৫২. প্রায়, প্রধান, বহুল, বিশেষ
‘প্রায়, প্রধান, বহুল, বিশেষ, অনেক, কয়েক, কিছু, নানা, নানান, বহু, বিচিত্র, বিভিন্ন, সব, সারা, হরেক’ ইত্যাদি শব্দ সম্পর্কযুক্ত শব্দ হতে সাধারণত ফাঁক রেখে বসে। যেমন: প্রায় প্রতিদিন, প্রায় স্থানে, প্রধান ডাকঘর, বহুল প্রচলিত, বহুল আলোচিত, বিশেষ বাহক, বিশেষ ঘটনা, অনেক বছর, কয়েক দিন, কিছু গান, নানা মত, নানান রং, বহু দেশ, বিচিত্র পাখি, বিভিন্ন জাতি, সব কথা, সারা দেশ, হরেক রকম। তবে কিছু ব্যতিক্রম রয়েছে। যেমন: নানারূপ, নানাবিধ, বহুকাল, বহুক্ষণ, সবকিছু, সারাক্ষণ, কয়েকজন, অনেকক্ষণ, কিছুকাল, অনেকজন, সবশেষে ইত্যাদি।
৫৩. য-প্রত্যয়
যোগ্যতা, গুণ ও বৈশিষ্ট্য বোঝাতে য-প্রত্যয় ব্যবহৃত হয়। যেমন: অন্ত+য = অন্ত্য, কবি+য= কাব্য, এক+য= ঐক্য, গ্রাম+য= গ্রাম্য, সুস্থ+য= স্বাস্থ্য, তরুণ+য= তারুণ্য, সেনা+য= সৈন্য ইত্যাদি।
তৎসম স্ত্রীবাচক শব্দ
৫৪. তৎসম শব্দে স্ত্রীবাচক শব্দের শেষে ‘দীর্ঘ ঈ-কার বসে। যেমন: কল্যাণী, কিশোরী, নর্তকী, সুন্দরী, তরুণী, নারী, রমণী প্রভৃতি।
৫৫. ব্যক্তি বা পুরুষ প্রকাশে তৎসম শব্দে দীর্ঘ ঈ-কার
ব্যক্তি বা পুরুষ প্রকাশ করলে তৎসম শব্দের শেষে ‘দীর্ঘ ঈ-কার’ বসবে। যেমন: অপরাধী, দোষী, বিরহী, মানবী, ত্যাগী, প্রণয়ী, বিদেহী, সঞ্চয়ী, সাহসী, সন্ন্যাসী প্রভৃতি। তবে অতৎসম হলে ই-কার বসবে। যেমন : গাভি, দাদি, নানি প্রভৃতি।
৫৬. নির্দেশক পদের অবস্থান
টা, টি, টে, টো, খান, খানা, খানি, টুকু, গুলি, গুলো, রা, এরা, আবলি, কুল, গণ, গুচ্ছ, চয়, দল (বহুবচন অর্থে), পুঞ্জ, বর্গ, বৃন্দ, মণ্ডলী, রাজি, রাশি, মালা, সকল, সমুচ্চয়, সমূহ প্রভৃতি সংশ্লিষ্ট শব্দের সঙ্গে সেঁটে বসে। এসব নির্দেশক শব্দ কখনো পৃথক বসে না। যেমন: আমটি, দশখানা, আমগুলো, মেঘমালা, গল্পসমূচ্চয়, গ্রন্থসমূহ ইত্যাদি। তবে খান, সমূহ, সকল ইত্যাদি সংশ্লিষ্ট শব্দের আগে বসলে সেঁটে বসবে না। যেমন: খান বিশেক, সমূহ বিপদ, সকল শিক্ষক প্রভৃতি।
৫৭. বিশেষণ থেকে বিশেষ্য করার কৌশল
শব্দটি যদি বিশেষণ হয় এবং সেই শব্দের শেষ অক্ষর যদি র-ফলা বা রেফ থাকে, তা হলে ওই শব্দের বিশেষ্যে পরিণত হতে গেলে য-ফলা দরকার পড়বে। যেমন: দরিদ্র> দারিদ্র্য, নিষ্কর্মা> নৈষ্কর্ম্য, দীর্ঘ> দৈর্ঘ্য, সমগ্র>সামগ্র্য, বিচিত্র> বৈচিত্র্য, সমর্থ> সামর্থ্য ইত্যাদি। বিশেষণ পদেও এমন বহু শব্দ আছে যাতে য-ফলা প্রয়োজন। যেমন: অচিন্ত্য, অনিন্দ্য, আলোচ্য, ঔষ্ঠ্য, কণ্ঠ্য, চর্ব্য, জ্যেষ্ঠ, দন্ত্য, নমস্য, প্রণম্য, বন্য, বরেণ্য, ভোগ্য, ভোজ্য, মান্য, মূর্ধন্য, সান্ধ্য ইত্যাদি।
