৯১. ছদ্মবেশী সমাস
যে শব্দ বা পদ সমাসবদ্ধ, কিন্তু ধ্বনিগত পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট বিশেষ গঠনের ফলে সমাসবদ্ধ পদ কি না সহজে বোঝা যায় না, তাকে ছদ্মবেশী সমাস বলে। মূল সমাসবদ্ধ পদ পরিবর্তিত শব্দের মধ্যে ছদ্মবেশ ধারণ করে থাকে। তািই এদের ছদ্মবেশী সমাস বলে। যেমন— ভ্রাতৃ-জায়া থেকে ভাজ। ভাজ শব্দের মধ্যে ছদ্মবেশে লুকিয়ে আছে ভ্রাতৃ ও জায়া। কিন্তু ‘ভাজ’ শব্দটি দেখে তা বোঝা যায় না। অনুরূপ: ভ্রাতৃ ও শ্বশুর থেকে ভাশুর। তেমনি কুমোর < কুম্ভকার, কামার < কর্মকার, চামার< চর্মকার, অঘ্রান < অগ্রহায়ন, বাসর < বাসগৃহ, ধোঁয়াশা< ধোঁয়া ও কুয়াশা প্রভৃতি।
৯২. বাক্যাশ্রয়ী সমাস
বাক্যের মধ্যে লুকায়িত বা আপাতদৃষ্টে বাক্যের অনুরূপ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী সমাসকে বাক্যাশ্রয়ী সমাস বলা হয়। যদি কোনো সমাসবদ্ধ পদ একটি বাক্যের ন্যায় গঠন নিয়ে বাাক্যের মতো অর্থ প্রকাশ করে, তাকে বাক্যাশ্রয়ী সমাস বলে। প্রথমে মনে হয় এগুলো সমাসবদ্ধ পদ নয়, ভালোভাবে লক্ষ্য করলে বোঝা যায়, সমাসবদ্ধ পদ। যেমন: পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন। রক্তদান কর্মসূচি। কোরোনা প্রতিরোধ করো। দুনিয়ার মজদুর এক হও।
৯৩. সুপসুপা সমাস:
বিভক্তিযুক্ত একটি পদের সঙ্গে অন্য একটি বিভক্তিযুক্ত পদ একত্রিত হয়ে যে সমাস হয়, তাকে সুপসুপা সমাস বা সহসুপা সমাস বলা হয়। যেমন – ভূতপূর্ব; সংস্কৃতে পূর্বম – দ্বিতীয়া বিভক্তির পদ এবং ভূতঃ – প্রথমা বিভক্তির পদ। এখানে বিভক্তিযুক্ত উভয় পদ যুক্ত হয়ে সমাস হয়েছে। তাই এটি সুপসুপা সমাস। এরূপ উদাহরণ– প্রত্যক্ষভূত, নাতিশীতোষ্ণ, পূর্বকায়, পূর্বরাত্র ইত্যাদি। বাংলা ব্যাকরণে সুপসুপা সমাসকে তৎপুরুষ, কর্মধারয় প্রভৃতি সমাসের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
৯৪. প্রত্যয়ান্ত সমাস:
যে সমাসে সমস্যমান পদ একত্র হয়ে গঠিত সমস্তপদের শেষে অতিরিক্ত একটি প্রত্যয় যুক্ত হয়, তাকে প্রত্যয়ান্ত সমাস বা সমাসান্ত প্রত্যয় বলে। যেমন—কীর্তি নাশ করে যে: কীর্তিনাশ + আ = কীর্তিনাশা (আ-প্রত্যয় যুক্ত হয়েছে)। বহুব্রীহি সমাসে সাধারণত এর প্রয়োগ বেশি পাওয়া যায়। অনুরূপ:
১) স্ত্রীলিঙ্গ শব্দ এবং ঋ-কারান্ত শব্দ বহুব্রীহি সমাসের শেষে থাকলে ‘ক’ প্রত্যয় যুক্ত হয়। যেমন – পত্নীর সাথে বর্তমান = সপত্নীক, সস্ত্রীক, অভীক, নির্ভীক, নদীমাতৃক ইত্যাদি।
