শুবাচ প্রায়োগিক বাংলা ও সাধারণ জ্ঞান

১২১. মাইকেলি ধাতু  ( এবি ছিদ্দিক)

ব্যাকরণের আলোচনায় বাংলা ধাতুগণের নির্দিষ্ট শ্রেণিভাগ রয়েছে। কর্, মার, মিটা, উঠ্, লিখ্, মুচড়া, চাহ্, খা, শু, হ প্রভৃতি সেসব ধাতুগণের কয়েকটি। এসব ধাতুর সঙ্গে কাল ও পুরুষ অনুসারে বিভক্তি (প্রত্যয়) যুক্ত করে বাক্যে ক্রিয়াপদ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বাংলা ভাষায় এই নির্দিষ্ট ধাতুশ্রেণির বাইরে আরও একপ্রকার ধাতু রয়েছে, যা ‘মাইকেলি ধাতু’ নামে পরিচিত। মাইকেল মধুসূদন দত্ত এধরনের ধাতুর ব্যবহার প্রচলন করেন বলে তাঁর নামানুসারে এরূপ নামকরণ করা হয়েছে। মাইকেলি ধাতু প্রকৃতপক্ষে কোনো ধাতু নয়, মূলত এগুলো কতিপয় বিশেষ্য ও বিশেষণ। মাইকেল মধুসূদন দত্ত সেসব বিশেষ্য-বিশেষণের সঙ্গে ধাতুর অনুকরণে কাল ও পুরুষ অনুসারে বিভক্তি যুক্ত করে ক্রিয়াপদ হিসেবে ব্যবহার করেছেন বলে এধরনের শব্দ ‘মাইকেলি ধাতু’ তকমা পেয়ে গিয়েছে। পবিত্র থেকে পবিত্রি (পবিত্র করি), লক্ষ থেকে লক্ষি (লক্ষ করি/করে), উত্তর থেকে উত্তরিলা (উত্তর দিল/দিলো), ইচ্ছা থেকে ইচ্ছি (ইচ্ছে /করি/করে/হচ্ছে) প্রভৃতি এই শ্রেণিভাগের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। নিম্নে মাইকেল মধুসূদন দত্তের “বিভীষণের প্রতি মেঘনাদ” থেকে দুইটি পঙ্‌ক্তি উদ্ধৃত করা হলো, যেখানে শব্দের এরূপ প্রয়োগ ঘটানো হয়েছে—
১. ‘… উত্তরিলা কাতরে রাবণি;—
“হে পিতৃব্য, তব বাক্যে ইচ্ছি মরিবারে! …” ‘
২. ‘… উত্তরিলা রথী
রাবণ-অনুজ, লক্ষি রাবণ-আত্মজে; …’
 
১২২. বিশেষণ,  দূরে রাখুন সর্বক্ষণ
কোনও পদের পূর্বে বিশেষণ বসানো প্রয়োজন হলে কাঙ্ক্ষিত বিশেষণটি পরবর্তী পদের সঙ্গে যুক্ত না -হয়ে পৃথক বসানো বিধেয়। যেমন – নীল আকাশ, লাল শাড়ি, পাকা বাড়ি ইত্যাদি। তবে বিশেষের সঙ্গে যে বিশেষণ বসানো হয় তার কোনও বিশেষণ থাকলে পদ দুটো সেঁটে বসে। যেমন – বিশ্বসুন্দরী, কৃষ্ণকালো, রক্তলাল ইত্যাদি।
 
১২৩. সুগন্ধি বনাম সুগন্ধী
 
সুগন্ধি (সুগন্ধ+ই) অর্থ—  (বিশেষণে) মধুর গন্ধ বিশিষ্ট। সুবাসিত (সুগন্ধি ফুল)। অন্যদিকে, সংস্কৃত সুগন্ধী (সুগন্ধ+ইন্) অর্থ—   (বিশেষণে) মধুর গন্ধ বহন করে এমন। যেমন, সুগন্ধী বায়ু, সুগন্ধী জল।