৫৮. আ-কার লোপ-কাহিনি
‘আ-কার’ নিয়ে বানান-সমস্যা ব্যবহারগত বিবেচনায় জটিল না-হলেও ক্ষেত্রবিশেষে ‘আ-কার’ কখনো কখনো মহা ঝামেলার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। কিছু বিশেষ্যপদ বিশেষণে পরিণত হওয়ার সময় ‘আ-কার’ ছেড়ে দেয়। মনে হয় যেন ভুলবশত আ-কার বাদ পড়েছে। অতিপরিচিত ও
চেনা শব্দে ‘আ-কার’ বিলুপ্তির বিষয়টি অনেককে দ্বিধায় ফেলে দেয়। ফলে ‘আ-কার’-যুক্ত শব্দে এরূপ ‘আ-কার’-চ্যুতির ঘটনা বানানে ভুলের অবতারণা ঘটায়।
যেমন: যথেচ্ছা, চেতনা, প্রতিজ্ঞা প্রভৃতি বিশেষ্য পদ বিশেষণে পরিবর্তন করলে যথাক্রমে যথেচ্ছ, চেতন, প্রতিজ্ঞ হয়ে যায়। এরূপ আরও কিছু শব্দের উদাহরণ দেওয়া হলো : আকাক্সক্ষা> আকাক্সক্ষ, দূরাকাক্সক্ষা> দূরাকাক্সক্ষ, আশা> আশ, হতাশা> হতাশ, ইচ্ছা> ইচ্ছ, যথেচ্ছা> যথেচ্ছ, কুণ্ঠা> কুণ্ঠ, ব্যয়কুণ্ঠা> ব্যয়কুণ্ঠ, চেতনা> চেতন, পরিবেশচেতনা> পরিবেশচেতন, চেষ্টা > চেষ্ট, সচেষ্টা > সচেষ্ট, দয়া> দয়, সদয়া> সদয়, নিদ্রা> নিদ্র, বিনিদ্রা> বিনিদ্র, প্রতিজ্ঞা> প্রতিজ্ঞ, দৃঢ়প্রতিজ্ঞা> দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, বাধা> বাধ,
অবাধা> অবাধ, বিদ্যা> বিদ্য, কৃতবিদ্যা> কৃতবিদ্য, ভাষা> ভাষ, মিতভাষা> মিতভাষ, রেখা> রেখ, নিম্নরেখা> নিম্নরেখ, লজ্জা> লজ্জ, সলজ্জা> সলজ্জ, লীলা > লীল, সলীলা (ভঙ্গি)> সলীল, শ্রদ্ধা> শ্রদ্ধ, সশ্রদ্ধা> সশ্রদ্ধ, সংখ্যা> সংখ্য, অসংখ্যা> অসংখ্য, অপেক্ষা> অপেক্ষমাণ প্রভৃতি।
৫৯. হস্ চিহ্ন বর্জন
আধুনিক বাংলা বানানে হস্-চিহ্ন যথাসম্ভব বর্জন করা হবে। যেমন: কাত, মদ, চট, কলকল, তছনছ, চেক, ডিশ, টাক, টক, লক ইত্যাদি। ভুল উচ্চারণের আশঙ্কা থাকলে হস্ চিহ্ন ব্যবহার করা যেতে পারে। যেমন: হস্, আহ্, উহ্ ইত্যাদি। যদি অর্থ-বিভ্রান্তির আশঙ্কা থাকে তাহলে তুচ্ছ অনুজ্ঞায় হস্ চিহ্ন ব্যবহার করা যেতে পারে। যেমন: কর্, ধর্, মর্, বল্ প্রভৃতি।