২) প্রতি, সম, পর – এসব উপসর্গের পর ‘অক্ষি’ শব্দ থাকলে ‘অক্ষি’ শব্দের ‘ই’ লোপ পেয়ে সমস্তপদে ‘অ’ প্রত্যয় যুক্ত হয়। যেমন- প্রত্যক্ষ, পরোক্ষ, সমক্ষ, বিরুপাক্ষ, হর্ষক্ষ।
৩) অপ – এর পর ‘অ’ প্রত্যয়। যেমন- দ্বি অপ যার = দ্বিপ, অন্তরীপ, অনূপ।
৪) পথিন্ শব্দের ‘ন’ লুপ্ত হয়ে ‘অ’ প্রত্যয় যুক্ত হয়। যেমন – জলপথ, বিপথ, কুপথ ।
৫) শব্দের শেষে অস্ থাকলে তার পরে ‘ক’ যুক্ত হয়। যেমন- অন্য দিকে মন যার = অন্যমনস্ক।
বাংলা প্রত্যয়ান্ত সমাস বা সমাসান্ত প্রত্যয়:
বাংলায় সাধারণত সমস্তপদে ‘আ, এ, ও- প্রত্যয় যুক্ত হতে দেখা যায়। যেমন- একচোখা (একচোখ+আ), একরোখা, একতারা, দোতারা, দোনলা, নির্জলা, সর্বনাশা, হাঘরে, ঊনপাজুরে, ডাকাবুকো, বিড়ালচোখা, বে-আইনি, বারমাস্যা ইত্যাদি।
৯৫. অলুক সমাস
‘লুক’ অর্থ ‘লোপ’। সুতরাং অলুক অর্থ অ+লু। অর্থ ‘যার লোপ নেই’। যে সমাসে সমস্যমান পদের বিভক্তি সমস্তপদ গঠিত হওয়ার পরও লোপ পায় না, তাকে অলুক সমাস বলে। যেমন: চোখের বালি = চোখের বালি। এখানে ‘চোখের বালি’ সমস্যমান পদের ‘চোখের’ পদটিতে ষষ্ঠী বিভক্তি (র) আছে এবং সমস্তপদ গঠিত হওয়ার পরও সেই ষষ্ঠী বিভক্তি বিদ্যমান রয়েছে; অর্থাৎ কোনো বিভক্তি লোপ পায়নি। তাই এটি অলুক সমাস। ঘরের বউ, নদীর জল, হাতেনাতে প্রভৃতি। অলুক সমাসের প্রকারভেদ: বাংলা সমাসে তিন প্রকার অলুকের অস্তিত্ব পাওয়া যায়, অর্থাৎ অলুক সমাস তিন প্রকার। যথা: ১) অলুক দ্বন্দ্ব, ২) অলুক তৎপুরুষ, ৩) অলুক বহুব্রীহি।
৯৬. নিত্য সমাস ও অনিত্য সমাস বা সাধারণ সমাস
নিত্য সমাস: যে সমাসবদ্ধ পদের ব্যাসবাক্য নির্ণয় করা যায় না বা করতে গেলে অন্য পদের সাহায্য নিতে হয় তাকে নিত্য সমাস বলে। যেমন- শিয়ালকাঁটা (এখানে শিয়ালের সাথে কাঁটার কোন সম্পর্ক নেই); এর ব্যাসবাক্য সম্ভব নয়। এরূপ- দাঁড়কাক, কালসাপ। দেশান্তর = অন্য দেশ; এখানে ব্যাসবাক্য করতে নতুন একটি পদের সাহায্য লাগছে, তাই এটি নিত্য সমাস।
বাংলা ভাষায় নিত্য সমাসের অন্তর্ভুক্ত সমাস হচ্ছে অব্যয়ীভাব সমাস। অব্যয়ীভাব সমাসকে ব্যাসবাক্যে পরিণত করার জন্য অন্য পদের প্রয়োজন হয়। যেমন- উদ্বেল = বেলাকে অতিক্রান্ত। সমস্তপদটিকে বিশ্লেষণ করতে ‘অতিক্রান্ত’ পদটির সাহায্য লাগছে।
