কীভাবে হলো দেশের নাম (এশিয়া)
ড. মোহাম্মদ আমীন
শ্রীলঙ্কা (Sri Lanka)
সংস্কৃত ভাষায় শ্রীলঙ্কা শব্দের অর্থ পবিত্র দ্বীপ (Holy Island)। সংস্কৃত শ্রী শব্দের অর্থ পবিত্র এবং লঙ্কা শব্দের অর্থ দ্বীপ। সুতরাং শ্রীলঙ্কা অর্থ পবিত্র দ্বীপ। ভারতীয় পুরাণমতে, লঙ্কা ছিল রামায়ণে বর্ণিত বিখ্যাত চরিত্র রাবনের রাজ্যের রাজধানী। এর প্রাচীন নাম ছিল সিলন। পালি শব্দ সিংহল থেকে সিলন নামের উৎপত্তি। পালি ভাষায় সিংহল শব্দের অর্থ ল্যান্ড অব দ্যা লায়ন বা সিংহের দেশ। আবার অনেকে বলেন সিংহল শব্দের অর্থ ব্লাড অব এ লায়ন। এখানে প্রকৃতপক্ষে সিংহ ছিল কিনা তা জানা যায় না। তবে এ দীপপূঞ্জের অধিবাসীরা ছিল সিংহের মতো শক্তিমান ও সাহসী। সিংহ থাকুক বা না থাকুক, শ্রীলঙ্কায় প্রচুর হাতি রয়েছে। এখনও শ্রীলঙ্কায় হাতির সংখ্যা ২০ হাজারের অধিক। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে শ্রীলঙ্কা বিভিন্ন নামে পরিচিত হয়ে আসছে। প্রাচীন গ্রিক ভূগোলবিদগণ একে তপ্রোবান এবং আরবরা সেরেনদীব বলত। ১৫০৫ খ্রিষ্টাব্দে পর্তুগিজরা এ দ্বীপে পৌঁছে নাম রাখে শেইলাও। যার ইংরেজি বানান Ceylon। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ব্রিটিশদের অধীনে থাকা অবস্থায় দেশটি এ নামেই পরিচিত ছিল। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ৪ ফেব্রুয়ারি দেশটি এ নামেই স্বাধীনতা অর্জন করে। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে নাম পরিবর্তন করে শ্রীলঙ্কা রাখা হয়।
রামায়ণ মহাভারতে শ্রীলঙ্কার কথা উল্লেখ আছে। শ্রীলঙ্কার ম্যাপ দেখতে অনেক মুক্তা বা চোখের জলের বিন্দুর মতো। তাই শ্রীলঙ্কাকে ভারত মহাসগরের মুক্তা বলা হয়ে থাকে। শ্রীলঙ্কার জাতীয় পতাকা পৃথিবীর প্রাচীনতম জাতীয় পতাকার অন্যতম। অনেকের মতে, এটিই পৃথিবীর প্রাচীনতম জাতীয় পতাকা। খ্রিষ্টপূর্ব ৪৮৬ খ্রিষ্টাব্দের শ্রীলঙ্কার প্রথম রাজা ভিজয়। তিনি ভারত থেকে এ দ্বীপে আসার সময় একটি সিংহচিহ্নিত পতাকা নিয়ে এসেছিলেন। এটিই হচ্ছে শ্রীলঙ্কার প্রথম পতাকা। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে পতাকাটাকে কিছুটা পরিবর্তন করে পুনরায় গ্রহণ করা হয়। শ্রীলঙ্কার সরকারি নাম ডেমোক্র্যাটিক সোসাইলিস্ট রিপাবলিক অব শ্রীলঙ্কা। এর রাজধানী জয়বর্ধানাপুর কুটি,কলম্বো নয়।
শ্রীলঙ্কার মোট আয়তন ৬৫,৬১০ বর্গকিলোমিটার বা ২৫,৩৩২ বর্গমাইল। যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম ভার্জিনিয়ার চেয়ে কিছুটা বড়। মোট আয়তনের ৪.৪% জলীয়ভাগ। ২০১২ খ্রিষ্টাব্দের হিসাবমতে মোট জনসংখ্যা ২,০২,৭৭,৫৯৭ এবং প্রতি বর্গকিলোমিটার জনসংখ্যা ৩২৩। আয়তন বিবেচনায় শ্রীলঙ্কা বিশ্বের ১২২-তম বৃহত্তম দেশ কিন্তু জনসংখ্যা বিবেচনায় ৫৭-তম। আবার জনসংখ্যার ঘনত্ব বিবেচনায় এটি পৃথিবীর ৪০-তম জনবহুল দেশ। ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের হিসাবমতে, শ্রীলঙ্কার জিডিপি (পিপিপি) ২৩৩.৬৩৭ বিলিয়ন ইউএস ডলার (৬০-তম) এবং মাথাপিছু আয় ১১,০৬৯ ইউএস ডলার (৯৯-তম)। অন্যদিকে জিডিপি নমিনাল ৮০.৫৯১ বিলিয়ন ইউএস ডলার (৬০-তম) এবং সে হিসাবে মাথাপিছু আয় ৩,৮১৮ ইউএস ডলার (১১৪-তম)। মুদ্রার নাম শ্রীলঙ্কান রুপি। শ্রীলঙ্কার অধিবাসীদের শ্রী লঙ্কান বলা হয়।
দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপ রাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা ভারতের দক্ষিণ উপকূল হতে ৩১ কিলোমিটার দুরে অবস্থিত। সরকারি নাম গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রী শ্রীলঙ্কা। এর প্রশাসনিক রাজধানীর নাম শ্রী জয়াবর্ধনপুর কোট এবং প্রধান শহর কলম্বো। প্রাচীনকাল থেকে শ্রীলঙ্কা বৌদ্ধ ধর্মাম্বলীদের তীর্থস্থান হিসাবে পরিচিত। সিংহলি সম্প্রদায় এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী। উত্তর-পূর্ব দিকের স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নিয়ে তামিল দেশের সর্ববৃহৎ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। অন্যান্য সম্প্রদায়ের মধ্যে মূর, বার্ঘের, কাফির, মালায় প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
সিংহলিজ এবং তামিল শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রীয় ভাষা। শতকরা ১০ ভাগ লোক ইংরেজিতে সার্বক্ষণিক কথা বলে। শিক্ষা, গবেষণা ও ব্যবসায়িক কাজে ইংরেজি ভাষার ব্যবহারের আধিক্য লক্ষ করা যায়। বার্ঘার সম্প্রদয়ের লোকজন পর্তুগিজ ও ডাচ ভাষা ভিন্ন উচ্চারণে বলে থাকে। অন্যদিকে মালয় সম্প্রদায়ের লোকজন মালয়ের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে। শ্রীলংকার ৭০% নাগরিক বৌদ্ধ, ১৫% হিন্দু ও ৭.৫% ইসলাম ধর্মাবলম্বী।
চিনামন, রাবার, সিলন চা প্রভৃতি রপ্তানির জন্য শ্রীলঙ্কা বিখ্যাত। ইংরেজ শাসনের সময় স্থাপিত আধুনিক সমুদ্রবন্দর শ্রীলঙ্কাকে বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তুলেছে। শ্রীলঙ্কা দক্ষিণ এশিয়ার সর্বোচ্চ মাথাপিছু আয়ের দেশ।
রাষ্ট্রপতি একাধারে রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকার-প্রধান। শ্রীলঙ্কা হচ্ছে পৃথিবীর প্রথম দেশ, যারা গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচনের মাধ্যমে মহিলা সরকার প্রধান নির্বাচিত করে। বিশ্বের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী শ্রীলঙ্কার শ্রীমাভো বন্দরনায়েকে। তিনি তিন মেয়াদের জন্য শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। বন্দরনায়েকের কন্যা চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা শ্রীলঙ্কার প্রথম মহিলা প্রেসিডেন্ট। তিনি পর পর দুইবার শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট ছিলেন।
