সন্মিত্রা: ত্রয়োদশ পর্ব / ড. মোহাম্মদ আমীন
ভোর ছটায় ফ্লাইট।
রচনা যাবে লন্ডন, আমি বাংলাদেশ। মনটা খারাপ। সময় শেষ হয়ে আসছে ক্রমশ। এমন বিশুদ্ধ মেয়েগুলো এত তাড়াতাড়ি চোখের আড়াল হয়ে যাবে— কষ্ট লাগার কথা। কয়েকদিন থাকি, বিরক্তি আসুক, তারপর গেলে কী অসুবিধা হতো? হতো। চাওয়া ব্যক্তির ইচ্ছা, কিন্তু পাওয়া তার নিয়ন্ত্রণের বিষয় নয়। তাই মানুষ যা চায় সর্বদা তা পায় না।
রাতটা যদি আর শেষ না হতো! অনেক রাতের প্রার্থনা এমন হয়। এমন প্রার্থনীয় রাত যার জীবনে যত বেশি সে মনে হয় তত বেশি সুখী অথবা বিরহকাতরতার কারণে তত বেশি অস্থির থাকে। যেটাই হোক— এমন রাতই সবার কামনার হয়।
প্রমি, গাইতে জানো? জানতে চাইলাম।
একটু একটু।
একটা গান করো।
আপনার পছন্দের কোনো গান?
তোমার পছন্দমতো গাও। ঠিক মিলে যাবে আমার পছন্দে। তোমাদের মতো আমিও তোমাদের ভালোবেসে ফেলেছি। যা গাও তাই ভালো লাগবে। গান পেট ভরায় না, মন ভরায়। সুর মিষ্টি নয়, কৃষ্টি। তোমাদের রুচি আমার ইচ্ছায় একাকার হয়ে গেছে।
আমি আর মিশু একসঙ্গে গাইব। আমি মেয়ে, মিশু ছেলে।
গাও।
“এই পথ যদি না শেষ হয় তবে কেমন হতো তুমি বলো তো”- – -।
রচনা কণ্ঠ দিল তাদের সঙ্গে এবং সবাই।
আর একটা গাইতে বললাম।
গাইল— “নীল আকাশের নিচে এই পৃথিবী, আর পৃথিবীর পরে ওই নীল আকাশ, তুমি দেখেছ কী; আকাশ আকাশ, শুধু নীল ঘন নীল, নীল আকাশ – – -।”
“মুগ্ধ হলাম”, রচনা বলল, “ভাব্বার প্রিয় গানটা গাইলে, কিন্তু কীভাবে মিলে গেল?”
গানটির কথা নিয়ে গুনগুন করতে শুনেছি।
“বুদ্ধিমতী”, রচনা বলল, “এদিকে এসো, দুজনকে একটু আদর করে দিই।”
ম্যাম, মিশু বলল, আমাদের মতো সাধারণ ছাত্রীর সঙ্গে কী ফ্রেন্ডলি আচরণ করছেন। অথচ, আমাদের ইউনিভার্সিটির একজন লেকচারার, কী তুচ্ছ করে আমাদের!
এরা বোকা। তোমাদের অবহেলা করার শাস্তি পেতে হবে। তোমরা যখন লেকচারার থাকবে ওরা তখন থাকবে অথর্ব হাহাকার। আমার ঈর্ষা তোমরা, সব জুনিয়র— তোমরাই একদিন আমার নির্ভরক হবে।
আপনি খুব সাধারণ।
অথচ কত অসাধারণ, প্রমিতা বলল মিশুর পরপর।
অসাধারণ কী জানো? আমি বললাম।
কী?
জৌলুসময় সামর্থ্যের অধিকারী হয়েও সাধারণ জীবনযাপন। এর মধ্যে যে বিরল সুখ আর সৌন্দর্য রয়েছে তার সন্ধান পাওয়ার মতো অসাধারণত্ব আর কিছু হতে পারে না। তাই প্রকৃত অর্থে তোমাদের ম্যাম সাধারণ নয়— অসাধারণ। অসাধারণ বলেই তোমাদের, তাকে সাধারণ মনে হয়। অসাধারণের এই সাধারণ প্রকাশ যার ভেতর আছে তাকেই বলা মহির্মাণব। সাধারণ না হলে অসাধারণ হবে কীভাবে? সাধারণ-এর আগে কেবল একটি অ। তুমি সাধারণ বাদ দাও। তাহলে কী থাকে?