অনিত্য সমাস: যে সমাসবদ্ধ পদের ব্যাসবাক্য নির্ণয় করা যায় তার সমস্তপদ থেকেই, তাকে অনিত্য সমাস বা সাধারণ সমাস বলে। যেমন- বাবা ও মা = বাবা-মা; কাঁচা অথচ মিঠা = কাঁচামিঠা। অনিত্য সমাসের অন্তর্ভুক্ত সমাস হচ্ছে- ১. দ্বন্দ্ব সমাস, ২.বহুব্রীহি সমাস, ৩. তৎপুরুষ সমাস, ৪.কর্মধারয় এবং ৫. দ্বিগু।
৯৭. হরির লুস থেকে হরিলুট
শুবাচি অসিত দাস তাঁর ‘নামধামের উৎসকথা গ্রন্থে লিখেছেন, “বহুল প্রচলিত হরিলুট কথাটির আদি রূপ ছিল হরির লুস এবং লুস কথাটির প্রাচীন অর্থ ভোজন।”
পরবর্তীকালে হরির লুস কথাটি হয়ে যায় হরিলুট। কিন্তু, এমন হওয়ার কারণ কী? প্রধান কারণ— লোকনিরুক্তি। হরিলুট কথাটি লোকনিরুক্তির কবলে পড়ে সাধারণ মানুষের মুখে এসে হরিলুট হয়ে গেছে। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ অভিধানেও লুস কথাটির অর্থ দেওয়া হয়েছে ভোজন। সে হিসেবে হরির লুস অর্থ— হরির ভোজন।
মূলত হরি বা ঈশ্বরের উদ্দেশে নিবেদিত অর্ঘ্য বা ভুজ্যি, মিষ্টি প্রভৃতি প্রসাদ ভক্তদের দিকে ছুড়ে দেওয়ার দীর্ঘ সংস্কার হরির লুস নামে প্রচলিত ছিল। লুস শব্দর অর্থ, যে ভোজন তা অধিকাংশ বাঙালি জানত না। তারা দেখত— যা হরির লুস নামে পরিচিত তা অসংখ্য লোকজন লুটেরার মতো হুড়োহুড়ি করে লুটিয়ে নিচ্ছে। এখানে কোনো শৃঙ্খলা নেই। লুটের মতো যার শক্তি বা লোকবল বেশি সে অধিক পাচ্ছে। যারা নিরীহ তারা কিছুই পাচ্ছে না। অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে। এমন ঘটনা লুটের ক্ষেত্রে ঘটে থাকে। তাই সাধারণ মানুষের কাছে লুস কথাটি হয়ে যায় লুট। ফলের হরির লুস হয়ে যায় হরির লুট বা হরিলুট।
বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানমতে, সংস্কৃত হরি ও বাংলা লুট শব্দের সমন্বয়ে গঠিত হরিলুট অর্থ— (বিশেষ্যে) হরি সংকীর্তনের পর ভক্তদের মাঝে হরির নামে বাতাসা প্রভৃতি ছড়িয়ে দেওয়ার সংস্কার। এটি নেতিবাচক নয়। অভিধানে যাই থাকুক না কেন, বর্তমানে হরিলুট শব্দটি নেতিবাচক অর্থেই ব্যবহৃত হয়। অধুনা এর আলংকারিক ও বহুল প্রায়োগিক অর্থ— জোর যার মুল্লুক তার, সরকারকা মাল, দরিয়ামে ঢাল। অর্থাৎ, সেই বেশি ভোগ করতে পারবে, যার শক্তি বেশি। যার শক্তি ও ক্ষমতা নেই সে ন্যূনতম মৌলিক চাহিদা মেটানোর সুযোগও পাবে না। তেলাপোকার দৌঁড় আর ইুঁদরের খুট, সরকারি টাকাপয়সার চলছে হরিলুট।
৯৮. শব্দের ডিজিটাল অভিধার্থ : শুশ্রূষা
শুশ্রূষা শব্দের আভিধানিক অর্থ পরিচর্যা, সেবা ইত্যাদি। আবার ‘শ্রবণ করার ইচ্ছা’ বাগ্ভঙ্গিকে এককথায় ‘শুশ্রূষা’ বলা হয় (সংস্কৃতে)।
অর্থাৎ
শুশ্রূষা = পরিচর্ষা ————————————(১)
