্ক, নিঃশব্দ, নিঃশর্ত, নিঃশেষ, নিঃসঙ্কোচ, নিঃসংশয়, নিঃসঙ্গ, নিঃসন্তান, নিঃসন্দেহ, নিঃসম্বল, নিঃসরণ, নিঃসহায়, নিঃসাড়, নিঃসীম, পয়ঃপ্রণালি, পুনঃপুন, পুনঃপ্রবেশ, পৌনঃপুনিক, প্রাতঃকাল।
৪৯. তৃচপ্রত্যয়ের প্রভাব
তৃচ-প্রত্যয়ান্ত বা অন্তে ‘তা’/ ‘র্তা’-যুক্ত তৎসম শব্দের শেষে অন্য কোনো বর্ণ, শব্দ বা শব্দাংশ যুক্ত হলে মূল শব্দের ‘তা’ বা ‘র্তা’ পরিবর্তিত হয়ে যথাক্রমে ‘তৃ’ ও ‘র্তৃ’ হয়ে যায়। যেমন: [ তা = তৃ ]
১. মাতা: মাতৃস্নেহ, মাতৃভাষা, মাতৃদুগ্ধ, মাতৃভক্তি, মাতৃকুল, মাতৃত্ব, মাতৃস্তন্য, মাতৃকল্যাণ, মাতৃবৎ, মাতৃবন্দনা, মাতৃভূমি, মাতৃমৃত্যু, মাতৃবিয়োগ, মাতৃহীন প্রভৃতি।
২. পিতা: পিতৃব্য, পিতৃপুরুষ, পিতৃগৃহ, পিতৃঋণ, পিতৃতর্পণ, পিতৃধর্ম, পিতৃসত্য, পিতৃসম, পিতৃহন্তা, পিতৃসম্পত্তি, পিতৃকল্প, পিতৃলোক, পিতৃস্থানীয়, পিতৃভূমি প্রভৃতি।
৩. ভ্রাতা: ভ্রাতৃবৃন্দ, ভ্রাতৃগণ, ভ্রাতৃমণ্ডলী, ভ্রাতৃসংঘ, ভ্রাতৃপ্রতিম, ভ্রাতৃবিয়োগ, ভ্রাতৃবিদ্বেষ, ভ্রাতৃকলহ, ভ্রাতৃবধূ, ভ্রাতৃপ্রেম, ভ্রাতৃবৎ প্রভৃতি।
৪. দাতা: দাতৃবৃন্দ, দাতৃগণ, দাতৃমণ্ডলী, দাতৃভক্তি, দাতৃমৃত্যু, দাতৃবিয়োগ, দাতৃহীন, দাতৃবৎ, দাতৃবন্দনা, দাতৃসদন, দাতৃসংঘ, দাতৃকুল প্রভৃতি।
৫. নেতা: নেতৃবৃন্দ, নেতৃগণ, নেতৃত্ব, নেতৃবৎ, নেতৃবিয়োগ, নেতৃদেশ, নেতৃভক্তি, নেতৃহন্তা, নেতৃস্থানীয়, নেতৃপক্ষ, নেতৃকল্প, নেতৃতর্পণ, নেতৃকলহ প্রভৃতি।
৬. শ্রোতা: শ্রোতৃবৃন্দ, শ্রোতৃগণ, শ্রোতৃমণ্ডলী, শ্রোতৃকুল, শ্রোতৃবৎ, শ্রোতৃহীন, শ্রোতৃসংঘ, শ্রোতৃকলহ, শ্রোতৃকল্প, শ্রোতৃস্বরূপ প্রভৃতি। [ র্তা = র্তৃ ]।
৭. কর্তা: কর্তৃবৃন্দ, কর্তৃগণ, কর্তৃমণ্ডলী, কর্তৃপক্ষ, কর্তৃভবন, কর্তৃরূপ, কর্তৃবিয়োগ, কর্তৃহীন, কর্তৃতর্পণ, কর্তৃবৎ, কর্তৃস্থানীয়, কর্তৃভক্তি, কর্তৃহন্তা, কর্তৃকুল,কতৃকারক ইত্যদি।
৮. কর্মকর্তা: কর্মকর্তৃবৃন্দ, কর্মকর্তৃগণ, কর্মকর্তৃবৎ, কর্মকর্তৃভবন, কমকতৃকারক, কর্মকর্তৃমণ্ডলী কর্মকর্তৃতুল্য, কর্মকর্তৃপরিষদ, কর্মকর্তৃসংঘ, কর্মকর্তৃহীন, কর্মকর্তৃবিয়োগ প্রভৃতি।
৯. হোতা : হোতৃগণ, হোতৃবন্ধ, হোতৃসম।
৫০. অবিকৃত ও বিকৃত ‘এ’
বাংলায় ‘এ’ বা ‘এ-কার’ দ্বারা অবিকৃত ‘এ’ এবং বিকৃত বা ‘বাঁকা অ্যা’ উভয় উচ্চারণ বা ধ্বনি নিষ্পন্ন হয়। তৎসম বা সংস্কৃত ব্যাস, ব্যায়াম, ব্যাহত, জ্যামিতি প্রভৃতি শব্দের বানান অনুরূপভাবে লেখা বিধেয়। তৎসম এবং বিদেশি শব্দ ছাড়া অন্য সব বানানে অবিকৃত-বিকৃত নির্বিশেষে ‘এ’ বা ‘এ-কার’ হবে। যেমন: দেখে, যেন, কেন, গেল, গেছে প্রভৃতি। বিদেশি শব্দে অবিকৃত উচ্চারণের ক্ষেত্রে ‘এ’ বা ‘এ-কার’ ব্যবহৃত হবে। যেমন এন্ড (ঊহফ), নেট (ঘবঃ), বেড (ইবফ)। বিদেশি শব্দে বিকৃত বা বাঁকা উচ্চারণে ‘অ্যা’ বা ‘্যা’ ব্যবহৃত হবে। যেমন: অ্যান্ড (অহফ), অ্যাডভোকেট (অফাড়পধঃব), অ্যাসিড, ম্যাচ, প্যাঁচ, হ্যাট, ব্যাক। তবে এমন কিছু তদ্ভব, বিশেষভাবে দেশি শব্দ রয়েছে যার ‘্যা’ কারযুক্ত-রূপ বহুল প্রচলিত। যেমন: ব্যাঙ, চ্যাঙ, ল্যাঙ, ল্যাঠা, জ্যাঠা প্রভৃতি শব্দে ‘্যা’ অপরিবর্তিত থাকবে।
৫১. ত্ব-প্রত্যয়যুক্ত শব্দের মধ্যাংশ
‘ত্ব’ প্রত্যয়যুক্ত শব্দের মধ্যাংশে ই-কার হবে। যেমন: একাকী > একাকিত্ব, দায়ী > দায়িত্ব, সখী > সখিত্ব, মন্ত্রী > মন্ত্রিত্ব, নারী> নারিত্ব প্রভৃতি।