তবে কিছু কিছু শব্দে হসন্ত দিতে হবে, নইলে ভুল হবে। বিশেষ করে উদ্ উপসর্গের দ-এর সঙ্গে হসন্ত দিতে হবে। যেমন: উদ্ঘাটন, উদ্বেগ, উদ্ভ্রান্ত, উদ্যান, দিক্পাল, দিক্ভ্রম, দিক্ভ্রষ্ট, দিগ্দর্শন, প্রাক্কথন, বাক্সর্বস্ব, বাগ্বিতণ্ডা, বাগ্দেবী প্রভৃতি। বাংলায় ‘ব’ দুটি। একটি বর্গীয়-ব এবং অন্যটি অন্তঃস্থ-ব। বর্গীয়-ব উচ্চারিত হয় কিন্তু অন্তঃস্থ-ব উচ্চারিত হয় না। কিছু কিছু শব্দে বর্গীয়-ব এবং অন্তঃস্থ-ব দুটোই যুক্ত হয়। সেক্ষেত্রে ব-এর উচ্চারণ-অনুচ্চারণ যাতে শব্দের সঠিক উচ্চারণে বিঘ্ন সৃষ্টি না করে সেজন্য শব্দের বর্ণের সঙ্গে অন্তঃস্থ-ব যুক্ত হলে তাকে পৃথকভাবে লেখা হয়। এই সব শব্দে হসন্ত দিতে হবে। যেমন : উদ্ধ্মান, উদ্বদ্ধ, উদ্বন্ধক, উদ্বন্ধন, উদ্বমন, উদ্বান্ত, উদবায়ী, উদ্বায়ু, উদ্বাসন , উদ্বাস্তু, উদ্বাহ, উদবাহন প্রভৃতি।
শুদ্ধ বানান চর্চা (শুবাচ) প্রমিত বানানবিধি
৬০. লেখ লেখা লেখনী ও লেখসামগ্রী
সংস্কৃত এবং বাক্যে বিশেষ্য হিসাবে প্রযুক্ত ‘লেখ (= √লিখ্+ অ)’ শব্দের অর্থ— লিখন, লিপি, লিখিত বিষয় প্রভৃতি। যে লিখে বা লিপিবদ্ধ করে সে-ই লেখক (√লিখ্+ অক)। লেখক শব্দের আরো অর্থ রয়েছে। যেমন— গ্রন্থরচয়িতা, লিপিকর, সাহিত্যিক, গ্রন্থকার প্রভৃতি। যেমন: হায়াৎ মামুদ একজন লেখক।
লেখা [√লিখ্+ অ + আ (টাপ্)] শব্দটি সংস্কৃত এবং বাক্যে একাধিক পদ হিসেবে প্রযুক্ত হয়। ক্রিয়া বিশেষণে ‘লেখা’ শব্দের অর্থ : লিপিবদ্ধ করা, রচনা করা, লিখিতভাবে অবহিত করা, আঁকা প্রভৃতি। বিশেষ্যে লেখা শব্দের অর্থ : রচনা, লিখন, হস্তলিপি, শ্রেণি, চিহ্ন, রেখা প্রভৃতি। বিশেষণে শব্দটির অর্থ লিখিত। অতএব, লেখা অর্থ লিপিবদ্ধ করার কাজও হতে পারে আবার লেখক যা লিপিবদ্ধ করেছে তা-ও হতে পারে। এটি নির্ভর করে শব্দটি বাক্যে, কোন পদ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে তার ওপর। যেমন: শুভাষ বাবুর লেখা, লেখাগুলো পড়ে মজা পেলাম।
লেখনী (√লিখ্+ অন+ ঈ) সংস্কৃত শব্দ এবং বাক্যে বিশেষ্য পদ হিসাবে ব্যবহৃত হয়। এর অর্থ কলম, পেন্সিল, ছবি আঁকার তুলি। এককথায় যা দিয়ে লেখা হয় সেটিই লেখনী। যেমন : শুধু দামি লেখনী দিয়ে লেখা হলে ওই লেখা দামি হয় না। দামি লেখা হতে হলে লেখায় মান থাকতে হয়।
তবে, লেখসামগ্রী এবং লেখনী এক নয়। লেখসামগ্রী বললে, লেখার কাগজ, কলম, পেন্সিল প্রভৃতি বোঝাবে। যাকে ইংরেজিতে ঝঃধঃরড়হবৎু বলা হয়। অর্থাৎ সকল ‘লেখনী’ লেখসামগ্রী কিন্তু সকল ‘লেখসামগ্রী’ লেখনী নয়।