শুশ্রূষা = সেবা ————————————— (২)
শুশ্রূষা = শ্রবণ করার ইচ্ছা ————————– (৩)
সেবা = পরিচর্যা = আদর = সোহাগ, ধাত্রীগিরি ——-(৪)
সুতরাং সমীকরণ (১), (২), (৩) ও (৪) হতে পাই
শ্রবণ করার ইচ্ছা = শুশ্রূষা = পরিচর্যা= সেবা= আদর= মমতা= ধাত্রীগিরি। অতএব ভাষা-গণিত অনুসারে, কেবল ‘শোনার ইচ্ছা’ থাকলেই হলো; প্রকৃতপক্ষে আর্থিক, শারীরিক বা মানসিকভাবে কারও সেবা, পরিচর্যা, আদর, মমতা, ধাত্রীগিরি না-করেও শ্রবণ করার ইচ্ছা থাকলে ‘শুশ্রূষা’ হয়ে যায়। হয়তো এজন্য আমরা, অসহায়-আহত বা দরিদ্র মানুষ, বৃদ্ধ-পিতামাতা কিংবা অত্যাচারিতের করুণ আর্তনাদ শুধু ‘শ্রবণ করার ইচ্ছা’ করি মাঝে মাঝে বাধ্য হয়ে শুনে যাই।
শোনার ইচ্ছা = শুশ্রূষা; তাই কোনো কিছু না-করেও, এমনকি না শুনেও কেবল ‘শোনার ইচ্ছা’ থেকে আমরা শুশ্রূষার যশ, অর্থ, সওয়াব, পুণ্য, কর্তব্যপালন সব কিছু পেয়ে যাই। এ হিসাবে যে কেউ বুড়ো মা-বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিয়ে ঘরে বসে পিতা-মাতার ‘কথা শ্রবণের ইচ্ছা’ও শুশ্রূষা দাবি করতে পারেন। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে পারেন, আমরা পিতামাতার শুশ্রূষায় নিয়োজিত।
কী মজা!
৯৯. ‘টি’ ‘টা’- কোনটি কখন:
টি টা নিয়ে সংশয়ে পড়লে গুনগুন করে গাইতে পারেন:
“চুপ চুপ লক্ষ্মিটি শুনবে যদি গল্পটি
এক যে ছিল তোমার মতো ছোট্ট রাজকুমার- – -।”
এই গানেই পেয়ে যাবেন টি কোথায় বসাবেন— লক্ষ্মিটি আর গল্পটি। মাটি বানানেও টি, খাঁটি বানানেও টি।
অনেকে প্রশ্ন করেন, “শব্দের শেষে ‘টা’ বা ‘টি’ কখন কোনটি বসাব?” একটা না কি একটি? বাঁশটা না কি বাঁশটি? কলমটা নাকি কলমটি?
আসলে, এ বিষয়ে কঠিন কোনো লিখিত নিয়ম নেই। ব্যাকরণও কিছু বলে না, তবে বৈয়াকরণ অনেক কিছু বলেন। একটি বাংলা প্রবাদে তুচ্ছার্থে ‘টা’ এবং গৌরবার্থে ‘টি’ প্রত্যয় ব্যবহার করার নির্দেশনা পাওয়া যায়। প্রবাদটি দেখুন :
“আমার ছেলে ছেলেটি, খায় শুধু এতটি
বেড়ায় যেন গোপালটি।
ওদের ছেলে ছেলেটা, খায় দেখ কতটা
বেড়ায় যেন বাঁদরটা।”
আমি সাধারণত তুচ্ছার্থে ‘টা’ এবং অন্যার্থে ‘টি’ প্রয়োগ করে থাকি। মনে রাখবেন, টি বা চা অনেকের প্রিয়। তাই প্রিয় জিনিসে ‘টি’ বসান। এটি কিন্তু শক্ত কোনো বিধি নয়। এ নিয়ম পালিত না-হলে ভুল হবে— এমন বলা যাবে না।
সূত্র: ব্যাবহারিক প্রমিত বাংলা বানান সমগ্র, পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.