১২৪. ফতুর

ফতুর’ শব্দের আভিধানিক অর্থ— রিক্ত, নিঃশেষ, শূন্য, নিঃস্ব, অসহায় প্রভৃতি। এটি আরবি শব্দ। আরবি ‘ফুতুর’ থেকে বাংলা ‘ফতুর’ শব্দের উদ্ভব। আরবি ‘ফুতুর’ শব্দের প্রয়োগ ও অর্থ দুটোই শরীর-সম্পর্কিত। আরবি ভাষায় শব্দটির অর্থ—দুর্বলতা, অবসন্নতা, অলসতা, আলস্য, নির্জীবতা প্রভৃতি। বাংলায় ‘ফতুর’ শব্দটির প্রয়োগ ও অর্থ শুধু শরীর সম্পর্কিত নয়। পার্থিব সম্পদ সম্পর্কিত নিঃস্বতা প্রকাশে এর অধিক প্রয়োগ দেখা যায়। আরবি ‘ফুতুর’ শব্দের প্রসঙ্গে শরীর দুর্বল হলে যেমন মানুষের সবকিছুতে অসহায়ত্বের সূচনা ঘটে, তেমিন বাংলা ‘ফতুর’ শব্দের প্রসঙ্গে সহায়-সম্পদে ব্যক্তিবিশেষ রিক্ত হলে তার সবকিছুতে অসহায়ত্বের অনুপ্রবেশ দেখা যায়। তাই ‘ফতুর’ শব্দটি আরবি ভাষা হতে বাংলায় মেহমান হয়ে এলেও তার বাহ্যিক কিংবা অন্তর্নিহিত কোনো অর্থের বিপর্যয় ঘটায়নি।
 
১২৫. অনিওম্যানিয়া: ক্রয়োন্মত্ততা বা ক্রয়োন্মাদনা

ইংরেজি অভিধানমতে, অনিওম্যানিয়া অর্থ— An uncontrollable desire to buy things. অর্থাৎ, দ্রব্যাদি ক্রয়ের লাগামহীন বাতিক,

ড. মোহাম্মদ আমীন

অত্যধিক ক্রয়াসক্তি। চিকিৎসা বিজ্ঞানে এটি একটি মারাত্মক রোগ হিসেবে চিহ্নিত। যাদের এমন বাতিক রয়েছে বা যারা এই বাতিকে আক্রান্ত তাদের বলা হয় Oniomaniac, বাংলায় বলা যায়: ক্রয়োন্মাদ। প্রয়োজন থাক বা না থাক যা দেখে তা কেনার জন্য উন্মাদ হয়ে যাওয়া— এ রোগের অন্যতম লক্ষণ। এই উন্মত্ততা এত প্রবল যে, রোধ করা সম্ভব হয় না। ক্রয়োন্মাদদের জীবনের অধিকাংশই কাটে বাজারে-বাজারে।তাদের ক্রয়-ইচ্ছায় বাধা দিলে সৃষ্টি হয় সংঘর্ষ।

পুরুষের চেয়ে নারীদের মধ্যে এমন রোগী বেশি দেখা যায়। এটি প্রথমে শরীরকে আঘাত করে না, মনকে আঘাত করে। ক্রমশ ক্রয়োন্মত্ততা এমন জটিল পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে, ক্রয় করতে না পারলে শারীরিকভাবেও দুর্বল হয়ে পারে। যার স্ত্রী-কন্যা এই রোগে আক্রান্ত তার চেয়ে দুর্বিষহ জীবন আর হতে পারে না। ক্রয়োন্মাদরা সংসার ও নিজেকে আর্থিক এবং মানসিকভাবে ফতুর করে দেয়। এদের নিয়ে কোথাও বের হওয়া যায় না। শুধু কিনতে চায় আর কিনতে চায়। অনেকে এ রোগ হতে বাঁচার জন্য ঘুম আসে এমন কিছু খেয়ে ঘুমানোর অভ্যাস রপ্ত করার চেষ্টা করে। এমন অনেক লোক আছে যারা এই রোগে এত বেশি আক্রান্ত যে, সারাদিন বিভিন্ন মার্কেটে-মার্কেটে ঘুরাঘুরি করে  এবং রাতের বেলা বাসায় ফিরে কী ক্রয় করা হলো তা দেখে। রাত কাটতে না কাটতে তাদের আবার ক্রয়েচ্ছা জেগে উঠে। ভোর হতে না হতে আবার প্রস্তুতি নেয় মার্কেটে যাওয়ার।

