ড. মোহাম্মদ আমীন
১. বাংলা সাহিত্যের প্রথম যথার্থ ট্রাজেডি
ফারসি কবি জামির রচিত ‘লায়লী মজনু’ কাব্যের ভাবানুবাদ অবলম্বনে দৌলত উজির বাহরাম খান ১৫৬০ খ্রিষ্টাব্দ হতে ১৫৭৫ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে ‘লায়লী মজনু’ নামক যে কাব্যটি রচনা করেন সেটি বাংলা সাহিত্যের প্রথম যথার্থ ট্রাজেডি হিসেবে স্বীকৃত।
২. কয়েকজন কবির প্রথম কাব্য
ফররুখ আহমদের প্রথম কাব্য ‘সাত সাগরের মাঝি’ (১৯৪৫ খ্রি.)। আহসান হাবিবের প্রথম কাব্য ‘রাত্রি শেষ’ (১৯৬৪ খ্রি.)। আবুল হোসেনের প্রথম কাব্য ‘নববসন্ত (১৯৪২ খ্রি.)। সৈয়দ আলী আহসানের প্রথম কাব্য ‘মহাসচকিত’ (১৯৬৬ খ্রি.)। শামসুর রাহমানের প্রথম কাব্য ‘প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ (১৩৬৬বঙ্গাব্দ)। আল মাহমুদের প্রথম কাব্য ‘লোকলোকান্তরে’। মোহাম্মদ মনিরুজ্জমানের প্রথম কাব্য ‘দুর্লভ দিন’ (১৯৬১ খ্রি.)। বিহারী লালের প্রথম কাব্য ‘বঙ্গসুন্দরী’। অক্ষয় কুমার বড়ালের প্রথম কাব্য ‘প্রদীপ। রফিক আজাদের প্রথম কাব্য ‘অসম্ভবের পায়ে’ (১৯৭৩ খ্রি.) এবং দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের প্রথম কাব্য ‘আর্যগাঁথা’ যা ১৮৮২ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়।
৩. মার্সিয়া সাহিত্য
মার্সিয়া আরবি শব্দ। এর অর্থ শোক প্রকাশ করা। আরবি সাহিত্যে বিভিন্ন প্রকার শোকাবহ ঘটনা হতে মার্সিয়া সাহিত্যের উদ্ভব হলেও পরবর্তীকালে কারবালা প্রান্তরে শহিদ ইমাম হোসেন ও তাঁর পরিবারবর্গের আত্মাহুতির হৃদয়বিদারক ঘটনা মার্সিয়া সাহিত্যের অন্যতম উপজীব্য হয়ে যায়। মার্সিয়া সাহিত্য রচয়িতাদের মধ্যে মোগল আমলে দৌলত উজির বাহরাম খান, মুহম্মদ খান, হায়াত মামুদ, জাফর, হামিদ, ইংরেজ আমলের হামিদুল্লাহ খান, গরীবুল্লাহ, রাধারমণ গোপ, মীর মশাররফ হোসেন, কায়কোবাদ প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। জারি গান মার্সিয়া সাহিত্যের একটি বিশেষ লোকরূপ। মার্সিয়া সাহিত্যের প্রথম গদ্যগ্রন্থ মীর মশাররফ হোসেনের বিষাদ সিন্ধু।
৪. হারামনি
হারামনি একটি লোকসংগীত সংকলন। প্রখ্যাত লোকসংগীত সংগ্রাহক মুহম্মদ মনসুর উদ্দিন (৩১শে জানুয়ারি, ১৯০৪ – ১৯শে সেপ্টেম্বর, ১৯৮৭) সংগৃহীত এবং একাদশ খণ্ডে প্রকাশিত অজস্র লোকসংগীতের সমন্বয়ে ‘হারামনি’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। হারামনি বাংলা সাহিত্যে লোকসংগীতের একটি বিখ্যাত দলিল। রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে তিনি লোকসংগীত সংগ্রহের প্রেরণা পেয়েছিলেন।আহমদ শরীফের ভাষায়: নব যৌবনে রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্য ও অবনীন্দ্রনাথের আদরপুষ্ট হয়েছিলেন (মুহম্মদ মনসুর উদ্দিন)।