১০০. শব্দের আদিতে /ব্য/ ও /ব্যা/ এর প্রয়োগ
১. শব্দের আদিতে /ব্য/ এর প্রয়োগ (বি+অ= ব্য)
/বি-/ উপসর্গের পর /অ/-বর্ণ দিয়ে শুরু শব্দ সন্ধিবদ্ধ হয়ে /ব্য/ হয়। যেমন: বি + অগ্র = ব্যগ্র; বি +অঙ্গ = ব্যঙ্গ। তেমনি: ব্যক্ত, ব্যক্তি, ব্যঙ্গাত্মক, ব্যঙ্গোক্তি, ব্যজন, ব্যঞ্জন, ব্যঞ্জনা, ব্যতিক্রম,ব্যতিব্যস্ত, ব্যতিরেক, ব্যতিহার, ব্যতীত, ব্যত্যয়, ব্যপদেশ, ব্যবচ্ছিন্ন, ব্যবচ্ছেদ, ব্যবধান, ব্যবসায়ী, ব্যবস্থা, ব্যবস্থাপক, ব্যবহার, ব্যবহারিক, ব্যবহৃত, ব্যভিচার, ব্যয়, ব্যর্থ, ব্যষ্টি, ব্যস্ত।
২. শব্দের আদিতে /ব্যা / এর প্রয়োগ (বি+আ= ব্যা)
/বি-/ উপসর্গের পর /আ/ বর্ণ দিয়ে শুরু শব্দ সন্ধিবদ্ধ হলে /ব্যা/ হয়। যেমন: বি+ আকুল = ব্যাকুল; বি+ আঘাত = ব্যাঘাত। তেমনি: ব্যাকরণ, ব্যাখ্যা, ব্যাদান, ব্যাধি, ব্যাপক, ব্যাপার, ব্যাপী, ব্যাপৃত, ব্যাপক, ব্যাপ্ত, ব্যাপ্তি, ব্যায়াম, ব্যাহত।
ব্যতিক্রম: /বি-/ উপসর্গ দিয়ে শুরু হয়নি এমন কিছু শব্দের বানানের শুরুতে /ব্য/ দেখা যায়। যেমন: ব্যথা, ব্যথিত, ব্যথী।
ব্যতিক্রম: /বি-/ উপসর্গযোগে গঠিত নয় এমন কিছু শব্দের বানানে /ব্যা/ দেখা যয়। যেমন: ব্যাঘ্র, ব্যাঙ, ব্যাজস্তুতি, ব্যাটা, ব্যাধ, ব্যামো, ব্যারাম, ব্যাস ইত্যাদি।
৩. বিদেশি শব্দের বানানে অবিকল্প /ব্যা/:
বিদেশি শব্দের বানানে অবিকল্প /ব্যা/ হয়, /ব্য/ হয় না। যেমন: ব্যাংক, ব্যাগ, ব্যাজ, ব্যাট, ব্যাটারি, ব্যাডমিন্টন, ব্যান্ড, ব্যান্ডেজ, ব্যাপটিস্ট, ব্যানার, ব্যারাক, ব্যারিস্টার, ব্যালট, ব্যালে, ম্যাগাজিন, ম্যান, ফ্যান, ক্যালসিয়াম ইত্যাদি।
মনে রাখুন: ব্যবহারিক শব্দের বানানে /ব্যা/ ও /ব্য/ দুটিই শুদ্ধ। একসময় অভিধানে দুটো শব্দই ভুক্তি হিসেবে ছিল। যেমন: ব্যবহারিক, ব্যাবহারিক। তবে, ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানে একমাত্র ‘ব্যাবহারিক’ বানানকে ভুক্ত করা হয়েছে। ‘ব্যবহারিক’ বানানকে স্থানই দেওয়া হয়নি।
সূত্র: ব্যাবহারিক প্রমিত বাংলা বানান সমগ্র, ড. মোহাম্মদ আমীন, পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.