হিন্দু পুরাণমতে, রামের শাসন আমলে ভারতের মূল ভূমি থেকে রাম সেতু নামে একটি সংযোগ ছিল। ভারতীয় পুরাণ রামায়নে উল্লেখ আছে যে, রাবন, রামের স্ত্রী সীতাকে অপহরণ করে শ্রীলঙ্কা নিয়ে এসেছিলেন। সীতাকে উদ্ধারে আসার জন্য রাম দক্ষিণ ভারত থেকে শ্রীলঙ্কা পর্যন্ত একটি সেতু নির্মাণ করেছিলেন। যা রাম-সেতু নামে পরিচিত। বিশ্বকর্মার পুত্র ছিলেন এ সেতু নির্মাণের প্রধান উপদেষ্টা ও প্রকৌশলী। শ্রীলঙ্কার জাতীয় পতাকার একপাশে চারটি সোনালি পাতা দ্বারা আবৃত সোনালি সিংহের ছবি রয়েছে। এটি বুড্ডিজমের প্রতীক। অন্যপাশে রয়েছে সবুজ ও কমলা রঙের দুটি আয়তাকার স্ট্রাইপ (ংঃৎরঢ়)। সবুজ ও কমলা স্ট্রাইপ যথাক্রমে ইসলাম ও হিন্দু ধর্মের প্রতীক। গৌতম বুদ্ধের দাঁতের পবিত্র স্মরণচিহ্ন শ্রীলঙ্কার ক্যান্ডি মন্দিরে সুরক্ষিত আছে।
শ্রীলঙ্কা পৃথিবীর বৃহত্তম চা রপ্তানিকারক দেশ। তাই শ্রীলঙ্কাকে চায়ের রাজধানী বলা হয়। তবে শ্রীলঙ্কা চায়ের চাষ শুরু হয় ১৮৬৭ খ্রিষ্টাব্দ থেকে। চা উৎপাদনের পূর্বে শ্রীলঙ্কা কফির জন্য বিখ্যাত ছিল। ১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দ হতে শ্রীলঙ্কা চা উৎপাদনের জন্য কফিকে তাড়িয়ে দেয়। ব্রিটিশরা চা, কফি ও কোকোনাট চাষের জন্য তামিলদের শ্রীলঙ্কা এনেছিল। বিখ্যাত লিপটন চায়েয় উৎসভূমি শ্রীলঙ্কা। লিপটন ছিল এ চা কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা। শুধু চা নয়, মসলার জন্যও শ্রীলঙ্কা পরিচিত। বিশ্ববিখ্যাত মসলা দারুচিনির (cinnamon) উৎসভূমি শ্রীলঙ্কা। মিশরীয়রা এটি প্রথম এটি আবিষ্কার করে। দারুচিনির জন্য শ্রীলঙ্কার একটি অংশকে দারুচিনি দ্বীপ বা দারুচিনির দেশ বলা হয়।
শ্রীলঙ্কানরা বেশ লম্বা নাম রাখে। তাদের নামে গড় শব্দ সংখ্যা ৫। তাদের অনেক উৎসব যেমন মারাত্মক তেমনি আকর্ষণীয়। কাথরাগামা উৎসবে অনেক শ্রীলঙ্কান সুই দ্বারা নিজেদের জিহ্বা ও শরীর বিদ্ধ করে। অনেকে আবার জলন্ত কয়লার ওপর হাঁটে।
শ্রীলঙ্কার অনুরাধাপুরে প্রচুর বানর দেখা যায়। এখানে ইউনেস্কো নির্ধারিত ৮টি ঐতিহ্য-স্থান রয়েছে। শ্রীলঙ্কায় কেবল একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর আছে। এ দেশের মোট তটরেখা ১৩৬৪০ কিলোমিটার। শ্রীলঙ্কানরা যখন কোনো কথায় সম্মতি প্রকাশ করে তখন তারা মাথাকে উপরে-নিচে করে না, বরং ডানে বামে করে। অন্য দেশের লোক তাই হ্যাঁ-কে মনে করতে পারে না এবং না-কে মনে করে বসতে পারে হ্যাঁ।
মৌরিতানিয়া (Mauritania) : ইতিহাস ও নামকরণ
মরক্কো (Morocco) : ইতিহাস ও নামকরণ
মরিশাস (Mauritius) : ইতিহাস ও নামকরণ
মোজাম্বিক (Mozambique): ইতিহাস ও নামকরণ
আফগানিস্তান (Afghanistan) : ইতিহাস ও নামকরণ
আযারবাইজান (Azerbaijan) : ইতিহাস ও নামকরণ
আর্মেনিয়া (Armenia) : ইতিহাস ও নামকরণ
সিঙ্গাপুর (Singapore) : ইতিহাস ও নামকরণ
সাউথ কোরিয়া (South Korea) : ইতিহাস ও নামকরণ
সূত্র: কীভাবে হলো দেশের নাম, ড. মোহাম্মদ আমীন, পুথিনিলয়, বাংলাবাজার, ঢাকা।