মুহম্মদ মনসুর উদ্দিন ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে সাহিত্যে বাংলা একাডেমি পুরস্কার, ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দে স্বাধীনতা পুরস্কার এবং শিক্ষায় অবদানের জন্য ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে একুশে পদক লাভ করেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইন্ডিয়ান ভার্নাকুলার্স বিষয়ে প্রথম শ্রেণিতে তৃতীয় স্থান অধিকার করে এমএ পাস করেন। তাঁর আগে কোনো মুসলিম ছাত্র প্রথম শ্রেণি পাননি। জন্ম: পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার মুরারিপুর গ্রাম।
৫. বাংলা গীতি কবিতার ভোরের পাখি
বিহারীলাল চক্রবর্তী (১৮৩৫-১৮৯৪ খ্রিষ্টাব্দ) বাংলা সাহিত্যের গীতি কবিতার প্রবর্তক। তাঁকে বাংলা গীতি কবিতার ভোরের পাখি বলা হয়। তিনি বাংলা সাহিত্যের প্রথম ‘বিশুদ্ধকবি’ হিসেবেও খ্যাত। সঙ্গীতশতক (১৮৬২ খ্রিষ্টাব্দ ) বিহারীলাল চক্রবর্তীর প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ‘সারদামঙ্গল’ (১৮৭৯ খ্রিষ্টাব্দ) তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ কাব্য।
৬. স্বচেষ্টায় কাব্য রচনার পথিকৃৎ
কবি মরদন ‘নসীরনামা’ কাব্যের রচয়িতা। রোসাঙ্গরাজ শ্রীসুধর্মার রাজত্বকালে (১৬২২-১৬৩৮) তাঁর আবির্ভাব। রোসাঙ্গের কাঞ্চি নগরে কবি বসবাস করতেন। এটি রোসাঙ্গের প্রথম কাব্যগ্রন্থ, যেটি কোনো রাজ পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া কবির সচেষ্টায় রচিত হয়।
৭.
হেয়াত মামুদ
কবি হেয়াত মামুদ ১৬৯৩ খ্রিষ্টাব্দে রংপুর জেলার ঘোড়াঘাট উপজেলার ঝাড়বিশিলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। হেয়াত মামুদের পিতা শাহ কবীর ছিলেন ঘোড়াঘাট সরকারের দেওয়ান। হেয়াত মামুদ ছিলেন ওই সরকারের কাজি। শুবাচের প্রধান উপদেষ্টা হায়াৎ মামুদ মধ্যযুগের কবি হেয়াত মামুদের নাম থেকে তাঁর ছদ্মনাম হায়াৎ মামুদ ধারণ করেন। প্রসঙ্গত, হায়াৎ মামুদের আসল নাম মনিরুজ্জামান।
জঙ্গনামা (১৭২৩), সর্বভেদবাণী (১৭৩২), হিতজ্ঞানবাণী (১৭৫৩) এবং আম্বিয়াবাণী (১৭৫৮) হেয়াত মামুদের লেখা চারটি কাব্যগ্রন্থ।গ্রন্থসমূহে রংপুর অঞ্চলের ভাষা ও ভাষারীতির ব্যবহার করা হয়েছে।
১৭৬০ খ্রিষ্টাব্দে (অনুমান) তিনি মারা যান।প্রতিবছর ১৭ই ফেব্রুয়ারি ঝাড়বিশিলায় অবস্থিত কবির মাজার প্রাঙ্গণে তাঁর জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী পালন করা হয়। তাঁর সম্মানে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ভবনের নামকরণ করা হয়েছে কবি হেয়াত মামুদ ভবন। তাঁর একটি বিখ্যাত বাণী
”যার বিদ্যা নাই সে জানে না ভালো মন্দ,
শিরে দুই চক্ষু আছে তথাপি সে অন্ধ”।
সূত্র: বাংলা সাহিত্যের প্রথম ও প্রধান, ড. মোহাম্মদ আমীন।
বাকি অংশ: শুবাচ বিসিএস বাংলা/১
——————————————–