১০১. উপলক্ষ বনাম উপলক্ষ্য
উপলক্ষ্য = উপ + লক্ষ্য; লক্ষ্য এর উপ বা সহকারী যে; আশ্রয়, অবলম্বন, প্রয়োজন, উদ্দেশ্য, অভিপ্রায়, ব্যাপদেশ, ছল, ছুতা, occasion বা আয়োজন অর্থে প্রচলিত।
উদ্দেশ্য ও উদ্দেশ শব্দের মতো লক্ষ, লক্ষ্য, উপলক্ষ ও উপলক্ষ্য শব্দের বানান ও প্রয়োগ নিয়েও বিভ্রাট দেখা যায়। প্রকৃতপক্ষে ‘চক্ষু বা মনশ্চক্ষুর’ দ্বারা কোনও কোনও বস্তু বা বিষয়কে নিজের মধ্যে নেওয়া বা লওয়ার কাজটি দিশাগ্রস্ত থাকে যাতে, তাকে লক্ষ বলা হয়। এ লক্ষ যাতে থাকে সেটিই হচ্ছে লক্ষ্য।
কলিম খান ও রবি চক্রবর্তীর মতে, বাংলায় দর্শন করাকে কিছুটা পরিবর্তন করে যে যুক্তিতে ‘ দেখা’ করা করে নেওয়া হয়েছে, একই যুক্তিতে লক্ষ করাকে ‘লখ’ বা ‘লখি’ করে নেওয়া হয়েছে। এই ‘খ’ প্রকৃতপক্ষে ‘ক্ষ’-এর একটি রূপ। দর্শন দিশগ্রস্ত হয়ে গেলে তাকে ‘ দেক্ষা’ বলাই যুক্তিসঙ্গত। সে সুবাদে চক্ষু বা মনশ্চক্ষু মারফত নিয়ে আসা হল ‘লক্ষ’; এবং সে লক্ষ করা বস্তু বা বিষয়টি বাস্তবে যেখানে রয়েছে, সেটি লক্ষ্য।
সংগতকারণে উপলক্ষ ও উপলক্ষ্য ভিন্ন অর্থ ধারণ করে। উপলক্ষ হচ্ছে লক্ষ এর সহকারী অন্যদিকে উপলক্ষ্য হচ্ছে লক্ষ্য এর সহকারী। লক্ষ্য থাকলেই উপলক্ষ্য থাকতে পারে কিন্তু লক্ষ থাকলে উপলক্ষের সম্ভবান খুবই ক্ষীণ। সে কারণে উপলক্ষ শব্দটির প্রয়োগ প্রায়শ ত্রুটিপূর্ণ হয়।
বাংলাভাষীগণ শব্দটি যেভাবে প্রয়োগ করেন, তার অধিকাংশ ক্ষেত্রে শব্দটি আসলে ‘উপলক্ষ্য’কেই বোঝায়; ভুল বানানের কারণে সেগুলো ‘য’ফলাহীন হয়ে রয়েছে।
১০২. অনুসরণ বনাম অনুকরণ
অনেক ক্ষেত্রে ‘অনুসরণ’ ও ‘অনুকরণ’ শব্দ দুটিকে সমার্থক হিসেবে ব্যবহার করা যায়। তবে শব্দ দুটির বিশদ ব্যবহারে কিছুটা পার্থ্যক্য রয়েছে। অনুকরণ হচ্ছে ‘অনুরূপ-করণ’। সাধারণত কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যে রকম কাজ কাজ করে, ঠিক একই রকম কাজ করাই হচ্ছে অনুকরণ। অর্থাৎ, ‘নকল’ বা ‘সদৃশীকরণ’ অর্থে ‘অনুকরণ’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়। অনুকরণ করা ভালো নয়। এটি নেতিবাচকভাবে দেখা হয়। পরীক্ষার হলে কারও খাতা দেখে অবিকল বা প্রায় অবিকল লেখা অনুকরণের পর্যায়ে পড়ে।
আবার, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যে চিন্তা-চেতনা নিয়ে কাজ করে, সেই চিন্তা-চেতনা অনুকরণ করাই হচ্ছে ‘অনুসরণ’। অনুসরণ, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক দিয়েও কিছুটা ব্যাখ্যা করা যায়। ‘অনুগমন’ অর্থে ‘অনুসরণ’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়। অনুসরণ, চিন্তার সঙ্গে নতুন চিন্তা যুক্ত করে। তাই এটি ইতিবাচক। মহাজ্ঞানী মহাজন যে পথে করেছে গমন – – -। এটি অনুসরণ।
১০৩. অঙ্ক বা সংখ্যার পর ম য় র্থ ষ্ঠ শ তম প্রভৃতি বসে কেন?
