ড. মোহাম্মদ আমীন
‘শুভ রাত্রি’ কিন্তু ‘শুভ রাত’ নয় কেন?
‘শুভ’ ও ‘রাত্রি’ দুটোই তৎসম, কিন্তু ‘রাত্রি’ থেকে উদ্ভূত ‘রাত’ অতৎসম। তাই জাতচ্যুত অতৎসম ‘রাত’ শব্দকে সংস্কৃত ‘শুভ’ তার পাশে বসতে দেয় না— জাত যাওয়ার ভয়ে। এজন্য বলা হয় ‘শুভ রাত্রি’, ‘শুভরাত্রি’; বলা হয় না— ‘শুভ রাত’ বা ‘শুভরাত’। প্রথম প্রশ্ন— বাক্যে বা ভাষায় তৎসম শব্দের এমন অহংকারের কারণ কী? দ্বিতীয় প্রশ্ন— বাংলায় ‘শুভ রাত’ বা ‘শুভরাত’ বললে কী অসুবিধা হবে?
প্রথমে দেখা যাক ‘শুভ রাত্রি’ কিন্তু ‘শুভ রাত’ নয় কেন? এর প্রধান কারণ শব্দের জাতপ্রথা। সংস্কৃত ভাষা প্রবল জাত্যভিমান নিয়ে
সৃষ্ট ও পরিচালিত একটি ব্রাহ্মণ্য ভাষা। এ ভাষায় কেবল উচ্চবংশীয়দের প্রবেশাধিকার ছিল। বৈয়াকরণগণ সংস্কৃতকে এমনভাবে লালন করেছেন যাতে উচ্চবংশীয় সংস্কৃত ছাড়া নীচুজাত বলে কথিত কারও ভাষার সঙ্গে তার কোনো শব্দ না-মেশে। একসময় সংস্কৃত ভাষার কোনো কথা নীচুজাত বলে কথিত কেউ শুনে ফেললে কানে তার গরম সিসা ঢেলে দেওয়া হতো। কানে গরম সিসা যাওয়ার ভয়ে তৎসম বা সংস্কৃত কোনো শব্দ আজও বাংলায় এসেও সহজে অতৎসমের সঙ্গে মিশে না এবং মিশে সুখের শব্দবন্ধন বা বাক্য-সংসার রচনা করতে পারে না।

এবার দেখি বাংলায় বাংলায় ‘শুভ রাত’ বা ‘শুভরাত’ বললে কোনো অসুবিধা হবে কি না। না, কোনো অসুবিধা হবে না। কারণ, বাংলা সংস্কৃত ভাষ নয়, সংস্কৃত হতে আলাদা একটি সম্পূর্ণ নতুন ভাষা। কিন্তু আমাদের দীর্ঘকালের সংস্কার ও অভ্যস্ততা তা কি হতে দেবে সহজে? কান কি মেনে নেবে? কেমন কেমন লাগবে না শ্রবনে? তেমনি ‘শুভ সকাল’ বলা হয়, কিন্তু ‘শুভ ভোর’ বলা হয় না। কারণ ‘ভোর’ হিন্দি; মানে অতৎসম।
‘বাঘ’ ও ‘শার্দুল’ একই অর্থ বহন করে; তবু ‘বাঘের বাচ্চা’ হয় কিন্তু ‘শার্দুলের বাচ্চা’ হয় না। বলতে হয় শার্দুলশাবক। ‘মরা’ ও ‘শব’ অভিন্ন অর্থ-দ্যোতক। তারপরও ‘মড়া-পোড়ানো’ বলা যায় কিন্তু ‘শবপোড়ানো’ বলা যায় না বলতে হয়ে— শবদাহ। তেমনি বলা যায় না মরাদাহ। কারণটা একই।পানীয় জল বলা হয়, পানীয় পানি বলা হয় না।
————————————————————————
বাংলা বানান কোথায় কী লিখবেন এবং কেন লিখবেন/১
বাংলা বানান কোথায় কী লিখবেন এবং কেন লিখবেন
বাংলা ভাষার মজা, ড. মোহাম্মদ আমীন, পাঞ্জেরী পাবিলিকেশন্স লি.।