অ।
অ মানে অহংকারী, অপয়া, অসভ্য, অভদ্র, অশালীন, অস্পৃশ্য, অপাঙ্ক্তেয়, অমানুষ- – -। সাধারণত্ব যার মধ্যে নেই, সে একটা অ।
রচনা জিনিসপত্র গোছাতে শুরু করেছে। আমি বসে আছি নিশ্চিত। সে থাকলে গোছানোর ব্যাপারে আমার কোনো দায় থাকে না। আমার দ্বারা গোছানোর কাজ হয় না, গোছাতে গেলে আরও এলোমেলো হয়ে যায়। হাজার মন ওজন মাথায় নিয়ে হিমালয়ের শৃঙ্গ থেকে নেপালের কাঠমান্ডু পর্যন্ত দৌড়াদৌড়ি করার চেয়েও একটা ছোটো ব্যাগ গোছানো অনেক কষ্টের মনে হয়।
“ম্যাম, আমি সাহায্য করি?” প্রশ্নের কোনো উত্তরের প্রত্যাশা না করে প্রমিতা জিনিসপত্র গোছানোর কাজে লেগে গেল। তার সঙ্গে যোগ দিল অন্যরা।
“তোমরা আমার জিনিসগুলো গোছাতে থাক”, রচনা বলল, “আমি ভাব্বার লাগেজটা গুছিয়ে দিচ্ছি। তিনি একদম গোছাতে পারেন না। গোছাতে গেলে আরো এলোমেলো করে দেন।”
এজন্য তোমার ম্যাম বলে— “আমি গাধা। গাধা ঘোলা করে খায়।”
দীপালী বলল, স্যার, আসলে কি গাধা ঘোলা করে খায়?
কখনো না। গাধা সর্বদা বিশুদ্ধ জল পান করে। বিশুদ্ধ না-হলে এক বিন্দু জলও পান করে না। তৃষ্ণায় মরে গেলেও। সে তো আর মানুষের মতো এত দুর্বল জীব নয় যে, এক বেলা জল পান না-করলে মরে যাবে। পরিষ্কার জল সর্বদা বিশুদ্ধ হয় না। অনেক সময় বিষাক্তও হয়। কিন্তু একসময় মানুষ বুঝতে পারত না, কোন জল সত্যি সত্যি বিশুদ্ধ। সেসময় মানুষ বনেজঙ্গলে, বিশেষ করে গ্রীষ্মকালে বিশুদ্ধ জলের জন্য গাধার দিকে চেয়ে থাকত। দেখত— গাধা কোন জায়গা থেকে জল পান করছে। তারপর ছুটে যেত সে জলপানে। সংগ্রহ করতে নতুবা পান করতে।
তাহলে কেন বলে—গাধা ঘোলা করে খায়? জগদ্গৌরী বলল।
আরে বাবা, এমন দাবি তো গাধা করে না। এটি মানুষের কথা। গাধা তো আর মানুষ নয়। সে জল পান করার পর পায়ের চাপে মাটি ধ্বসে বা কাদা উঠে কিংবা অগভীরতার কারণে অনেক সময় জল কিছুটা ঘোলা হয়ে যেত। এটাই তো স্বাভাবিক, না কি? গাধা আসার পর ছুটে যেত মানুষ বিশুদ্ধ জলের জন্য গাধার জায়গায়। গিয়ে মাঝে মাঝে দেখত—জল ঘোলা। বোকা মানুষ মনে করত— গাধা ঘোলা করে খেয়েছে। তা আদৌ ঠিক নয়। খেতে খেতে ঘোলা হয়ে যেত জল। তাও মাঝে মাঝে, কদাচিৎ। আমরা যে খাই, তা খেতে খেতে উচ্ছিষ্ট হয়। কেউ কি উচ্ছিষ্ট দিয়ে খাওয়া শুরু করে? আসলে গাধা নয়, মানুষই গাধার ঘোলা করা জল পান করত। গাধা কখনো কোনো অবস্থাতে অবিশুদ্ধ জল পান করে না। মানুষ সর্বদা নিজের সীমাবদ্ধতা উঠোনের উপর চাপিয়ে দেয়।
আবার প্রবোধ এলেন। কোনো জরুরি বিষয় নয়— মেয়েদের জয়দেবপুর পৌঁছে দিতে, তোমরা রেডি হয়ে যাও। তোমাদের দিয়ে আসি। সময় বেশি নেই।
“না, আমরা যাব না,” পঞ্চকন্যা চিৎকার দিল, “ভাব্বার সঙ্গে বিমানবন্দর যাব।”
তাদের চিৎকারে হতভম্ব প্রবোধ আর কিছু না বলে বের হয়ে গেলেন, সকালে যথাসময়ে চলে আসবে। পঞ্চকন্যার চিৎকারে বজ্র ছিল কানফাটা, কিন্তু উল্লাস ছিল না বিন্দুবৎ, ছিল না আনন্দের ছিটাফোঁটা কোথাও।
চিৎকার এত অপ্রসন্ন কেন? কেন মনে হলো বেদনায় ভরা? জানতে চাইলাম।
কেঁদে দিল প্রমিতা, “ভাব্বা, চারটা দিন খুব দ্রুত চলে গেল।”
তার কান্না সংক্রমিত করল বাকিদেরও। সবাই কাঁদতে শুরু করে দিল। শব্দহীন নীরব কান্না। মেয়েরা অল্পতে কেঁদে ফেলে। কাঁদে কষ্টে, কিন্তু বুঝে না তাদের জল কত ভয়ানক অনল হয়ে অন্যের হৃদয় পোড়ায়। আমিও কেঁদে দিলাম তাদের সঙ্গে। বুঝলাম না, আমার মতো আবেগহীন মনে কীভাবে কান্না এল। রচনা কি আর না কেঁদে পারে? যত বড়ো প্রফেসরই হোক, সেও মানুষ।
“ কেঁদো না, আমি কান্নাকে কান্নার ভেতর ঢুকিয়ে হৃদয়ে চালান করে দিয়ে বললাম। জল নয়, হাসি; হাসি দেখতে চাই।”
“ভাব্বা, ওদের তো কিছু হবে না”, প্রমিতা বলল, “আমার তো অনেক কিছু হবে। কষ্টে কষ্টে বুক ভেঙে যাবে।”
কেন গো?
আদরের সঙ্গে আমি ব্যথাও পেয়েছি-না! মধ্যমা ফুলে আছে। এখনো ব্যথা করছে। ব্যথার ব্যথা স্মৃতি থেকে সহজে যায় না।
কে বলল?
আপনিই তো বলেছেন—
“চুমোতে মমতা বেশি, কামড়েতে স্মরণ
নৈকট্য বিরক্তি আনে, বিচ্ছেদ চায় বরণ।”
প্রমিতার পঙ্ক্তি-চুমো আকস্মিক আমার মুখে ছড়িয়ে দিয়ে রচনা সবাইকে হাসিমাখা মুখে বলল, তোমরা হাসো। ভাব্বাকে আমি দুটো চুমো দিলাম। প্রয়োজনে আরও দেব। তবু তোমাদের হাসি চাই। হাসি— হাসো:
সব অশ্রু ভেসে যাক হাসিতে
আগ্রহ ছুটে আসুক জানাতে আর জানিতে
বিরহে জাগুক আশা, তৃপ্তির ক্ষণ
আদরে এলিয়ে যাক শিহরিত মন।”
হাসার চেষ্টা করল মেয়েরা। হাসি তাদের এল, তবে ম্লান। এই হাসিও আলো ছড়ায়। তবু যেন মেঘে ঢাকা অন্ধকার।
কী হলো মাকালী? কাঁদছ কেন এভাবে? সবাই হাসো। মিশু কান্না থামানোর জন্য দুঠোঁট তার জড়িয়ে নিল পরস্পরে খুব মনোরম ভঙ্গিমায়। বড়ো মধুর লাগল, এই তো, মাকালী— মুগ্ধকর ত্রিস্টুভ। কী ছন্দ ওগো ছড়িয়ে দিলে।
কী করেছি? বালিকার মতো অভিমান আনন্দে মিশু বলল।
আমি দেখলাম—
ভাব্বা, কী দেখলেন? মিশুর গলায় বালিকা।
“ওষ্ঠটা তোমার ছুঁয়ে দিল অধর, বেমালুম মমতায়
কত ইতিহাস রচে দিল তা নিশপিশ ঠোঁটের অধর নধর কৌণিক কিনারায়—
বুঝতে কি পেরেছ— ওগো কন্যাপঞ্চ?
সবাই হেসে দিল দুঠোঁট চেপে। এ হাসিতে শব্দ নেই, কেবল রাতের শিশিরের মতো চুমোর নিস্তব্ধতা। মেয়েদের দিকে তাকালাম। তাদের মুখের হাসি বিদায়ের বিরামহীন নৃত্যে নৃত্যে ক্লান্ত হয়ে আছে আগামীর বাসনায় আমার বুকেমুখে নিবিড় মমতায়।
ড্রাইভার এসে গেছে। সময় আরও চেপে বসেছে। বের হতে হবে সহসা। কেয়ারটেকার শেষ দেখা দেখে নিল। দেখে নিল কিছু বাকি আছে কি না নিতে।