সংখ্যার পূরকে কোনোটির পর ম (১ম), কোনোটির পর য় (২য়), কোনোটির পর র্থ (৪র্থ), কোনোটির পর শ (২০শ) আবার কোনোটির পর তম (৮৭তম) প্রভৃতি বর্ণ বা যুক্তব্যঞ্জন বসে। কিন্তু কেন বসে? এ বর্ণচিহ্নগুলো হচ্ছে অঙ্ক বা সংখ্যার পূরক নামের সংক্ষিপ্ত রূপ। বিষয়টি নিচে ব্যাখ্যা করা হলো?
১ ২ ৩ ৪ ৫ ৬ ৭ ৮ ৯ ১০ ১১ ১৮ ৩০ ৪০ ৪৮ ৪৯ ৫০ ৫৯ ৯০ ৯৩ ১০০ ১০০০ – প্রভৃতি হচ্ছে সংখ্যা। এসব সংখ্যার পূরক হলো যথাক্রমে— প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয় চতুর্থ পঞ্চম ষষ্ঠ সপ্তম অষ্টম নবম দশম একাদশ অষ্টাবিংশ ত্রিংশ চত্বারিংশ অষ্টচত্বারিংশ ঊনপঞ্চাশত্তম পঞ্চাশত্তম ঊনষষ্টিতম নবতিতম ত্রিনবতিতম শততম এবং সহস্রতম। এই পূরকসমূহের সংক্ষিপ্ত রূপ যথাক্রমে— ১ম ২য় ৩য় ৪র্থ ৫ম ৬ষ্ঠ ৭ম ৮ম ৯ম ১০ম ১১শ ১৮শ ৩০শ ৪০শ ৪৮শ ৪৯তম ৫০তম ৫৯তম ৯০তম ৯৩তম ১০০তম ১০০০তম। সংখ্যার সঙ্গে পূরকের পূর্ণ নামের শেষ অংশটি দিয়ে সংক্ষিপ্ত পূরক লেখা হয়। যেমন?