১২৬. জোড়া ডিম্ব এবং বিসর্গমুক্ত প্রাতরাশ
 
হরি ঠাকুর প্রাতরাশ বানানে বিসর্গ (ঃ) দেন না কেন?
হরি ঠাকুর প্রাতঃসন্ধ্যা সম্পন্ন করে বাজার থেকে দুটো ডিম এনেছিলেন। পরদিন প্রাতঃকালে প্রাতঃক্রিয়া ও প্রাতঃস্নান সেরে প্রাতঃস্মরণীয়দের প্রাতঃপ্রণাম করে নাশতার টেবিলে বসে দুটো ডিমই খেয়ে ফেললেন। জোড়া ডিম নেই বলে প্রাতরাশ বানানে বিসর্গ দিতে পারলেন না। না-থাকলে দেবেন কীভাবে?
 
১২৭. উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী

লেখক, শিশুসাহিত্যিক, বাংলা ছাপাখানার অগ্রপথিক, চিত্রকর, প্রকাশক, শখের জ্যোতির্বিদ, বেহালাবাদক  এবং সুরকার উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ১৮৬৩ খ্রিষ্টাব্দের ১২ই মে মোতাবেক ১২৭০ বঙ্গাব্দের ২৭শে বৈশাখ কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদি উপজেলার মসূয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা কালিনাথ রায় ছিলেন আরবি, ফারসি ও সংস্কৃতে সুপণ্ডিত। পিতার ডাকনাম শ্যামসুন্দর মুন্সী। উপেন্দ্রকিশোর শ্যামসুন্দর মুন্সীর আট সন্তানের তৃতীয় পুত্রসন্তান। তাঁর পৈতৃক নাম  কামদারঞ্জন রায়। চার বছর বয়সে তাঁর পিতার অপুত্রক আত্মীয় জমিদার হরিকিশোর রায়চৌধুরী তাঁকে দত্তক নিয়ে  নতুন নাম দেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী।  উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী বাংলা সাহিত্যে জনপ্রিয় একটি নাম। তিনি সাহিত্যিক সুকুমার রায়ের পিতা এবং বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের ঠাকুরদা।  উপেন্দ্র কিশোর রায়চৌধুরী  ছিলেন সন্দেশ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা। গুপি-গাইন-বাঘা-বাইন, টুনটুনির বই ইত্যাদি উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর কালজয়ী সাহিত্যকর্ম। ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দের ২০শে ডিসেম্বর বাহান্ন বছর বয়সে মারা যান।

১২৮. বিধবা বনাম বিপত্নীক:

বিধবা: বিধ্ব+আ= বিধবা।  বৈয়াকরণ জ্যোতিভূষণ চাকী তাঁর ‘বাগর্থ কৌতুক’ গ্রন্থে (পৃষ্ঠা ২৩, চতুর্থ মুদ্রণ, জানুয়ারি ২০১৩) লিখেছেন, শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ — “যার কোনো পুরুষ বন্ধু নেই।“ অর্থাৎ, যার কোনো পুরুষ বন্ধু নেই— নর হোক বা নারী হোক সেই বিধবা। সে হিসেবে, কোনো পুরুষ লোকের যদি কোনো পুরুষ বন্ধু না-থাকে তাকেও বিধবা বলা যায়। পুরুষ বন্ধুহীন মানুষকে নির্দেশ করার জন্যই ‘বিধবা’ শব্দটির জন্ম হয়েছিল। পুরুষের পুরুষ বন্ধু থাকবে না—এমন ঘটনা বর্তমান কালের মতো আগেও ছিল বিরল। তাই শব্দটির উৎসার্থে ব্যবহার ক্রমশ কমে আসতে থাকে। ফলে ‘বিধবা’ নিশ্চিহ্ন হওয়ার প্রান্তে চলে যায়। এমন একটি সুন্দর শব্দকে মৃত্যু হতে বাঁচানোর জন্য বৈয়াকরণগণ বিধবা শব্দের নতুন অর্থ নির্ধারণ করার চেষ্টা করলেন। তারা দেখলেন— পুরুষ মানুষের পুরুষ বন্ধু না-থাকার ঘটনা বিরল, কিন্তু নারী মানুষের পুরুষ বন্ধু না-থাকার ঘটনা প্রচুর। অর্থাৎ পুরুষ বন্ধুহীনের ঘটনা সাধারণত নারীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এবং পুরুষের ক্ষেত্রে তা একটি ব্যতিক্রম। তাই বিধবা শব্দের অর্থ হয়ে যায় পুরুষ বন্ধুহীন নারী। যা নিত্য স্ত্রীবাচক। বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানমতে, বাক্যে বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত সংস্কৃত বিধবা (বিধব+আ) অর্থ— যে নারীর ধব বা স্বামী মৃত এবং বিশেষণে পতিহীনা। 

বিপত্নীক: বাক্যে বিশেষণ হিসেবে ব্যবহৃত সংস্কৃত বিপত্নীক (বিপত্নী+ক) শব্দের মুখ্য অর্থ—  (১) পত্নী নেই এমন এবং গৌণার্থ (২) মৃতদার। শব্দটির আদি অর্থ ছিল:  পত্নী নেই এমন।  এখানে নেই কথাটি  “পত্নী জীবিত আছে কিন্তু বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে” অর্থ প্রকাশে ব্যবহৃত হতো। পরবর্তীকালে  গৌণার্থে পত্নী মারা গেছে অর্থও প্রকাশেও বিপত্নীক শব্দটির ব্যবহার শুরু হয়।  

বিধবা হচ্ছে বিশেষ্য এবং বিপত্নীক হচ্ছে বিশেষণ।  বিধবা শব্দটি উৎস অর্থ বিবেচনায় নিত্য স্ত্রীবাচক ছিল। অধিকন্তু, যেহেতু উৎসকালে বিধবা ও বিপত্নীক শব্দের অর্থ পদ এবং লৈঙ্গিক বিশ্লেষণে সম্পূর্ণ বিপরীতার্থক ছিল না, তাই বিধবা শব্দটিকে বিপত্নীক শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ হিসেবে চিহ্নিত না-করে সংস্কৃত ব্যাকরণে নিত্য স্ত্রীলিঙ্গ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

১২৯. মৃতদার ও বিধবা

স্বামীর মৃত্যু হলে ওই মৃত স্বামীর স্ত্রী বা স্ত্রীদের বলা হয় বিধবা। কিন্তু স্ত্রীর মৃত্যু হলেও মৃত স্ত্রীর স্বামীকে কেবল তখনই মৃতদার বলা যাবে, যখন যার স্ত্রী মারা গেছে তার আর কোনো স্ত্রী জীবিত বা বর্তমান না থাকে। কারণ মৃতদার অর্থ বিপত্নীক।
 
১৩০: 
 

— — — — — — — — — — — — — — — — — —  — — — — — — — — — — — — — —  — — — — — — —  — —

 
শুবাচ গ্রুপের লিংক: www.draminbd.com

 

Language
error: Content is protected !!