সন্ধি-বিভ্রাট
ড. মোহাম্মদ আমীন
একান্ত সন্নিহিত বা অব্যবহিত দুটি ধ্বনির মিলনকে সন্ধি বলে। ধ্বনি পরিবর্তনে সন্ধির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। শুধু ধ্বনি পরিবর্তনে নয়, ভাষার সৌন্দর্য ও শ্রুতিমধুরতা বাড়াতেও সন্ধি অনবদ্য ভূমিকা পালন করে। ভাষাকে শ্রুতিমধুর ও সৌন্দর্য বৃদ্ধি করাই সন্ধির কাজ। অতএব সন্ধি যদি কোনো শব্দকে শ্রুতিকটু বা দুরুচ্চার্য করে তোলে তাহলে সে সন্ধি করা আদৌ উচিত নয়।
যেমন : পিতৃ +আজ্ঞা, পিতৃ + ঋণ, প্রীতি + উপহার, নদী + উপকূল, স্ত্রী +আচার প্রভৃতি শব্দ সন্ধি করলে হয় যথাক্রমে : পিত্রাজ্ঞা,পিতৃৃণ, প্রীত্যুপহার, নদ্যুপকুল ও স্ত্র্যাচার। এগুলো দুরুচ্চার্য বলে বাংলা ভাষায় অচল। অনেকে সন্ধির এমন অপব্যবহার করেন যে, শব্দ শুধু দুরুচ্চার্য নয়, অনেক সময় লজ্জাকরও হয়ে ওঠে। তাই যে সব সন্নিহিত শব্দের সন্ধি শব্দের অর্থে অনর্থ ঘটায় সে সব সন্ধি কোনভাবে বিধেয় নয়। না-হলে কী অঘটন ঘটতে পারে দেখুন।
হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে মহেন্দ্রবীরাচ্বর্যম্শায়ের পুত্র অঞ্জন। মহেন্দ্রবীরাচ্বর্যম্শায় মানে মহেন্দ্র + বীর + আচার্য + মশায়। এটি তার নামের সন্ধি। সন্ধি-প্রীতির জন্য তিনি এলাকায় সন্ধ্ম্যানব ( সন্ধি + মানব) নামে প্রসিদ্ধ। পিতার স্বাস্থ্য-প্রতিবেদন আনার জন্য অঞ্জন ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল। মা সাবিত্রী অঞ্জনকে দেখে দৌড়ে আসেন।
সাবিত্রী : খোকা, ডাক্তার কী বলেছেন?
অঞ্জন : বেশ্যাখানা বাবার সব শেষ করে দিয়েছে। বেশ্যাখানা বন্ধ না-করলে বাবা বেশি দিন বাঁচবেন না।
আতঙ্কিত মা হতভম্ব হয়ে বললেন : কী বললি?
অঞ্জন : বেশ্যাখানা বাবার সব শেষ করে দিয়েছে।
সাবিত্রী : এমন কথা কে বলেছেন?
অঞ্জন : ডাক্তার বলেছেন, ‘অঞ্জন বেশ্যাখানা তোর বাবার কাল। বেশ্যাখানা বন্ধ করতে হবে। নইলে তোর বাবা বেশিদিন বাঁচবেন না।’
সাবিত্রী দৌড়ে মা-কালীর মূর্তির সামনে গিয়ে আছড়ে পড়েন : মা, আমি ভার্যাপদে পতিত, আমায় রক্ষা কর।
অঞ্জন : কী ভার্যাপদে পড়েছ তুমি, লোকে শুনলে কী বলবে!
সাবিত্রী : তোমার বাপ বেশ্যাখানায় গিয়ে পড়ে থাকেন, আমি ভার্যাপদে না পড়ে কোথায় পড়ব।
অঞ্জন : বেশ্যাখানা মানে বেশি + খানা, আমি সন্ধি করেছি।
সাবিত্রী : ভার্যাপদে মানে তো ভারি + বিপদে, তোমার সন্ধির কারণেই তো বাবা আমি ভার্যাপদে পড়েছি।
এদের কথার মাঝে বারান্দা থেকে সন্ধ্ম্যানব ডাক দেন : আমার তেষ্টা পেয়েছে। কে আছে জলদি পানিন্তেচান্তে বল ( পানি + আনাতে + চা + আনতে =পানিন্তেচান্তে)।
গৃহভৃত্য নিত্য বলল : বাবু একটু অপেক্ষা করুন, পানিচাসছে (পানি + চা +আসছে)।
সাবিত্রী ডাক দিল : নিত্য, তোমার বাবু কী করছেন?
নিত্য : চাখাচ্ছেন (চা + খাচ্ছেন)।
সাবত্রী : বুড়ো চাখত্খেতে (চা + খেতে + খেতে) মরবেন।
সন্ধ্ম্যানব নিত্যকে বললেন: বাজারে গিয়ে আজামলিচুক্লপান ও কচ্বাল্বাদা নিয়ে এসো।
ভৃত্য এমন আক্কেল গুড়ুম শব্দ শুনে বলল : এগুলো কী?
আজামলিচুক্লাপান = ‘আম + জাম + লিচু + কলা + পান ‘ এবং কচ্বাল্বাদা হচ্ছে ‘কচু +আলু +আদা। সন্ধি করেছি। সন্ধি না বুঝলে তোমাকে বিদায় হতে হবে।
নিত্য : বাব্বিশ্খ্ব (বাবু +শিখে +নেব)।
সন্ধ্ম্যানব : পান্তে (পান + আনতে) কিন্তু ভুলো না।
নিত্য : বাবু, আপনি পানে একটু আসক্ত।
মহেন্দ্রবীরাচ্বর্যম্শায় : একটু কেন, বেশ্যাসক্ত।
সাবিত্রী চিৎকার দিয়ে উঠেন : কী, তুমি বেশ্যাসক্ত! ডাক্তার তো ঠিকই বলেছেন, আপনাকে বেশ্যাখানা শেষ করে দিয়েছে।
সন্ধ্ম্যানব : বেশ্যাসক্ত মানে ‘বেশি + আসক্ত’। আমি পানে বেশি আসক্ত এটাই বলতে চেয়েছি বউ। তুমি সন্ধি না-বুঝলে আমার কী হবে গো।
সন্ধি নিয়ে রবীন্দ্রনাথকেও প্রবল সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে। মন + সাধ = মনঃসাধ। মথুরায় কবিতায় (কড়ি ও কোমল) রবীন্দ্রনাথ ‘মনঃসাধ’ শব্দের পরিবর্তে ‘মনোসাধ’ শব্দ ব্যবহার করেছিলেন। এটি ছিল ভুল সন্ধি, তাই শব্দটিও ছিল ভুল। তৎকালীন ‘মিঠেকড়া’ পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের এ ভুল সন্ধির সমালোচনা করে লেখা হয়েছিল :
একবার রাাধে রাধে ডাক্ বাঁশি মনোসাধে,
শুনে ব্যাকরণ কাঁদে হেন সন্ধি শুনি নাই।