১ প্রথম (১ম)
২ দ্বিতীয় (২য়)
৪ চতুর্থ (৪র্থ)
৫ পঞ্চম (৫)ম
৬ ষষ্ঠ (৬ষ্ঠ)
১১ একাদশ (১১শ)
৩০ ত্রিংশ (৩০শ)
৫৯ ঊনষষ্টিতম (৫৯তম)
১০০০ সহস্রতম (১০০০তম)
৪৯ ঊপঞ্চাশত্তম>ঊনপঞ্চাশত্তম (৪৯তম)
১০৪.হিম্মত
হিম্মত আরবি উৎসের শব্দ। আগে শব্দটির বানানে খণ্ড-ৎ ছিল। বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানে আস্ত-ত দিয়ে প্রমিত নির্দেশ করা হয়েছে। বাক্যে সাধারণভাবে বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত হিম্মত অর্থ— সাহস, মনোবল; ক্ষমতা, শক্তি, বীরত্ব।
সাহস, মনোবল:
দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, ভূলিতেছে মাঝি পথ,
ছিঁড়িয়াছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মৎ? (নজরুল)
ক্ষমতা, শক্তি, বীরত্ব:
হিম্মত দেখানোর আগে হিম্মত সঞ্চয় করো। হিম্মত যার কিসমত তার।
১০৫. হতশ্রী: হতভাগা হতাস্মি হত আছে যত
হত ও শ্রী যুক্ত হয়ে হতশ্রী। বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানমতে, হত (√হন্+ত) অর্থ— (বিশেষণে) মৃত, নিহত। ব্যাহত,, বাধাপ্রাপ্ত। লুপ্ত (হতগৌরব)। অশুভ, মন্দ (হতভাগা) প্রভৃতি।
কোনো বিষয় হত, লুপ্ত, আহত, ব্যাহত বা বাধাপ্রাপ্ত, দুর্দশাগ্রস্ত, নষ্ট, ধ্বংস হয়েছে কিংবা হ্রাস পেয়েছে বা অপমানিত হয়েছে প্রভৃতি প্রকাশ করার জন্য শব্দের আগে হত যুক্ত করা হয়। যেমন: হতগৌরব (গৌরব ধূলিসাৎ হয়েছে এমন), হতচকিত (হতভম্ব), হতচেতন (অচেতন, অজ্ঞান), হতচ্ছাড়া (দুর্দশাগ্রস্ত), হতজীব (প্রাণহীন, মৃত), হতজ্ঞান (অচেতন, হতচেতন), হতত্রপ (নির্লজ্জ, বেহায়া), হতদরিদ্র, হতধী (বুদ্ধিহীন, বুদ্ধিহারা), হতপ্রভ (নিষ্প্রভ, ম্লান), হতপ্রায় (মুমূর্ষু, মৃতপ্রায়), হতবল (দুর্বল), হতবাক (নির্বাক, বিস্মিত), হতবুদ্ধি (হতভম্ব), হতভাগা (মন্দভাগ্য), হতমান (অপমানিত, অপদস্থ), হতমূর্খ (মহামূর্খ), হতলক্ষ্মী (লক্ষ্মীছাড়া), হতশ্রদ্ধ (শ্রদ্ধাহীন, বীতশ্রদ্ধ), হতশ্রী (শ্রীহীন, হতভ্যাগ্য, লক্ষ্মীছাড়া, সম্পদহীন), হতাদর (অনাদৃত, অনাদর, অমর্যাদা), হতাশা (হত+আশা), হতাশ্বাস (আশা-প্রত্যাশা লুপ্ত হয়েছে এমন), হতাস্মি [(হত+অস্মি); অর্থ: আমি মরে গেলাম, আমি শেষ হয়ে গেলাম এরূপ খেদোক্তি] প্রভৃতি হত দিয়ে গঠিত কয়েকটি শব্দ।
এত হত থেকে হওয়া শব্দকে মুক্ত রাখার জন্য হওয়া অর্থ প্রকাশ করার জন্য ব্যবহৃত শব্দের বানানে ত-য়ে ও-কার দিতে হয়। যেমন:
তেমন যদি হতো
ইচ্ছে হলে আমি হতাম ধানের গোলার মতো।
১০৬. বুদ্ধিজীবি নয়, বুদ্ধিজীবী
গতকাল (১৪ই ডিসেম্বর) গেল শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস। অনেকে লিখেছেন— বুদ্ধিজীবি । শুদ্ধ হচ্ছে— বুদ্ধিজীবী। যে-কোনো জীবী দুটো ঈ-কার নিয়ে চলে। যেমন: মৎস্যজীবী, শ্রমজীবী, চিকিৎসাজীবী, কৃষিজীবী – – -। জীবি কখনো শুদ্ধ নয়। মনে রাখুন, √জীব+ইন্= জীবী। -জীবী ইন্-প্রত্যয়ন্ত শব্দ। ইন্ প্রত্যয়ান্ত শব্দে ইন্-এর পরিবর্তে ঈ-কার হয়।
সূত্র: ব্যাবহারিক প্রমিত বাংলা বানান সমগ্র, ড. মোহাম্মদ আমীন, পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.
সূত্র: